নিরাপদ নির্মাণ ও আধুনিক নকশায় স্বাচ্ছন্দ্যময় নগরজীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজছে মানুষ। মডেল: সাবরিন দিবা ও নীল, সাজ: পারসোনা, স্থান কৃতজ্ঞতা: রূপায়ণ সিটি,
নিরাপদ নির্মাণ ও আধুনিক নকশায় স্বাচ্ছন্দ্যময় নগরজীবনের নতুন ঠিকানা খুঁজছে মানুষ। মডেল: সাবরিন দিবা ও নীল, সাজ: পারসোনা, স্থান কৃতজ্ঞতা: রূপায়ণ সিটি,

মূল প্রতিবেদন

নিরাপদ আবাসনে আস্থা

ছুটির দিন সকালে ঘুমিয়েই ছিলেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের (বাস্থই) সভাপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ। ভূমিকম্প শুরু হলে ছেলে তাঁকে ডেকে তোলেন। এ সময় বাবার উদ্দেশে ছেলে বলেন, ‘বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটের সবাই বাইরে বেরিয়ে গেছে, চলো আমরাও বের হই।’ উদ্বিগ্ন ছেলেকে শান্ত কণ্ঠে বাবা আশ্বস্ত করলেন, ‘বাড়িটি আমি নিজেই বানিয়েছি, কিছু হবে না। তুমি গিয়ে ঘুমাও।’

সাম্প্রতিক সময়ে দেশকাঁপানো ভূমিকম্পের দিনের নিজের এমন অভিজ্ঞতার কথা প্রথম আলোকে শোনালেন প্রকৌশলী আবু সাঈদ এম আহমেদ। স্থপতি পিতা যেমন তাঁর পুত্রকে ভবনের নিরাপত্তার বিষয়ে দৃঢ় আশ্বাস দিয়েছেন, তেমনি আবাসন খাতের প্রত্যেক ক্রেতাও চান নিজের ফ্ল্যাট নিয়ে এমনই আস্থা ও দৃঢ়তা।

সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার ভূকম্পন অনুভূত হওয়ায় মানুষের মনে আবাসনের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অগ্নিদুর্ঘটনা, বায়ুদূষণ, প্রযুক্তির অপব্যবহারজনিত ঝুঁকি ও নির্মাণ ব্যয়ের চাপ। এমন বাস্তবতায় আয়োজিত আবাসন মেলা ঘিরে আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা—দুই পক্ষের মধ্যেই নতুন করে আস্থার বার্তা শোনা যাচ্ছে। আবাসন খাতের ব্যবসায় এখন অনেকটাই ধীরগতি। তার মধ্যেও আবাসন মেলার এই আয়োজন এ সময়ে নতুন করে  আশা জাগানোর মেলা হয়ে উঠছে। আজ শুরু হতে যাওয়া এই মেলাকে আবাসন কোম্পানিগুলো দেখছে ক্রেতার আস্থা ফেরানোর সুযোগ হিসেবে। এবারের মেলায় সাশ্রয়ী দামের পাশাপাশি ক্রেতাদের মূল বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভবন বা আবাসনের নিরাপত্তা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। গত ২১ নভেম্বর ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদী। এর ফলে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় কম্পন অনুভূত হয় এবং কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরদিন সাভার ও ঢাকায় মৃদু কম্পন হয়। ৪ ডিসেম্বর নরসিংদীর শিবপুরে ৪ দশমিক ১ মাত্রার একটি মৃদু কম্পন হয়। ১১ ডিসেম্বর সিলেটের বিয়ানীবাজারে ৩ দশমিক ৫ মাত্রার মৃদু কম্পন হয়েছে। পরপরই বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু মৃদু কম্পন রেকর্ড করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। এভাবে একের পর এক ভূমিকম্পে ভবন ও জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে নাগরিকদের।

পরিকল্পিত নগরায়ণ–উত্তরা রূপায়ণ সিটির একটি সড়কে যাত্রীছাউনি ও সবুজবেষ্টিত আবাসিক এলাকা

আবাসনপ্রতিষ্ঠান–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানুষের মৌলিক চাহিদা হিসেবে আবাসনের গুরুত্ব কখনো কমে না; বরং নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিরাপদ ও মানসম্মত আবাসনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। আবাসন ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে আবাসন ব্যবসায় আবার গতি ফিরে আসবে।

এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, নির্বাচনী আবহেও ক্রেতারা মেলায় আসবেন। কারণ, আবাসন একটি দীর্ঘমেয়াদি ও অপরিহার্য বিনিয়োগ। এখন মেলায় নানা ছাড়ে বুকিং দিলে নির্বাচনের পর সেই বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হবে। এবারের মেলার মাধ্যমে ক্রেতাদের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনা আমাদের মূল উদ্দেশ্য। রিহ্যাবের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো মেলায় তাদের মানসম্মত পণ্য নিয়ে হাজির হবে।    

লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ক্রেতাদের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে নির্মাতা কোম্পানিগুলোও নানা প্রস্তুতি নিয়ে মেলায় অংশ নিয়েছে। তারা তাদের নতুন প্রকল্পগুলোয় নিরাপত্তার সর্বোচ্চ আশ্বাস এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। নিশ্চিত ও নিরাপদ একটি স্থায়ী ঠিকানার সন্ধানে ক্রেতারা মেলায় এক ছাদের নিচে বিভিন্ন স্টলে তাঁদের পছন্দসই ফ্ল্যাট এবং প্লট খুঁজে নিতে পারছেন।

ভূমিকম্প ও নিরাপদ নির্মাণের ভাবনা

ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশকে এখন আর কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে রাখা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক ভূমিকম্প মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ফলে ফ্ল্যাট বা ভবন কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতারা এখন আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নকশা অনুমোদন, রড-সিমেন্টের মান, মাটির পরীক্ষা ও বিল্ডিং কোড মানা হচ্ছে কি না—এসব বিষয়ে। আবাসন ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি উপলব্ধি করে ভূমিকম্প–সহনশীল নকশা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরছেন। উন্নত মানের ভিত্তি এবং শক্তিশালী কাঠামোর প্রতিশ্রুতি এবারের মেলার মূল আকর্ষণ।

এ বিষয়ে ট্রপিক্যাল হোমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ রবিউল হক প্রথম আলোকে বলেন, মানসম্মত ভবন নির্মাণ করে নিরাপদ বিনিয়োগের আস্থা তৈরিতে বহু বছর লেগেছে। এখন যারা ভালো ভবন তৈরি করছে, তারা ভালো বিনিয়োগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, গত ৮০ বছরে এমন ঝাঁকুনি দেওয়া ভূমিকম্প দেখিনি। এবারের ভূমিকম্প একটা পরীক্ষা হয়েছে। ভালো ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর নির্মিত ভবনে কোথাও ফাটল হয়নি। উঁচু বহুতল হলেও ভয়ের কিছু নেই। নির্মাণ মান এখন ভালো—এসব ভবন ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প–সহনীয় করে তৈরি হচ্ছে। ক্রেতাবান্ধব এসব ভবন দোল খাবে; কিন্তু ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেই। কোম্পানিগুলো বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করায় ভবনের ক্ষতি হবে না।  

অগ্নিদুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা

অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে এখন আবাসন প্রকল্পে ফায়ার এক্সিট, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা, প্রশস্ত সিঁড়ি ও জরুরি বিদ্যুৎব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব বাড়ছে। আবাসন মেলায় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকল্পে ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেশন ও আধুনিক নিরাপত্তাব্যবস্থার তথ্য তুলে ধরবে, যা ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।

বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্যকর আবাস

ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় বায়ুদূষণ একটি বড় সমস্যা। এই পরিপ্রেক্ষিতে আবাসন খাতে সবুজ ছাদ, পর্যাপ্ত খোলা জায়গা, আলো-বাতাস চলাচলের সুবিধা এবং পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। মেলায় অনেক ডেভেলপার ‘গ্রিন বিল্ডিং’ ধারণা তুলে ধরে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবেন।

প্রযুক্তির ঝুঁকি ও আধুনিক সমাধান

স্মার্ট হোম প্রযুক্তি যেমন জীবনকে সহজ করছে, তেমনি সাইবার নিরাপত্তা ও প্রযুক্তিনির্ভরতার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। এ কারণে আবাসন ব্যবসায়ীরা এখন নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, যাতে ক্রেতারা সুবিধার পাশাপাশি নিরাপত্তাও পান।

প্রত্যাশা

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ডলার–সংকট ও নির্মাণ উপকরণের উচ্চ মূল্যের কারণে গত বছর আবাসন বাজারের গতি ছিল কিছুটা ধীর। রড–সিমেন্টসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে বেড়ে গেছে ফ্ল্যাটের দামও। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আবাসন ব্যবসায়ীরা এবার বিশেষ সুবিধার প্যাকেজ নিয়ে আসছেন।

মেলা নিয়ে আশাবাদ

মেলার পরিবেশে ক্রেতারা এক জায়গায় নানা প্রকল্পের তথ্য পাচ্ছেন, তুলনা করতে পারছেন। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকঋণের সুবিধা ও বিশেষ ছাড়ও আশা তৈরি করছে।

রিহ্যাব মেলার গুরুত্ব

নির্বাচনী আবহে রিহ্যাব মেলা শুধু বেচাকেনার জায়গা নয়, বরং ক্রেতা ও আবাসন ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সেতুবন্ধ। নিরাপদ আবাসন নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা দেওয়া এই মেলার আরেক অন্যতম উদ্দেশ্য বলে জানা যায়।

এ বছরের বিশেষত্ব

আবাসন নির্মাতাদের সংগঠন রিহ্যাব জানায়, এ বছর মেলায় নিরাপত্তা, পরিবেশ ও প্রযুক্তি—এই তিন বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভূমিকম্প ও অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে আলাদা আলোচনা, সবুজ আবাসনের প্রচার এবং বাস্তবসম্মত মূল্য প্রস্তাব এ বছরের মেলাকে আলাদা করছে।  

সব মিলিয়ে কঠিন সময়ে জমে উঠবে আবাসন খাতের নতুন প্রত্যাশা। নিরাপদ আবাসনে আস্থা ফিরলে বাজারও ধীরে ধীরে গতি পাবে—এমনটাই আশা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।