
যুদ্ধ শুরুর আগে বিপিসি প্রতি ব্যারেল ডিজেল আমদানি করে ৭৬ দশমিক ৬৯ ডলারে। যুদ্ধের পর প্রতি ব্যারেল দাম পড়ছে ৮৩ দশমিক ৮৪ ডলার।
গত ১২ জুন রাত তিনটার দিকে ইরানে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। হামলার ঠিক এক দিন পর ৩৪ হাজার ৬১৭ টন ডিজেল বোঝাই একটি জাহাজ মালয়েশিয়া থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। চট্টগ্রামে এসে পৌঁছায় ১৮ জুন। যুদ্ধের প্রভাবে ওই এক জাহাজেই জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা।
পৃথিবীতে জ্বালানি তেলের দরদামের ক্ষেত্রে মোটা দাগে দুটি বাজার রয়েছে—সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসি। সংস্থাটি সিঙ্গাপুরের বাজারদরে তেল কেনে। দাম নির্ধারণ করা হয় সিঙ্গাপুরভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘প্ল্যাটস’-এর দর অনুযায়ী। যেদিন বিপিসির জন্য জাহাজে তেল ভর্তি (লোড) করা হয়, তার দুই দিন আগের দাম, সেই দিনের দাম ও তার পরের দুই দিনের দাম—মোট পাঁচ দিনের দাম গড় করে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম পরিশোধ করে বিপিসি।
বিপিসি সূত্র জানায়, ১৩ জুন এমটি পিভিটি আভিরাতে ৩৪ হাজার ৬১৭ টন পরিশোধিত ডিজেল ভর্তি (লোড) করা হয়। ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন এ তেল সরবরাহ করেছে। চট্টগ্রামে জাহাজটি এসে পৌঁছায় ১৮ জুন। ২২ জুন জাহাজ থেকে সব তেল খালাস করা হয়। জাহাজটি যেদিন লোড হয় (১৩ জুন), সেদিন থেকেই ডিজেলের দাম বাড়তে থাকে।
প্ল্যাটসের দর অনুযায়ী, ১১ জুন ডিজেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেলে ৭৯ দশমিক ২৪ মার্কিন ডলার, ১২ জুন ৮১ দশমিক ৩৭ ডলার। সংঘাত শুরু হওয়ার পর এই দাম এক লাফে ৪ ডলার বেড়ে যায়। ১৩ জুন দাম পৌঁছায় ৮৫ ডলারে। এরপর ১৪ ও ১৫ জুন দাম প্রকাশিত হয়নি। তবে ১৬ জুন দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ দশমিক ৭৮ ডলারে। আর ১৭ জুন ৮৬ দশমিক ৭৯ ডলারে প্রতি ব্যারেল ডিজেল বিক্রি হয়েছে।
বিপিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পাঁচ দিনের দর গড় করে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম পড়েছে ৮৩ দশমিক ৮৪ ডলার। সেই হিসাবে ৩৪ হাজার ৬১৭ টন বা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯৪৯ ব্যারেল ডিজেলের দাম পড়ে প্রায় ২ কোটি ১৬ লাখ ২৬ হাজার ৪৪৪ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ২৬৫ কোটি টাকা। সাধারণত তেল খালাসের এক মাসের মধ্যে এ দাম পরিশোধ করতে হয়।
তবে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুরু হওয়ার আগে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম আরও কম ছিল। সংঘাত শুরুর আগে সর্বশেষ বিপিসির জন্য তেলবাহী জাহাজটি এসেছিল ৭ জুন। এমটি সিওয়েস টাইটান নামের জাহাজে ১০ হাজার ৮৬ টন ডিজেল লোড করা হয়েছিল ২ জুন। মালয়েশিয়া থেকে ডিজেল নিয়ে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। ওই জাহাজে তেল সরবরাহ করেছে ইউনিপেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
প্ল্যাটসের দর অনুযায়ী, যুদ্ধের আগে ২৯ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত পাঁচ দিনের গড় দরের ভিত্তিতে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম পড়েছিল ৭৬ দশমিক ৬৯ ডলার। তার মানে সংঘাতের কারণে ব্যারেলপ্রতি ডিজেলের দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ১৫ ডলার।
বিপিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ১৮ জুন ডিজেল এসেছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৯৪৯ ব্যারেল। সংঘাত শুরুর আগে জাহাজটি এলে এই তেলের জন্য খরচ হতো ১৯৭ কোটি টাকা (প্রতি ব্যারেল ৭৬ দশমিক ৬৯ ডলার ধরে)। তবে সংঘাতের পর জাহাজে তেল লোড হওয়ায় খরচ হচ্ছে ২৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ যুদ্ধের কারণে এক জাহাজে ৬৮ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিপিসির পরিচালক এ কে এম আজাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংঘাত শুরুর আগে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ছিল ৭৬ থেকে ৭৯ ডলারের মধ্যে। কিন্তু ১৩ জুন থেকেই ডিজেলের দাম বাড়তে থাকে। সর্বশেষ যে জাহাজটি এসেছে, সেটিতে বাড়তি খরচ হয়েছে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা।
তেলের দাম কত বাড়ছে
দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে বেশি চাহিদা ডিজেলের। কৃষি, শিল্প উৎপাদন ও পরিবহন খাতে এ তেল ব্যবহার হয়। তাই ডিজেলের দাম বাড়লে পণ্যের দামও বেড়ে যায়, বাড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়। প্ল্যাটসের দাম বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা শুরুর আগে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম ছিল। ১ থেকে ১১ জুন পর্যন্ত তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৭৬ থেকে ৭৯ ডলারের মধ্যে। ১২ জুন গভীর রাতে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানে হামলা শুরু হয়। এর পরদিন থেকে ডিজেলের দাম বাড়তে থাকে। ১২ জুন ডিজেলের প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল ৮১ দশমিক ৩৭ ডলার। ২০ জুন তা বেড়ে হয় ৯৩ দশমিক ১৬ ডলার। গতকাল মঙ্গলবার সেটি নেমে আসে ৮২ ডলারে। তবে জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে প্রতি ব্যারেলে ১১ ডলার, অকটেন প্রতি ব্যারেলে ৯ ডলার, ফার্নেস তেল প্রতি টনে ৩৩ ডলার, মেরিন ফুয়েল প্রতি টনে ৫১ ডলার।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত শুরুর পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে। জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন আমাদের তেল আমদানিতে বাড়তি খরচ হচ্ছে।’