
‘আমি যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারি। এমনকি প্রয়োজনে যেকোনো সময় ঠান্ডা মেঝেতে শুয়েও রাত কাটাতে পারি।’ কথাগুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নতুন মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলার। ২০১২ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের সম্পর্কে এমনভাবে বর্ণনা করেন এনগোজি।
আসলেই ভাবাই যায় না কতটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে নাইজেরিয়ায় জন্ম নেওয়া এনগোজিকে। ছোটবেলাতেই নৃশংস গৃহযুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর। ওই গৃহযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবও পড়েছিল তাঁর পরিবারের ওপর। পুরো সঞ্চয় হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল তাঁর পরিবার। তাই তখন থেকেই কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে এনগোজির। বিবিসির ওই সাক্ষাৎকারে এনগোজি বলেন, ‘জীবন পুরো পেছনের দিকে চলে গিয়েছিল। আমার মা-বাবা তাঁদের পুরো সঞ্চয় হারিয়েছিলেন, আমাদের নিজের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। ইগবোসে ছিলাম।’
গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৬০ সালে যখন ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় নাইজেরিয়া, তখন এনগোজির বয়স ৬ বছর। তিনি দেশটির দক্ষিণে একটি ছোট্ট গ্রামে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর মা-বাবা দুজনই তখন উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপে যান। এনগোজির বাবা নাইজেরিয়ার খুব প্রখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন। এনগোজি ও তাঁর আরও ছয় ভাইবোন সে সময় ছিলেন দাদির কাছে। ৯ বছর বয়সেই এনগোজি রান্না করা, কাঠ আনা এবং পরিবারের অনেক কাজ করতে শিখে গিয়েছিলেন।
কিছুদিনের মধ্যে নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধের শুরু হয়। পড়াশোনা ব্যাহত হয় এনগোজির। সেই সঙ্গে পড়তে হয় আরও কষ্টের জীবনে। ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। গৃহযুদ্ধের মধ্যেই একবার ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এনগোজির তিন বছরের ছোট্ট বোনটি। জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। বোনটিকে কোলে নিয়ে একা তিন মাইল দূরে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেছেন এনগোজি। তিনিও তখন শিশু। তাঁর ওই সাহসিকতায় সেবার জীবন বেঁচেছিল তাঁর বোনের। বিয়াফ্রান রাষ্ট্র গঠন নিয়ে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়। বহু বছর ধরে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে টিকে থাকতে হয়েছিল এনগোজির পরিবারকে। তিনি বলেন, ‘আমরা একদিন খাবার খেয়েছি। কখনো মেঝেতে, কখনো বাংকারে ঘুমাতে হতো। সত্যিই দেখেছি যে কষ্ট সহ্য করার অর্থ কী। দেখতাম আমার চারপাশে শিশুরা মারা যাচ্ছে।’
জীবনের এমন সব কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া এনগোজির জীবনের পরের সাফল্য যেন এক গল্পগাথা। কর্ম সময়জুড়েই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি। ১৯৭৬ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর এমআইটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর প্রথম নারী হিসেবে তিনি নাইজেরিয়ার অর্থ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। বিশ্বব্যাংকে ২৫ বছর কাজ করেছেন তিনি। এ ছাড়া প্রথম নারী হিসেবে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে শামিল হয়েছিলেন। গত বছরের শেষ অবধি তিনি দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স-গ্যাভির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি লাখ লাখ শিশুর বার্ষিক টিকা প্রদান নিরীক্ষণ করেছেন। অবশেষে নিলেন নতুন দায়িত্ব।
তবে ডব্লিউটিওর দায়িত্ব প্রাপ্তি নিয়েও কম ঝামেলা হয়নি। কারণ গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বাগড়ায় নেতা নির্বাচন নিয়ে দোটানার মধ্যে পড়ে যায় ডব্লিউটিও। প্রথমে এনগোজির নাম প্রস্তাব করেছিল সংস্থাটির তিন সদস্যের মনোনয়ন কমিটি। প্রচলিত চর্চা অনুযায়ী তাঁরই নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভেটো দিয়ে বসে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন এনগোজির মনোনয়নের বিরোধিতা করে আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী ইউ মিউং-হিকে ডব্লিউটিওর মহাপরিচালক পদে বসাতে ভেটো দেয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র জানায়, তারা সংস্থাটির প্রধান হিসেবে এমন একজনকে চায়, যার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। আর মিউং-হিকে এমনই একজন মনে হয় ওয়াশিংটনের কাছে। তবে গত ২০ জানুয়ারি ট্রাম্পের বিদায়ের পর নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এনগোজিকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তাঁর নিয়োগের বিষয়ে পশ্চিমা একজন কূটনীতিক বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘একজন নারী বা আফ্রিকান বলে তাঁকে এই পদে বেছে নেওয়া হয়নি। যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার কারণেই তাঁকে এই দায়িত্বের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে।’ কূটনীতিকের এই মন্তব্যের যথার্থতা আছে। কারণ, বাণিজ্যকে সব সময় ‘একটি লক্ষ্য ও একটি আবেগ’ হিসেবে বর্ণনা করে এসেছেন এনগোজি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের চেয়েও বড় কিছু তিনি।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নাইজেরিয়ার অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন এনগোজি। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর তিন বছরের ব্যবধানে আফ্রিকার বৃহত্তম দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ঘরে যায়। তিনি সরকারের সংস্কার উন্নয়নে এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করে এমন সব কর্মসূচি বিকাশের জন্যও কৃতিত্ব পান। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের জুন পর্যন্ত নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী ছিলেন এনগোজি। এরপর মাসখানেকের জন্য দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। পরে ২০১১-১৫ মেয়াদে আবার অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি দেশটির ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা সামাল দিয়েছিলেন।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করতে চান এনগোজি। নির্বাচিত হওয়ার পর ৬৬ বছর বয়সী এনগোজি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি থেকে বিশ্বকে পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে একটি শক্তিশালী ডব্লিউটিও। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। তিনি বলেন, ‘একজন নারী ও একজন আফ্রিকান হিসেবে নয়, আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে বিস্তীর্ণ সংস্কার করতে আমার সাহস ও আবেগের প্রতি আপনাদের আস্থার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’ তিনি বলেন, ‘এটি একটি দীর্ঘ এবং কঠিন রাস্তা, অনিশ্চয়তায় পূর্ণ, তবে এখন এটি একটি নতুন দিনের ভোর। সঠিক কাজ শুরু করা যেতে পারে।’
বড় বড় সব জায়গা ছাড়াও সারা বিশ্বের অন্তত ২০টি অলাভজনক সংস্থায় এনগোজি পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। নিজস্ব ডক্টরেট ডিগ্রি ছাড়াও ১০টি সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেছেন তিনি। ২০টির ওপর বড় পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বের ক্ষমতাশালী ১০০ নারীর মধ্যে রয়েছেন তিনি। বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী মানুষের তালিকায়ও রয়েছে তাঁর নাম। এই তালিকায় আফ্রিকার মধ্যে তাঁর অবস্থান ১০-এ।
আগামী পয়লা মার্চ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেবেন এনগোজি। ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করবেন।