বিশ্বের শীর্ষ ধনীরা বিভিন্ন খাতে ব্যবসা করেন। ফোর্বস ম্যাগাজিনে তাঁদের সম্পদ ও ব্যবসায়িক প্রভাব নিয়ে তথ্য পাওয়া যায়। এই ম্যাগাজিনে শুধু ব্যক্তিগত সম্পদের তালিকা পাওয়া যায় না, বরং খাতভিত্তিক শীর্ষ ধনীদেরও পরিচয় পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফ্যাশন খাতে ব্যবসা করে বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে আছেন ফ্রান্সের বার্নার্ড আর্নল্ট। সম্মিলিত ধনীর তালিকায় তাঁর অবস্থান পঞ্চম। ফ্যাশন ও খুচরা বিক্রয় খাতের এই দিকটি তুলে ধরে বোঝা যায়, কীভাবে এই শিল্প অর্থনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখন দেখা যাক ফ্যাশন ও খুচরা খাতে ব্যবসা করে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় কারা স্থান পেয়েছেন।
বার্নার্ড আর্নল্ট বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিলাসপণ্য সাম্রাজ্যের কর্তা। তাঁর এলভিএমএইচের অধীনে আছে লুইই ভিটন ও সেফোরাসহ ৭৫টি নামকরা ব্র্যান্ড। ২০২১ সালে তিনি ১৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে টিফানি অ্যান্ড কোম্পানি কিনে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিলাসপণ্য অধিগ্রহণ সম্পন্ন করেন। তাঁর পারিবারিক কোম্পানি আগাশ, আগলা ভেঞ্চার্সের মাধ্যমে নেটফ্লিক্স ও বাইটড্যান্সে বিনিয়োগ করেছে। নির্মাণ ব্যবসা থেকে পাওয়া পুঁজিতে ১৯৮৪ সালে ১৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে তিনি ক্রিশ্চিয়ান ডিওর কেনেন—সেখান থেকেই সাম্রাজ্যের সূচনা। পাঁচ সন্তানই এখন এলভিএমএইচ–এ যুক্ত।
স্পেনের আমানসিও ওর্তেগা বিশ্বের শীর্ষ ধনী পোশাক ব্যবসায়ীদের একজন। সাবেক স্ত্রী রোসালিয়া মেরার সঙ্গে ১৯৭৫ সালে তিনি ইন্ডিটেক্স প্রতিষ্ঠা করেন—এই ব্র্যান্ডের অধীনে জারা, ম্যাসিমো দুত্তি ও পুল অ্যান্ড বেয়ারসহ ৮টি ব্র্যান্ড ও ৫ হাজার দোকান আছে। ২০২২ সালে মেয়ে মার্তা ওর্তেগা পেরেস কোম্পানির চেয়ারপারসন হন। ওর্তেগা প্রতিবছর ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০ কোটি ডলারের বেশি আয় করে। এই অর্থ মূলত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার আবাসন খাতে বিনিয়োগ করেন তিনি।
ওয়ালমার্টের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়ালটনের জ্যেষ্ঠ সন্তান রব ওয়ালটন। ১৯৯২ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ২০১৫ সালে তিনি অবসর নেন এবং জামাতা গ্রেগ পেনার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ২০২৪ সালে ওয়ালমার্টের পরিচালনা পর্ষদ থেকেও ওয়ালটন অবসর নেন। স্যাম ওয়ালটনের উত্তরাধিকারীরা সম্মিলিতভাবে ওয়ালমার্টের প্রায় ৪৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ২০২২ সালে ওয়ালটনের নেতৃত্বে একটি দল ৪৭০ কোটি ডলারে এনএফএল দল ডেনভার ব্রঙ্কোস কিনে নেয়। ২০২৩ সালে তিনি দলের নিয়ন্ত্রণমূলক মালিকানা জামাতা গ্রেগ পেনারের হাতে তুলে দেন।
ওয়ালমার্টের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়ালটনের কনিষ্ঠ পুত্র জিম ওয়ালটন। ধনীতদের সামগ্রিক তালিকায় তাঁর অবস্থান ১২তম। তিনি পরিবারের আরভেস্ট ব্যাংক গ্রুপের চেয়ারম্যান। এক দশকের বেশি সময় ওয়ালমার্টের পরিচালনা পর্ষদে থাকার পর ২০১৬ সালে তিনি পুত্র স্টুয়ার্টের জন্য জায়গা ছাড়েন। ওয়ালটন পরিবার সম্মিলিতভাবে ওয়ালমার্টের প্রায় ৪৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক। তাঁর কন্যা অ্যানি প্রোয়েতি পরিবারের ৭.১ বিলিয়ন ডলারের ওয়ালটন ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী নারী অ্যালিস ওয়ালটন। সামগ্রিক তালিকায় ১৫তম। টানা এক দশকে ৯ বার তিনি শীর্ষ ধনী নারীর তালিকায় ছিলেন। অ্যালিস ওয়ালটনের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৮০ কোটি ডলার। ফলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ১৫তম ধনী ব্যক্তি এবং আমেরিকার প্রথম নারী ‘সেন্টিবিলিয়নিয়ার’ (অর্থাৎ যাঁর সম্পদের হিসাব ১২ অঙ্কের)। গত বছর তিনি ফ্রান্সের কোম্পানি লরিয়েলের উত্তরাধিকারী ফ্রাঁসোয়াজ বেটেনকোর্ট মেয়ার্সকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী হন।
ফ্রাঁসোয়া বেতনক্যুঁ মেয়ার্স’ লরিয়ালের প্রতিষ্ঠাতার নাতনি। তিনি ও তাঁর পরিবার এই সৌন্দর্য পণ্যের কোম্পানির এক–তৃতীয়াংশের বেশি শেয়ারের মালিক। সামগ্রিক তালিকায় তাঁর স্থান ২০তম। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি ল’রিয়ালের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন তিনি। ২০২৫ সালে অবসরের ঘোষণা দেন। ২০১৭ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি ফ্রান্সের ল’রিয়ালের উত্তরাধিকারী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তাঁর মা লিলিয়ান একসময় বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী ছিলেন। ২০১৯ সালের অগ্নিকাণ্ডের পর ফ্রান্সের নটরডেম গির্জা সংস্কারে ল’রিয়াল ও বেটেনকোর্ট পরিবার যৌথভাবে ২২৬ মিলিয়ন বা ২২ কোটি ৬০ লাখ ডলার অনুদান দেয়।
তাদাশি ইয়ানাই জাপানের পোশাক ব্র্যান্ড ইউনিক্লোর স্রষ্টা ও ফাস্ট রিটেইলিং সাম্রাজ্যের কর্ণধার। টোকিও–ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটির অধীনে আছে থিওরি, হেলমুট ল্যাং, জে ব্র্যান্ড ও জিইউর মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। ২০২৪ অর্থবছরে কোম্পানির আয় দাঁড়ায় ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার—মুনাফা ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ২৫০ কোটি ডলার। বিশ্বের ২৫টি দেশে ইউনিক্লোর প্রায় আড়াই হাজার দোকান আছে। ইয়ানাইয়ের স্বপ্ন, ফাস্ট রিটেইলিংকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক বিক্রেতা হিসেবে গড়ে তোলা। এইচঅ্যান্ডএম ও জারার মূল কোম্পানি ইন্ডিটেক্সকেও পেছনে ফেলা যার মূল লক্ষ্য।
ডিটার শ্বর্জের শ্বর্জ গ্রুপের বার্ষিক আয় ১৬০ বিলিয়ন বা ১৬ হাজার কোটি ডলারের বেশি। সামগ্রিকভাবে তিনি বিশ্বের ৩৭তম শীর্ষ ধনী। কফল্যান্ড ও লিডল সুপারমার্কেটের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রথম লিডল স্টোর খুলে ১৯৭৭ সালে সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেন শ্বর্জ। ইউরোপের সবচেয়ে বড় খুচরা ব্যবসার সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তিনি। এই সাম্রাজ্যের কর্মী ৫ লাখ। ২০১৭ সালে লিডল মার্কিন বাজারে প্রবেশ করে। ফাউন্ডেশন মালিকানাধীন হলেও ডিটারের হাতেই এর মূল নিয়ন্ত্রণ।
লুকাস ওয়ালটন ওয়ালমার্টের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ওয়ালটনের নাতি। তিনি বিশ্বের ৪২তম শীর্ষ ধনী। ২০০৫ সালে বাবা জন ওয়ালটন বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলে তিনি বিশাল সম্পদের উত্তরাধিকারী হন। বাবার সম্পদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পান তিনি; মা ক্রিস্টি ওয়ালটনের অংশ প্রায় এক-ষষ্ঠমাংশ। তিনি ওয়ালমার্ট ও পরিবারের ২৭ বিলিয়ন ডলারের আরভেস্ট ব্যাংক গ্রুপের শেয়ারের মালিক হলেও কোনো কোম্পানিতে কাজ করেন না। ২০২১ সালে তিনি বিল্ডার্স ভিশন প্রতিষ্ঠা করেন। টেকসই উন্নয়ন ও দাতব্য বিনিয়োগের মাধ্যমে তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের বেশি অনুদান দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।
অ্যালেন ভের্টহাইমার ফ্রান্সের বিলাসবহুল ব্র্যান্ড চ্যানেলের চেয়ারম্যান এবং বিশ্বের ৪৬তম শীর্ষ ধনী। ভাই জেরার্ডের সঙ্গে এই কোম্পানির দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর ভাই ঘড়ি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। কোম্পানিটি তাঁর দাদু পিয়েরে ভের্টহাইমার কো কো চ্যানেলের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চ্যানেলের সৃজনশীল পরিচালক কার্ল লাগারফেল্ড ছিলেন কোম্পানিটির সম্মুখ সারির মুখ। তিনি ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৮৫ বছর বয়সে মারা যান; তিনি ৩৫ বছরের বেশি সময় কোম্পানির মুখ্য সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেখা যাচ্ছে, এই তালিকায় ওয়ালটন পরিবারের সদ্যসরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১০ জনের মধ্যে ৪ জনই এই পরিবারের। উত্তরাধিকার, পরিবারভিত্তিক ব্যবসা, বৈশ্বিক সম্প্রসারণ এবং বহুবিধ ব্র্যান্ড ও খাতের অধিগ্রহণের মাধ্যমে এই ধনীদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকে শুধু ব্যবসা চালাচ্ছেন না, বরং দাতব্য, টেকসই বিনিয়োগ আর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয়। ফলে ফ্যাশন ও খুচরা বিক্রয় খাত বিশ্বের ধনীদের সমৃদ্ধি এবং প্রভাবের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।