‘বিনিয়োগগুরু’ বাফেট না থাকলে কে চালাবেন বার্কশায়ারের প্রচারকাজ

  • বাফেট শুধু বিনিয়োগকারীই নন, বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সবচেয়ে কার্যকর প্রচারকও ছিলেন।

  • বার্কশায়ারের বার্ষিক সভা পরিণত হয়েছে বিশাল কেনাকাটার উৎসবে।

ওয়ারেন বাফেটের খ্যাতি মূলত বিনিয়োগকারী হিসেবে। বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের শীর্ষ পদে বসে বিনিয়োগ বিষয়ে তিনি যে প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন, তা অনেকের কাছেই অমৃতবচনের মতো। তবে এটাই তাঁর একমাত্র ভূমিকা নয়। তিনি একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে দক্ষ প্রচারকও। ফলে তাঁর অবসরের প্রাক্কালে প্রশ্ন উঠেছে—এই জায়গা কে পূরণ করবেন।

বার্কশায়ারের বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) কথাই ধরা যাক। এ সভাকে ঘিরে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তুঙ্গে থাকে। কারণ, এ সভায় যেমন আর্থিক পরামর্শ পাওয়া যায়, তেমনি বড় ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ার বিরল সুযোগও তৈরি হয়। তবে সভাটির আরেকটি দিক তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত—এটি কার্যত এক বিশাল কেনাকাটার উৎসব।

‘বার্কশায়ার বাজার অব বার্গেনস’ নামে পরিচিত এই আয়োজন বার্ষিক সভার সময় শুধু শেয়ারহোল্ডারদের জন্য অনুষ্ঠিত হয়, যা এত দিনে যেন বার্ষিক সভার সমার্থক হয়ে উঠেছে। বাফেটের চিন্তার আলোকে গড়ে ওঠা এই বিশাল ক্রয়যজ্ঞে বার্কশায়ারের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য একসঙ্গে প্রদর্শিত হয়। পণ্যের তালিকাও নেহাত কম নয়।

কোম্পানির ভাষ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি চলতি ২০২৫ সালের বার্ষিক সভায় শেয়ারহোল্ডারদের জন্য প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে ৫০ হাজার পণ্যের মজুত সাজানো হয়েছিল, যেখানে বার্কশায়ারের ভান্ডারে থাকা পণ্যগুলো প্রদর্শিত হয়।

এ আয়োজনে থাকে বিশালাকৃতির মাসকট ও নানা ধরনের পণ্যের সমারোহ। যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্যের এই বিলিয়নিয়ার ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে এসব পণ্য ও মাসকটের সঙ্গে ছবি তুলতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে বাজারে বিক্রি হওয়া অনেক মজাদার বা উদ্ভট পণ্যের গায়ে বারবার ভেসে ওঠে ওয়ারেন বাফেটের হাসিমুখ—অনেক ক্ষেত্রেই পাশে থাকে তাঁর প্রয়াত ছায়াসঙ্গী চার্লি মাঙ্গার। যেন পুরো বাজারটাই একধরনের বাফেট–মাঙ্গার স্মারক দোকান।

আর কয়েক দিনের মধ্যেই বার্কশায়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও) পদ থেকে বিদায় নেওয়ার কথা বাফেটের। সে জন্য বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের সবচেয়ে পরিচিত ‘মুখ’—বা সবচেয়ে বড় মাসকট—হিসেবে তাঁর ভূমিকার দিকেই ফিরে তাকানো যাক।

স্কুইশম্যালো

যাঁদের ঘরে শিশু আছে—অথবা যাঁরা বড় হয়েও শিশুসত্তা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারেননি—তাঁদের কাছে স্কুইশম্যালো অপরিচিত নয়। ডিমের মতো গোলগাল, নরম-তুলতুলে এই খেলনাগুলো অল্প সময়েই খেলনার বাজারে একধরনের উন্মাদনা তৈরি করেছে। মজার বিষয় হলো এই খেলনাগুলোও শেষ পর্যন্ত বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের পোর্টফোলিওতে জায়গা করে নিয়েছে।

পথটি অবশ্য মসৃণ ছিল না। বার্কশায়ার ২০২২ সালে অ্যালেগানি নামের একটি কোম্পানি অধিগ্রহণ করে, যার অধীনে রয়েছে স্কুইশম্যালো প্রস্তুতকারক জ্যাজওয়্যারস। করপোরেট অধিগ্রহণের সেই প্রক্রিয়ায় স্কুইশম্যালো বার্কশায়ারের বিশাল ছাতার নিচে চলে আসে। এখানে বিনিয়োগের কঠিন অঙ্ক আর নরম খেলনার কোমলতা অদ্ভুতভাবে একসঙ্গে মিশে যায়।

২০২৩ সালে প্রথমবার বাজারে আনা হয় স্কুইশম্যালো। সেবার বিশেষ চমক হিসেবে বাজারে আনা হয় ওয়ারেন বাফেট ও চার্লি মাঙ্গারের লাইফস্টাইল বা জীবনধারা অবলম্বনে তৈরি প্লাশ খেলনা। বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো হু হু করে বিক্রি হয়ে যায়। পরে অনলাইনে এসব খেলনার দাম ৪৫০ ডলার পর্যন্ত ওঠে।

সিজ ক্যান্ডিজ

নিজের পছন্দের পণ্যের প্রতি বাফেটের দুর্বলতা নতুন নয়। যে পণ্য তিনি নিজে পছন্দ করেন, তার মালিকানা নিতে তাঁর আগ্রহ বরাবরই ছিল। এই ইতিহাস দীর্ঘ। সিজ ক্যান্ডিজ তার একটি উদাহরণ। ১৯৭২ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে এই ক্যান্ডি কোম্পানিটি কিনে নেয়।

হাইঞ্জ

হাইঞ্জের সঙ্গে ওয়ারেন বাফেটের করপোরেট সম্পর্ক বহুদিনের। ২০১৩ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে ও থ্রিজি ক্যাপিটাল যৌথভাবে ২৮ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারে হাইঞ্জের অধিগ্রহণ করে। এর দুই বছর পর ২০১৫ সালে ক্রাফট ও হাইঞ্জের একীভূতকরণ সম্পন্ন হয়। ফলে উত্তর আমেরিকায় তৃতীয় বৃহত্তম খাদ্য কোম্পানির জন্ম হয়। তবে এই যৌথ যাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। চলতি বছর ক্রাফট ও হাইঞ্জ আবার আলাদা হয়ে যায় এবং দুটি প্রতিষ্ঠানই এখন পৃথকভাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত।

এই বিভাজন নিয়ে সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাফেট অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তবু বাস্তবতা হলো, এখনো ক্রাফট হাইঞ্জের সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার হলো বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে। হাইঞ্জ কেচাপের বোতল আর ক্রাফট ম্যাকারনি অ্যান্ড চিজের প্যাকেটে বাফেট ও মাঙ্গারের যুগল ছবি যেন সেই অটুট সম্পর্কেরই স্মারক।

জেল-ও মোল্ড

এই কোম্পানিতে খাদ্য সাম্রাজ্য ক্রাফট হাইঞ্জের মালিকানা রয়েছে।

ফ্রুট অব দ্য লুম

২০০১ সালে বার্কশায়ার ঘোষণা দেয়, তারা নগদ ৮৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারে ফ্রুট অব দ্য লুম কিনছে। সেই অধিগ্রহণের স্মারক হিসেবে বাজারে এসেছে বাফেট-থিমের বক্সার।

ব্রুকস রানিং

সবাই বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে চালাতে পারবে না, তবে অন্তত ব্রুকস রানিংয়ের জুতা পরে দৌড়ানো সম্ভব—বিশেষ করে যখন জুতার তলায় বাফেটের ছবি থাকে।

কোকা-কোলা

বার্কশায়ার কোকা-কোলার সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার। তাদের মালিকানায় রয়েছে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ শেয়ার। এই বিশেষ কোকা-কোলা ক্যানগুলো চীনা বাজারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে বাফেটের ছবি রয়েছে।

ডুরাসেল ব্যাটারি

বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে ২০১৬ প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বলের ডুরাসেল ব্যাটারি অধিগ্রহণ করে। অর্থাৎ ব্যাটারির ব্যবসায় প্রবেশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এই অধিগ্রহণের প্রচারটা বেশ অভিনব ছিল। সেটি হলো ডুরাসেল ব্যাটারি দিয়ে ওয়ারেন বাফেটের পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়।