
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারিত হয় মানচিত্রে রেখা টেনে, সেই কাজটা করেন লর্ড র্যাডক্লিফ। তারপরও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি ছিল। সেটা হলো, সম্পদ ভাগাভাগি। নতুন দুই দেশের কার ভাগে কী যাবে, তা ঠিক করা আরও কঠিন ছিল।
ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়টি একেক ক্ষেত্রে একেকভাবে করা হয়েছে। ভাইসরয়ের বাগি (এক বা দুজন যাত্রী বহনকারী ঘোড়ায় টানা হালকা গাড়িবিশেষ) কার কাছে থাকবে, তা নির্ধারণে কয়েন দিয়ে টস করা হয়, টসে জিতে ভারত সেই বাগির উত্তরাধিকারী হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে সেটি রাখা হয়। উদ্দেশ্য, ভারতের রাষ্ট্রপতি তা ব্যবহার করবেন।
তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ সালে নিরাপত্তাজনিত কারণে সেই বাগির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ২০১৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এক অনুষ্ঠানে সেটি ব্যবহার করেছিলেন। তবে মানবসম্পদসহ আরও কিছু সম্পদ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে ভাগাভাগি হয়।
সম্পদ ভাগাভাগির লক্ষ্যে লর্ড ম্যাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পার্টিশন কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ও রাজেন্দ্র প্রসাদ; মুসলিম লিগের প্রতিনিধিত্ব করেন লিয়াকত আলী খান ও আবদুর রব নিস্তার।
পরবর্তীকালে আবদুর রব নিস্তারের জায়গায় আসেন স্বয়ং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ; কমিটির নাম বদলে রাখা হয় পার্টিশন কাউন্সিল, যার অধীন ১০টি বিশেষজ্ঞ কমিশন এ ভাগাভাগি তদারক করে।
দেশভাগ বন্ধুত্বসুলভ পরিবেশে হয়নি। তবে ভাগাভাগির একটা অংশ তুলনামূলকভাবে নির্ঝঞ্ঝাট ছিল—প্রতিরক্ষা, মুদ্রা ও আর্থিক বিষয়ে সহযোগিতার ঐকমত্য ছিল দুই দলের মধ্যে।
দেশভাগের ঐকমত্যের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ ভারতের ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ সম্পদ ও দায় পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। কিন্তু সেটাই শেষ ছিল না, পাকিস্তানের নবগঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের আরেকটি ফয়সালা বাকি ছিল, সেটা হলো, নগদ স্থিতির বিষয়টি নিষ্পত্তি করা।
সেই সময় ভারতের হাতে ছিল ৪০০ কোটি রুপি। পার্টিশন কাউন্সিলের হিসাবে পাকিস্তানের ভাগে পড়ে ৭৫ কোটি রুপি; কাজ চালানোর জন্য ২০ কোটি রুপি ১৫ আগস্টের আগেই পাকিস্তানকে দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার পর এক বছর ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতি এক ও অভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ বন্দোবস্ত ছিল। যদিও প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দুই দেশ এক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীন পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ঐকমত্য অনুযায়ী ৫৫ কোটি রুপি পরিশোধ নিয়ে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সম্পর্কের অবনতি হলে অক্টোবরের আগেই সেই বন্দোবস্ত বাতিল হয়ে যায়।
এ সময়ে ভারত ও পাকিস্তানে একই মুদ্রা চলত। বিশেষজ্ঞ কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল, ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দুই দেশে একই মুদ্রা চলবে।
১৯৪৭ সালের আগস্টেই পাকিস্তানকে ২০ কোটি রুপি দেওয়া হলেও ভারতভাগের পরপরই পাকিস্তান ভাড়াটে যোদ্ধাদের নিয়ে কাশ্মীরের একাংশ দখল করলে বাকি ৫৫ কোটি রুপি পরিশোধ নিয়ে বিপত্তি বাধে। ভারত ওই অর্থ ছাড় করা বন্ধ করে। ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেল পরিষ্কার করেই বলেন, কাশ্মীরের বিষয়ে ফয়সালা না হলে এই অর্থ ছাড় করা হবে না। তখন পাকিস্তান এ নিয়ে আপত্তি করেনি।
কিন্তু ১৯৪৭ সালের ২২ ডিসেম্বর কাশ্মীরের বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনার সময় পাকিস্তান এই দুটি বিষয়কে এক করে দেখার বিষয়ে আপত্তি জানায় এবং অনতিবিলম্বে ৫৫ কোটি রুপি ছাড় করার দাবি জানায়। ভারত বলে, এ চুক্তি তারা মানে, তবে দুই দেশের মধ্যে যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে, তার আলোকে অর্থ ছাড় করা হবে না। যদিও মহাত্মা গান্ধী ভারতের এ অবস্থান ভালো চোখে দেখেননি এবং যথারীতি সমস্যা নিরসনে তিনি অনশনে বসেন। পরে ভারত সরকার তাঁর অবস্থানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সমস্যা নিরসনে উদ্যোগ নেয়।
১৯৪৭ সালের পর ৭৬ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো দুই দেশ দাবি করে, তারা পরস্পরের কাছে অর্থ পায়। প্রতিবছর ভারত সরকার অর্থনৈতিক সমীক্ষায় নিয়মমতো বলে, দেশভাগের আগের ঋণের ভাগ হিসেবে ভারত পাকিস্তানের কাছে অর্থ পাবে; এত দিনে সুদ–আসলে যা ৩০০ কোটি রুপিতে উন্নীত হয়েছে।
পাকিস্তান ২০১৪ সালে বলে, আরবিআই দেশভাগের সময় পাকিস্তানের প্রাপ্য অনেক সম্পদ দেয়নি, এত দিনে সুদ–আসলে যা ৫৬০ কোটি রুপিতে উঠেছে। ভারতের অর্থনৈতিক সমীক্ষার মতো পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বলে, ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে তারা অর্থ পাবে। বকেয়া পরিমাণ মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারের কারণে ফুলেফেঁপে উঠেছে।
অর্থের মতো সম্পদও ভাগাভাগি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। সেই প্রক্রিয়া যে সুখকর হয়নি, তা বলাই বাহুল্য। এমনকি পুলিশের কর্তাদের মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে সেই বৈরিতার অবসান এখনো হয়নি।
দুই দেশের মধ্যে ভাগাভাগির আরেকটি বিষয় ছিল সরকারের জনবল। পুরো ভারতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল এই জনবল। অনেক চিন্তাভাবনা ও আলোচনার পর পার্টিশন কাউন্সিল সিদ্ধান্ত দেয়, দেশ বেছে নেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের সুযোগ দেওয়া হবে। তাঁরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেবেন যে তাঁরা কি ভারত সরকারের কর্মচারী হিসেবে কাজ করবেন নাকি পাকিস্তান সরকারের হয়ে কাজ করবেন। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক দুই ক্ষেত্রেই এ সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু আসল সমস্যা দেখা দেয় তার পরে। দেখা গেল কোথাও অতিরিক্ত জনবল হয়ে গেছে, আবার কোথাও তৈরি হয়েছে ঘাটতি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন, এমন বিপুলসংখ্যক মানুষ ভারতে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত দেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অতিরিক্ত জনবলের সমস্যায় পড়ে। অপর দিকে পূর্ব পাকিস্তান পড়ে জনবলঘাটতির সমস্যায়। কারণ, নতুন দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করতেন, এমন অনেক কর্মচারী ভারতে চলে যান। ফলে তীব্র জনবলঘাটতি হয়।
আবার অনেক সরকারি কর্মচারী দেশ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তীব্র মানসিক পীড়নে পড়ে যান। বিশেষ করে তাঁরা, যাঁদের আত্মীয়স্বজন দুই দেশেই ছিলেন।
দুই দেশের মধ্যে সেনাসদস্য ভাগাভাগি নিয়ে তৈরি হয় আরেক সমস্যা। সরকারি কর্মচারীদের দেশ বেছে নেওয়ার সুবিধা ছিল অনেক সহজ। কিন্তু সেনাসদস্যদের বিষয়টি অত সহজ ছিল না। কারণ, ভারত বিভক্তি ঘটেছিল ধর্মের ভিত্তিতে।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, সেনাসদস্যরা দেশ বেছে নিতে পারবেন, তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত থাকবে। এই শর্ত ছিল এ রকম: একজন মুসলমান সৈন্য, যিনি পাকিস্তান অঞ্চলের সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন, তিনি ভারতীয় এলাকার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবেন না। অন্যদিকে ভারতীয় এলাকার সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন কিন্তু মুসলমান নন, এমন কোনো সেনাসদস্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবেন না।
ফিল্ড মার্শাল ক্লড অচিনলেকের তত্ত্বাবধানে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভক্তি ঘটে। ভারত পায় ২ লাখ ৬০ হাজার সেনাসদস্য, আর পাকিস্তানের ভাগে পড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার সৈন্য। আজ দুই দেশের সেনাবাহিনীর বিপুল বিস্তার ঘটেছে এবং দুটো দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী।