আত্মসাতের দায়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির দুই সাবেক চেয়ারম্যান ও এক সাবেক পরিচালক এখন কারাগারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম। বাড়িটির ঠিকানা ১১৫২২ মানাতি বে এলএন, ওয়েলিংটন, এফএল ৩৩৪৪৯। ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বাড়িটি কেনা হয়েছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৭ মার্কিন ডলার দিয়ে।
বাড়ি কিনতে কোনো ঋণ নেওয়া হয়নি, অর্থাৎ পুরো অর্থই একবারে পরিশোধ করা হয়। এ ছাড়া ছেলেমেয়ের নামে মো. নজরুল ইসলাম একই রাজ্যে গড়ে তুলেছেন তিনটি কোম্পানি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। দুদক বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। সেই নজরুল ইসলাম এখন কারাগারে। গত সোমবার তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে শাহবাগ থানার পুলিশ।
আর গত মঙ্গলবার আদালতে তুললে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আহমেদ শুনানি শেষে নজরুল ইসলামের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। নজরুল ইসলামের পাশাপাশি ফারইস্টের সাবেক চেয়ারম্যান এম এ খালেক ও তাঁর ছেলে রুবাইয়াত খালেকও কারাগারে এখন। এ দুজনকে রিমান্ডে না নিয়ে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন আদালত।
‘ফারইস্ট লাইফ একটি ভালো কোম্পানি ছিল। এর সাবেক পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কোম্পানিটির এখন খারাপ অবস্থা। ভালো খবর যে কয়েকজন ধরা পড়ে কারাগারে। বিমা খাতের অন্য কোম্পানিগুলো এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।’মোহাম্মদ জয়নুল বারী, আইডিআরএর চেয়ারম্যান
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাংক খাতে একসময় ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি ছিল বেসিক ব্যাংকের, তেমনি বিমা খাতে ছিল ফারইস্ট লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। চেয়ারম্যান হিসেবে পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনকালে শেখ আবদুল হাই যেমন বেসিক ব্যাংককে ধ্বংসের কিনারে নিয়ে গেছেন, ফারইস্ট লাইফে একই পরিস্থিতি হয়েছে। বিপুলসংখ্যক পলিসি হোল্ডারের বিমা পলিসির মেয়াদ শেষ হলেও কোম্পানিটি এখন দাবি পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে।
কীভাবে তা সম্ভব হলো, তার একটি চিত্র উঠে আসে ফারইস্ট লাইফের ওপর করা সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানির এক বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ২০২১ সালের এপ্রিলে সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানিকে ফারইস্ট লাইফের ওপর নিরীক্ষা করার দায়িত্ব দেয়। গত মে মাসে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আইডিআরএর কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারইস্ট লাইফ থেকে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এর বাইরে অনিয়ম হয়েছে ৪৩২ কোটি টাকার। অর্থাৎ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার ও পলিসিহোল্ডাররা তাঁদের ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হারিয়েছেন। নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকসহ কোম্পানির সাবেক সব পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্লাহ এবং কোম্পানির কিছু শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাও এ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটান।
চাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পর্ষদের নির্দেশে তিনি সব কাজ করেছেন।মো. হেমায়েত উল্লাহ, ফারইস্ট লাইফের সাবেক সিইও
বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কেনা, বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ফারইস্টের মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে পরিচালকদের ঋণ নেওয়া এবং ক্ষতিকর বিনিয়োগ—মূলত এই তিন উপায়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। এমটিডিআর হচ্ছে একধরনের স্থায়ী আমানত।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। একই মাসে সিইও মো. হেমায়েতউদ্দিনকে বরখাস্ত করে আইডিআরএ। কোম্পানিটি চলছে এখন স্বতন্ত্র পরিচালকদের মাধ্যমে।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফারইস্ট লাইফ একটি ভালো কোম্পানি ছিল। এর সাবেক পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কোম্পানিটির এখন খারাপ অবস্থা। ভালো খবর যে কয়েকজন ধরা পড়ে কারাগারে। বিমা খাতের অন্য কোম্পানিগুলো এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।’
২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ফারইস্ট লাইফ ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে জমি কেনে। এসব জমি কেনা হয় বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। এর মধ্যে ৭টি জমি কেনা ও ভবন নির্মাণ এবং বালু ফেলার নামে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ির ৭৮৬ শতাংশ জমি ১৯৯ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে বলে হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এ জমি কেনা হয়েছে ১৯ কোটি টাকায়। ১৯৯ কোটি টাকার মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে চেকে দেওয়া হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, কেডিসি কনস্ট্রাকশন ও মাহবুবা অ্যাসোসিয়েটকে চেকে দেওয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকা এবং রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ চেকে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা দেওয়া হয়েছে নগদে।
কোম্পানির ৭২ কাকরাইলের জমি কেনায় ১৬০ কোটি এবং গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউয়ের জমি কেনায় ৮৯ কোটি, গুলশানের আরও ২ জমিতে ৮০ কোটি এবং বরিশালের আলেকান্দায় এক জমি কেনায় ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তিনটি দলিল সংগ্রহ করে দেখা গেছে, কাকরাইলের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের শ্বশুর মো. মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে। জমি বিক্রির পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাছলিমা ইসলামকে ১১৫ কোটি টাকা উপহার দেন মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদ। তাছলিমা ইসলাম আবার সেখান থেকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন তাঁর স্বামী নজরুল ইসলামকে।
তোপখানা রোডের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের বন্ধু নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দুই সহোদর মো. সোহেল খান ও মো. আজাহার খানের কাছ থেকে। আর মিরপুর চটবাড়ির নিচু এলাকার জমি কেনা হয়েছে ২০ জন বিক্রেতার কাছ থেকে।
দলিলগুলোতে বলা হয়েছে, জমির মালিকদের টাকা দেওয়া হয়েছে নগদে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বিমা আইন অনুযায়ী, ৫ হাজার টাকার বেশি হলেই লেনদেন করতে হয় ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে।
ফারইস্ট লাইফের সাবেক সিইও মো. হেমায়েত উল্লাহকে গতকাল মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি। তবে কয়েক দিন আগে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, চাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পর্ষদের নির্দেশে তিনি সব কাজ করেছেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমটিডিআর বন্ধক রেখে ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ফারইস্ট লাইফের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের একাংশ। এর মধ্যে এম এ খালেক, প্রাইম প্রোপার্টি, প্রাইম ফাইন্যান্স, ম্যাকসন্স, মিজানুর রহমানের নামে বন্ধক রেখে ৫৪২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
বলা হয়েছে, ফারইস্টের এমটিডিআর বন্ধক রেখে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির নামে ১৬৪ কোটি, পিএফআই প্রোপার্টিজের নামে ১৬০ কোটি, ফারইস্ট প্রোপার্টিজের নামে ১৫১ কোটি, প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ৯২ কোটি, মিথিলা প্রোপার্টিজের নামে ৬৪ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ৫৫ কোটি, মিথিলা টেক্সটাইলের নামে ৪৮ কোটি, কে এম খালেদের নামে ২১ কোটি, মোল্লা এন্টারপ্রাইজের নামে ২০ কোটি, আজাদ অটোমোবাইলসের নামে ৯ কোটি এবং কামাল উদ্দিনের নামে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিকর বিনিয়োগের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ২৮৭ কোটি টাকার তহবিল আত্মসাৎ করে কোম্পানিটির সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা।
এর মধ্যে বাংলালায়ন কনভার্টেবল জিরো কুপন বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪০ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৩২ কোটি, প্রাইম ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪ কোটি, আল-ফারুক ব্যাগসে বিনিয়োগের মাধ্যমে ২ কোটি এবং কর্মকর্তাদের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব দেখিয়ে ৮৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ছাড়া তিন বছরে ৪৩২ কোটি টাকার পরিচালনাগত ত্রুটি ও অনিয়ম হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান হাসিনা শেখ প্রথম আলোকে বলেন, এ যেন বিমা খাতের বেসিক ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন না থাকলে কী হয়, তারই বড় উদাহরণ ফারইস্ট লাইফ। প্রতিষ্ঠানটির ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা লুটপাটের পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কারণ, একটি কোম্পানির এমন ঘটনা পুরো খাতের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকারক।