
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে চলতি অর্থবছরের বাজেটীয় লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে বাস্তবভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
নির্বাচনের বছরেও দেশে মূল্যস্ফীতি কমছেই না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তার ধারেকাছেও নেই মূল্যস্ফীতি। অর্থবছর শুরুর মাস জুলাইয়ের পর থেকেই মূল্যস্ফীতি রয়েছে ৯ শতাংশের ঘরে।
অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারও অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার রাজস্ব আদায়ের চিত্রও নিম্নমুখী, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রকৃত আদায়ে অনেক ঘাটতি। ভালো আসছে না প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ও রপ্তানি আয়। ডলার–সংকট তো আছেই।
সংশোধিত বাজেট যদি ৭ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ঠিক করা হয়, তাহলে তা বাস্তবসম্মতই হচ্ছে বলব। তবে আগামী বাজেট যদি আট লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, সেটি আবার উচ্চাভিলাষী হয়ে যাবে।আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
সামষ্টিক অর্থনীতির এসব অবস্থা বিবেচনায় রেখে চলতি অর্থবছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে বাস্তবভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী এই অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৭ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ সংশোধিত বাজেটের আকার ৫১ হাজার কোটি টাকা কমছে। আর মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে গতকাল বৃহস্পতিবার ভার্চু৵য়ালি অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার, বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী, পরিকল্পনাসচিব সত্যজিৎ কর্মকার প্রমুখ অংশ নেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। আর মূল্যস্ফীতির বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। নভেম্বর পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ, যা অক্টোবরে ছিল ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরেই থাকছে।
আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলছে, সে বাস্তবতায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার বাস্তবতা নেই বলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, অনুদান ছাড়া চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
বৈঠকে রাজস্ব আয়ের নিম্নগতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব ১২ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়া, ডলার–সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। কিন্তু আশার কোনো বাণী শোনাতে পারেননি কেউই। এ ছাড়া সুদের হার বাজারভিত্তিক করার পদক্ষেপ এখনই না নেওয়ার পরামর্শ এসেছে বৈঠকে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ শতাংশ কমেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি এখন নেতিবাচক। এসব বিবেচনায়ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে বৈঠকে বলা হয়েছে।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে। দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার হবে ৮ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা একমত হয়েছেন যে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা যেতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হবে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ ছাড়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হবে ৫ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা।
বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংশোধিত বাজেট যদি ৭ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ঠিক করা হয়, তাহলে তা বাস্তবসম্মতই হচ্ছে বলব। তবে আগামী বাজেট যদি আট লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়, সেটা আবার উচ্চাভিলাষী হয়ে যাবে। ’
আহসান মনসুর আরও বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার কতটা সফল হবে, তার ওপর নির্ভর করবে দেশের মানুষ কতটা স্বস্তিতে থাকতে পারবেন। তবে ডলার–সংকট মেটানোর আপাতত কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। আর প্রবৃদ্ধির হার ৬ বা ৭ শতাংশ এখন যথেষ্টই। অর্থনীতির যে অবস্থা, প্রবৃদ্ধির হার এর চেয়ে বেশি হওয়ার কোনো লক্ষণ কি আছে? ’