ধরা যাক, বিশ্বের যেকোনো দেশে মুদ্রার ৯৫ শতাংশ দরপতন হয়েছে। সেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কী হতে পারে? নিদেনপক্ষে চাকরি তো যাবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননে তা হয় না।
২০২১ সালে ডলারে বিপরীতে লেবাননের মুদ্রা পাউন্ডের মান ২৭ হাজার ৫০০-তে নেমে আসে। সেই পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এবার কি গভর্নরকে সরিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। জবাবে নাজিব পরিষ্কার বলেন, ‘যুদ্ধের সময় কেউ কর্মকর্তা বদলায় না।’
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধ এখনো চলছে। তবে লেবাননের রাজনীতিবিদেরা বোধ হয় নিজেদের সীমা দেখে ফেলেছেন। ২০১৮ সালের পর অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ৪০ শতাংশ। ১ ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১৫ হাজার লেবাননি পাউন্ড। কিন্তু মুদ্রার আরও দরপতন হয়েছে; ডলারের বিপরীতে এর মান ৯০ হাজারের নিচে নেমেছে।
তিন দশক দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর থাকার পর ৩১ জুলাই চাকরি খুইয়েছেন রিয়াদ সালামেহ। এখন পর্যন্ত অবশ্য তাঁর বদলে স্থায়ীভাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি সালামেহর মেয়াদ বাড়াতে রাজি হননি।
ভক্ত–সমর্থকেরা একসময় সালামেহকে জাদুকর আখ্যা দিতেন। কারণ, এক অস্থিতিশীল দেশে তিনি মুদ্রার মান স্থিতিশীল রেখেছিলেন। কিন্তু সব জাদুকরের মতো তিনিও চাইতেন, দর্শকেরা যেন তাঁর জারিজুরি বুঝতে না পারে, অর্থাৎ তাঁরা যেন দূরে থাকেন। তাঁর গল্প কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও অসম্মানের নয়, বরং সেই গল্প এমন এক দেশের, যে দেশের রাজনীতিবিদেরা নীতির দায়িত্ব নিতে চান না।
লেবাননের গৃহযুদ্ধোত্তর প্রথম প্রধানমন্ত্রী রফিক হারারি ১৯৯৩ সালে সালামেহকে নিয়োগ দেন। তাঁরা দুজন মিলে বিদেশি সহায়তা ও বিনিয়োগনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলেন। এর মধ্য দিয়ে তারা বাজেট–ঘাটতি মোকাবিলা করে মুদ্রার মানও ধরে রাখেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে দেখা গেছে, দেশটির ব্যাংক খাতে জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের চার গুণ আমানত ছিল।
তবে ২০১৫ সালের দিকে সেই ধারায় ছেদ পড়ে। মূলত আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও তেলের দাম কমে যাওয়ার কারণে বিদেশি সহায়তা ও বিনিয়োগে ভাটা পড়ে। বিদেশি অর্থপ্রবাহ সচল রাখতে সালামেহ ফাইন্যান্সিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বা আর্থিক খাতে নানা ধরনের কলাকৌশল শুরু করেন। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলারে ঋণ করতে বাজারের চেয়ে বেশি সুদ দেয় লেবাননের কেন্দ্রীয় ব্যাংক; বিনিময়ে আমানতাকারীদেরও চড়া সুদ দেওয়া হয়।
কিছু সময়ের জন্য সবাই এতে খুশি ছিল—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধির সঙ্গে ব্যাংক ও আমানতকারী উভয়ই ভালো মুনাফা পেয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা কোনো প্রশ্ন করেননি। সালামেহর এক সহকর্মী দ্য ইকোনমিস্টকে বলেন, রিয়াদ সালামেহ কখনোই তাঁর এই কলাকৌশল নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কমিটিতে আলোচনা করেননি; সংসদও বিষয়টি খতিয়ে দেখেনি।
২০১৮ সালে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ এ নিয়ে সতর্কবাণী দেন। সালামেহ তখন কাব্যিক ভাষায় বলেন, পাউন্ড অনেক ভালো অবস্থানে আছে, লেবানীয় ভাষায় ‘আলফ খায়ের’। দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁর কথায় আস্থা রাখেন।
কিন্তু এক বছর পরেই লেবাননের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমানত কমতে থাকে। পুরোনো দায় মেটাতে গিয়ে নতুন অর্থের সংকট সৃষ্টি হয়। ২০১৯ সালে এসে সালামেহ নিজেও আর মুখোশ ধরে রাখতে পারেননি; ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের মান ১ হাজার ৫০০ থেকে নিচে নেমে যায়। তখন এক টেলিভিশন সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, এর শেষ কোথায়? জবাবে তাঁর কণ্ঠে অনিশ্চয়তার সুর শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘কেউ জানে না, এর শেষ কোথায়।’
এরপরও রিয়াদ সালামেহকে কেউ সরানোর সাহস দেখায়নি। লেবাননের রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও গণমাধ্যমের অভিজাতবর্গের সঙ্গে তিনি সখ্য গড়ে তুলেছিলেন; সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মতো দেশের পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলেন তিনি। মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ থেকে শুরু করে নীতির সব ক্ষেত্রেই তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন।
তাঁর পদক্ষেপের কারণে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ২০১৮ সালে যেখানে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার, পরে তা নেমে আসে ১০ বিলিয়ন ডলারে এবং দেশটির মুদ্রার মানে ধস নামে।
কালোবাজারে মুদ্রার উত্থান-পতন ঠেকাতে রিয়াদ সালামেহ ইলেকট্রনিক ফরেন এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন। এটা ছিল ব্যাংক, আমদানিকারক ও ধনী মানুষের জন্য একরকম উপহার। এই প্ল্যাটফর্মে লেবাননের মুদ্রার মান কালোবাজারের চেয়ে সব সময় ২০ শতাংশ কম ছিল। এর সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা ছাড়ে ডলার কিনে সমান্তরাল বাজারে বিক্রি করে দিতেন। এই প্রক্রিয়ায় ২৫০ কোটি ডলার মুনাফা করেছে মানুষ, তাতে ক্ষতি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এবং পরিণামে অর্থনীতির।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মতো লেবাননে গত অক্টোবর মাস থেকে প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতিও নেই। সেই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের পদও খালি। দেশটি ধসে পড়ছে, কিন্তু তার দায়িত্ব কারও হাতে নেই।
তবে সালামেহ যে আরামে অবসরজীবন যাপন করবেন, সেই সম্ভাবনা কম। বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি ও লুক্সেমবার্গ ও সুইজারল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে। অভিযোগ, তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৩৩ কোটি ডলার লোপাট করে দিয়েছেন। তদন্তকারীদের অভিযোগ, এই অর্থের একটি অংশ তাঁর ভাইয়ের সুইস ব্যাংক হিসাবে জমা পড়েছে এবং বাকি অর্থ ইউরোপে সম্পদ কেনায় ব্যবহৃত হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, এ বছরের মার্চ মাসে এক ফরাসি আদালত সালামেহর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন, কারণ তিনি শুনানিতে হাজির হতে পারেননি। জার্মানিও তাঁর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে নোটিশ জারি করেছে। তবে লেবাননের আইনে নাগরিকদের বিদেশি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার বিধান নেই।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, লেবাননের বিচার বিভাগ এতটা রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট যে দেশে তাঁর বিচার হবে না। তবে তিনি নিন্দিত মানুষ বলেই মনে করেন তাঁর এক সাবেক সহকর্মী। বিচার না হলে শেষ জাদু হিসেবে তিনি লাপাত্তা হয়ে যেতে পারেন।