সুরাট ডায়মন্ড বোর্স
সুরাট ডায়মন্ড বোর্স

বিশ্ব বাণিজ্য

পেন্টাগনকে পেছনে ফেলল ভারতের হীরার বাজার সুরাট

বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা প্রক্রিয়াজাতের বাজার ভারতকেন্দ্রিক। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটের শহর সুরাটকেন্দ্রিক এ হীরার বাজার। এই সুরাটেই বিশ্বের ৬৫ শতাংশের বেশি হীরা কাটিং ও পলিশিং করা হয়।

হীরা প্রক্রিয়াজাতের জন্য সারা বিশ্বে সুরাটের বিশেষ নামডাক রয়েছে। ৬০ বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এই শহরের সব হীরার কারখানাকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসতে গড়ে তোলা হয়েছে সুরাট ডায়মন্ড বোর্স বা সুরাট হীরার বাজার নামের বিশাল এক কেন্দ্র বা হাব।

আয়তনের দিক থেকে যা যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অফিস কমপ্লেক্সের তালিকায় নাম লিখিয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে হীরা রপ্তানির বাজার ছিল ১১৯ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের (১ বিলিয়নে ১০০ কোটি)। এর মধ্যে অমসৃণ হীরার বাজার ৪৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের। মসৃণ হীরা বা প্রস্তুত হীরার বাজার ৭৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের।

বিশ্বের মসৃণ হীরার রপ্তানি বাজারের ৩১ শতাংশ ভারতের দখলে। ২০২১ সালে দেশটি ২৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারের মসৃণ হীরা রপ্তানি করে। এরপরের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের। এই পাঁচটি দেশ মোট মসৃণ হীরার ৮২ শতাংশই রপ্তানি করে।

আবার হীরাসহ মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি গয়নার বাজারও বেশ বড়। ২০২১ সালে বিশ্বে হীরার গয়নার বাজার ছিল ৯ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের।

সুরাটের আগে ভারতের হীরার বাজার ছিল মূলত মুম্বাইয়ের বান্দ্রাকেন্দ্রিক। তবে বান্দ্রায় বাণিজ্যিক জায়গা পেতে  ভাড়া গুনতে হয় অনেক বেশি। তা ছাড়া মুম্বাইয়ের ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ সুরাট থেকেই হীরার কাজ করিয়ে এনে মুম্বাইয়ে ব্যবসা করতেন। তাতে সময়ের পরিক্রমায় হীরার বাজার মুম্বাই থেকে সুরাটমুখী হয়ে ওঠে।

এখন বিশাল এ বাজারকে আরও সংগঠিত করতে ৩ হাজার ২০০ কোটি রুপি ব্যয়ে গড়ে তোলা হয়েছে নয়টি বহুতল ভবনের বিশাল এক কমপ্লেক্স। ৩৫ দশমিক ৫৪ একরের ওপর প্রতিষ্ঠিত এই হীরার সাম্রাজ্যে বাণিজ্যিক জায়গা রয়েছে ৬৭ লাখ বর্গফুট। যেখানে দেশীয়-আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের জন্য সাড়ে ৪ হাজারের বেশি কার্যালয় তৈরির সুযোগ রয়েছে।

এ কমপ্লেক্সের ১৫ তলাবিশিষ্ট ৯টি ভবন নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। আর নির্মাণকাজ শেষ হয় গত বছর।

সুরাট ডায়মন্ড বোর্সের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, এই কমপ্লেক্সে ৩০০ থেকে ৭৫ হাজার বর্গফুটের কার্যালয় নিতে পারবেন হীরার ব্যবসায়ীরা। ধারণা করা হচ্ছে, কমপ্লেক্সটি পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু হলে তাতে প্রায় দেড় লাখ লোকের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হবে। যাতায়াতের সুবিধার্থে পুরো কমপ্লেক্সে রয়েছে ১৩০টি লিফট।

গত মার্চে পঞ্চমবারের মতো এ হীরার রাজ্যে নিলামের মাধ্যমে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেখানে ৫০০ বর্গফুটের নিচে বাণিজ্যিক জায়গার জন্য অগ্রিম দিতে হয়েছে ৫ লাখ রুপি। আর ৫০০ থেকে ১ হাজার বর্গফুটের জন্য দিতে হয়েছে ১০ লাখ রুপি। ১ হাজার বর্গফুটের বেশি জায়গার জন্য দিতে হয়েছে ২০ লাখ রুপি।

শুধু বাণিজ্যিক জায়গা নয়, গাড়ি রাখার জন্যও সেখানে জায়গা পেতে অনলাইনে নিলামে অংশ নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এ কমপ্লেক্সে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য আছে ২০ লাখ বর্গফুট জায়গা।

ভারত সরকার সুরাটে শুধু এই হীরার বাজার গড়ে তুলেই থেমে থাকছে না, বৈশ্বিক হীরার বাজারে আধিপত্য ধরে রাখতে নিয়েছে আরও বড় প্রকল্প।

সুরাট ডায়মন্ড বোর্সকে কেন্দ্র করে ডায়মন্ড রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেন্টাইল (ড্রিম) প্রজেক্ট নামের এই প্রকল্প গড়ে উঠবে প্রায় ২ হাজার একর জমির ওপর। যেখানে আবাসিক এলাকা, হোটেল ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

ভারতে প্রক্রিয়াজাত হীরা ছাড়াও ল্যাবরেটরিতে তৈরি হীরার (ল্যাব-গ্রোন ডায়মন্ড) সম্ভাবনা দেখে উদ্যোক্তারা এই ব্যবসায়ে ঝুঁকছেন। আর সরকারও তাতে নীতি-সহায়তা দিচ্ছে।

বিংশ শতাব্দীতে ল্যাবরেটরিতে হীরা তৈরির কাজ শুরু হলেও প্রথম দিকে তা খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। গত ১০ বছরে এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। তাতে হীরা দিয়ে নানা ধরনের অলংকার তৈরির প্রবণতাও দিন দিন বাড়ছে।

দেশের হীরার বাজার যেমন

বাংলাদেশে হীরার কোনো খনি নেই। উৎপাদনও হয় না। তারপরও আমদানি করা এই রত্নের বেচাকেনা বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার।

ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে হীরা আমদানির সুযোগ নেই। তবে গত ১৯ বছরে দেশে যত হীরা আমদানি হয়েছে, তার ৮৭ শতাংশই এসেছে ভারত থেকে। খুব সহজে বহন করা যায় বলে দেশটি থেকে অবৈধভাবে হীরা আসছে বলে ধারণা ব্যবসায়ীদের।

দেশের হীরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, স্বর্ণের মতো শুল্ক ফাঁকি দিতে চোরাই পথে ভারত থেকে হীরা আসে। আবার আসল হীরার নামে বিক্রেতারা যেসব হীরা বিক্রি করছেন, তার একটা বড় অংশই পরীক্ষাগারে তৈরি নকল হীরা। হীরার মতো দেখতে মোজা নাইট কিংবা জারকান পাথরও বিক্রি হচ্ছে আসল হীরার নামে।

দেশে মূল্যবান গয়নার বাজার এখনো স্বর্ণনির্ভর। দুই দশক আগে হীরার গয়নার দোকান চালু হলেও শুরুতে উচ্চবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই বাজার।

পাঁচ বছর ধরে হীরার গয়নার বেচাকেনা বেড়েছে। সোনার মতো হীরাও ব্যবহারের পরে পুনরায় বিক্রির সুযোগ দেয় দেশীয় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো।