
বিদায়ী ২০২২ সালের শুরুতে কেউ কি ভেবেছিলেন এই বছরে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বাণিজ্যে ধস নামবে, বাজার থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার হাওয়া হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই কেউ ভাবেননি। কারণ, করোনার ছোবল থেকে বের হয়ে বিশ্ব আবার স্বাভাবিকের দিকেই যাচ্ছিল। তা ছাড়া করোনাকালে সবচেয়ে ভালো করেছে প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে তাদের বাজার ক্রমাগত বেড়েছে। বদৌলতে আইটি কোম্পানিগুলোর প্রতিষ্ঠাতা ও সহপ্রতিষ্ঠাতাদের সম্পদের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হয়েছে।
অবশ্য বছর শেষে শুরুর ছবিটা ধোঁয়াটে হয়ে কোথাও কোথাও অস্পষ্ট হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পতন বোঝা না গেলেও বছর শেষে প্রযুক্তি খাতের টালমাটাল অবস্থাটা বিশ্ববাসীর কাছে প্রকট হয়ে উঠেছে। এপ্রিলে সে সময়কার বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক প্রথমবারের মতো টুইটার কেনার ঘোষণা দিলে তা যেন সবাইকে নড়েচড়ে বসার তাগাদা দেয়। তার আগে থেকে মাস্ক সোশ্যাল মিডিয়ায় বটের (স্বয়ংক্রিয় অ্যাকাউন্ট) ব্যবহার, নানা রকম অ্যালগরিদমের মাধ্যমে ‘ফেক তথ্য’ প্রচার বন্ধ করতে না পারা নিয়ে নানা বিভিন্ন অভিযোগ করলেও সেটা খুব একটা আমলে নেননি কেউ। কিন্তু যখনই মাস্ক টুইটার কেনার কথা বলেন, তখনই অনেকে এদিকে নজর দিতে শুরু করেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলারের সংকট ও মূল্যস্ফীতির কারণে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের খরচের খাত কমাতে শুরু করে। এতে প্রথম কোপটা যায় প্রচার-প্রচারণায়। আর এতেই প্রথম ধাক্কা খায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কারণ, বিশ্বের মোট ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাজারের ৭৪ শতাংশ তখন গুগল, ফেসবুক ও অ্যামাজনের দখলে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারের খরচ সংকোচনের ফলে এই তিন প্রতিষ্ঠানেরই আয় কমে যায়। ফলে বিদায়ী ২০২২ সালে মেটা (ফেসবুক) ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করে। গুগল ১০ হাজার ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতি নেয়। অন্যরাও সমানতালে বিদায় করছে কর্মী। যাহোক, বিদায়ী বছরে অ্যাপল, অ্যালফাবেট (গুগলের মূল কোম্পানি), মেটা, অ্যামাজনসহ শীর্ষ ১০টি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিই প্রায় দেড় ট্রিলিয়ন (দেড় লাখ কোটি) ডলারের বাজার তহবিল হারিয়েছে। প্রসঙ্গত, এক ট্রিলিয়ন মানে এক লাখ কোটি।
অন্যদিকে ডিজিটাল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সির বৈশ্বিক বাজারও ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল বছরের গোড়ার দিকে। সে সময় প্রতিটি বিটকয়েনের মূল্য ছিল ৪৬ হাজার ডলারের বেশি। ৩১ ডিসেম্বর সেই দর কমে নেমেছে মাত্র ১৬ হাজার ৬০৩ ডলারে।
বিদায়ী বছরে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম ‘ফিউচার্স এক্সচেঞ্জ’ বা এফটিএক্সের নানা দুর্নীতির খবর উঠে এসেছে। এর প্রতিষ্ঠাতা স্যাম বার্কম্যান-ফ্রাইড বাহামায় গিয়েও পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। তবে বছরের শেষ সপ্তাহে অবশ্য ২৫ কোটি ডলারের বিনিময়ে জামিন পেয়েছেন। এফটিএক্সের ঘটনা একটি বড় হোঁচট হয়ে দেখা দেয় তৃতীয় প্রজন্মের ওয়েবের অনুসারীদের জন্য। মনে করা হচ্ছে, এফটিএক্সের পতন ও বিটকয়েনের ব্যাপক দরপতন নতুন বছর ২০২৩ সালে ক্রিপ্টোপ্রেমীদের একটি রক্ষণশীল পজিশনে ঠেলে দেবে। এর প্রকাশ দেখা যাবে ভেঞ্চার বিনিয়োগে।
বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে নতুন বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে প্রযুক্তির নানাবিধ প্রয়োগ কেবল প্রযুক্তিবাণিজ্য নয়, সারা বিশ্বের বাণিজ্যব্যবস্থাকে আরও পরিমার্জন ও সংশোধনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই যারা আগেভাগে প্রস্তুতি নেবে, তারাই টিকে থাকবে।
ক্রিপ্টোভিত্তিক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হবেন। কারণ, এফটিএক্সে বিনিয়োগের ব্যাপারে ‘যথাযথ যাচাই-বাছাই’ করেনি বলে মেগা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেকুওয়া ক্যাপিটালের প্রতিও অনেকেই তর্জনী তুলে বসে আছেন। এই সতর্কতা অন্যান্য স্টার্টআপে বিনিয়োগেও প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২২ সালে স্টার্টআপের রাজধানী খ্যাত ইসরায়েলে বৈশ্বিক বিনিয়োগ ৫০ শতাংশ কমেছে। এটি অব্যাহত থাকবে বিশ্বজুড়ে। এমনিতে আমাদের স্টার্টআপের বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রাপ্তি এখনো লাইনে ওঠেনি। তাই ২০২৩ সালে দেশীয় স্টার্টআপেরও বিদেশি বিনিয়োগ প্রাপ্তি কমে যতে পারে।
বিদায়ী বছরে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের ভালোই উন্নতি হয়েছে। বছরের শেষে এসে ওপেনএআই প্রতিষ্ঠানের চ্যাটজিপিটি এবং বছরের মধ্যভাগে স্ট্যাবিলিটি এআইয়ের বিকাশ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই দুটি প্রকল্প কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানামুখী, বিশেষ করে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ প্রয়োগের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ছবি আঁকা কিংবা চাকরির কভার লেটার লিখে নেওয়া সবই সম্ভব হচ্ছে এখন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, এসব পদ্ধতি এখন যে কেউ ব্যবহার করার মতো হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত গভীর জ্ঞান ছাড়াই যে কেউ এগুলো ব্যবহার করতে পারছেন। ২০২৩ সালজুড়ে কাজটা অনেক এগিয়ে যাবে।
বিদায়ী বছর আরও একটি বড় ঘটনা হলো, চীনের সঙ্গে আমেরিকার চিপ (কম্পিউটার যন্ত্রে ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ)। করোনার সময়ে চীনের কঠোর লকডাউন তথা বিধিনিষেধ বিশ্বব্যাপী চিপের সংকট তৈরি করে, যা এখনো সম্পূর্ণ শেষ হয়নি।
অন্যদিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের কারণেও অনেকেই এখনো শঙ্কিত। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চিপ তৈরি করে তাইওয়ানের টিএমএসসি। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার মতো চীনও যদি তাইওয়ানে কিছু করে বসে, তাহলে বিশ্বের চিপ সরবরাহব্যবস্থা সম্পূর্ণ ওলটপালট হয়ে যাবে। এসব কারণে আমেরিকা ও ইউরোপ নিজেদের মহল্লায় ও অন্যের জমিতে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প গড়ে তোলায় জোরদার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে। এ জন্য বাইডেন প্রশাসন ২৮ হাজার কোটি ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে আমেরিকা ও ইউরোপের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ভারতের মোদি সরকারও চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভারতে চিপ কারখানা স্থাপনে ‘সমান বিনিয়োগে’র ম্যাচিং ফান্ডিংয়ের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে।
চলতি ২০২৩ সালজুড়ে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে টানাপোড়েন আরও তীব্র হয়ে উঠবে বলে মনে হচ্ছে। এই খাতে বাংলাদেশও বিশেষ নজর দিতে পারে। বিশেষ করে এই খাতে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাব তীব্র হবে বিশ্বজুড়েই। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁদের একটা অংশকে প্রয়োজনীয় দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করে তুলে দেশে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিকে বড় আকারে গড়ে তোলার একটা সুযোগ উপস্থিত হয়েছে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাঁটাইয়ের বড় প্রকোপ গিয়েছে ভারত, এশিয়ার অন্যান্য দেশ ও আফ্রিকান কর্মীদের ওপর। এঁদের একটি অংশ বিশ্বব্যাপী কম মজুরিতে নতুন বাজারে ঢোকার চেষ্টা করবেন। এতে আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বাদ যাবে, এটা ভাবা ঠিক হবে না। বিশেষ করে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক ও চামড়াশিল্পে বর্তমানে ভারত ও শ্রীলঙ্কার অনেক কর্মী কাজ করছেন, যাঁরা দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। যথাযথ নজর না দিলে সিলিকন ভ্যালির কর্মচ্যুত ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কানরা আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলতে পারেন। ২০২৩ সালে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
চলতি বছর বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ওলটপালটের মধ্য দিয়ে যাবে। টুইটারের টালমাটাল অবস্থা কমপক্ষে আরও ছয় মাস অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। মেটাভার্স নিয়ে ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা গোঁ ধরে রাখাটাও অব্যাহত থাকবে। এসবের কারণে আমাদের, বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যাঁরা তাঁদের পণ্যের প্রচারের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল, তাঁদের বিপণন কৌশলে পরিবর্তন আনতে হবে।
অবশ্য বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে নতুন বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে প্রযুক্তির নানাবিধ প্রয়োগ কেবল প্রযুক্তিবাণিজ্য নয়, সারা বিশ্বের বাণিজ্যব্যবস্থাকে আরও পরিমার্জন ও সংশোধনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই যারা আগেভাগে প্রস্তুতি নেবে, তারাই টিকে থাকবে।