ই–কমার্সে বিশ্বের শীর্ষ ১০ কোম্পানি

ই-কমার্স শব্দটা এখন নাগরিক জীবনের অংশ হয়ে গেছে। ব্যস্ত নাগরিক জীবনের অনেক সমস্যার সহজ সমাধান দিচ্ছে ই-কমার্স। জামাকাপড় থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক পণ্য—কী পাওয়া যায় না ই-কমার্সে। ফলে মানুষ এখন ঘরে বসেই কেনাকাটা করতে পারছে।

শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই ই-কমার্স এখন ভোক্তাদের মধ্যে জনপ্রিয়। অ্যামাজনের মতো ই-কমার্স সারা বিশ্বেই পণ্য সরবরাহ করছে। ফলে দেশে-বিদেশের সীমানা অনেকটা ঘুচিয়ে দিয়েছে এই খাত।

এতে যেমন পণ্য উৎপাদকদের সুবিধা হয়েছে, তেমনি গ্রাহকদেরও সুবিধা হয়েছে। উৎপাদকদের পণ্য বিপণনে সুবিধা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভোক্তারা এক ছাদের নিচে অনেক পণ্য পেয়ে যাচ্ছেন। ছাড়ও মিলছে। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সারা বিশ্বে অনেক ই-কমার্স কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এই কোম্পানিগুলো অনেক বড়ও হয়েছে। দেখে নেওয়া যাক, বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম ১০টি ই-কমার্স কোম্পানি কোনগুলো:

অ্যামাজন, দেশ: যুক্তরাষ্ট্র, বাজার মূলধন: ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি ডলার

আজ পৃথিবীতে যে ই-কমার্সের বাড়বাড়ন্ত, তার পথ দেখিয়েছে অ্যামাজন। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অ্যামাজন অনলাইনে পণ্য সরবরাহ করে থাকে। অ্যামাজনের সহপ্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী। ১৯৯৪ সালে অনলাইনে বই বিক্রি দিয়ে তিনি এ ব্যবসা শুরু করেন। এখন এমন কোনো জিনিস নেই, অ্যামাজনে যা পাওয়া যায় না বললেই চলে। ই-কমার্সের পাশাপাশি ক্লাউড কম্পিউটিং, এআইসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে তারা। এ ছাড়া হোল ফুড ও আইএমডিবির মতো সাবসিডিয়ারি কোম্পানি আছে অ্যামাজনের। তাদের কর্মীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৪৬ হাজার।

আলিবাবা, দেশ: চীন, বাজার মূলধন: ৩৫ হাজার ৭৪০ কোটি ডলার

১৯৯৯ সালের জুন মাসে চীনের হাংঝৌ শহরের এক ছোট অ্যাপার্টমেন্টে আলিবাবার জন্ম হয়। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা প্রাথমিকভাবে ব্যবসায়ীদের পণ্য সরবরাহ করে ব্যবসা শুরু করেন। মূলত তিনি চীনের ছোট ব্যবসায়ীদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। এরপর ভোক্তাদের কাছেও পণ্য পৌঁছে দেওয়া শুরু করে আলিবাবা। একপর্যায়ে চীনের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ শুরু করে আলিবাবা। খুচরা বিক্রির পাশাপাশি আলিপের মাধ্যমে ডিজিটাল পেমেন্ট সেবার জগতে প্রবেশ করে আলিবাবা। এখন ক্লাউড সেবা, লজিস্টিকসসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে আলিবাবা। প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার কর্মীর এই কোম্পানি বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ব্যবসা করছে।

শপিফাই, দেশ: কানাডা, বাজার মূলধন: ২২ হাজার ৭৫ কোটি ডলার

আগের দুটি কোম্পানি বা অন্যান্য প্রথাগত অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্রের তুলনায় শপিফাই কিছুটা ভিন্ন। এর বিশেষ দিকটি হলো, এই কোম্পানি অন্যান্য অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন সহযোগিতা করে থাকে। ২০০৬ সালে কানাডার অটোয়াতে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি বিশ্বজুড়ে ৫৬ লাখ অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্রকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ক্লাউড সেবা থেকে শুরু করে পণ্যসামগ্রী ব্যবস্থাপনা, অর্থ পরিশোধ, পিওএস ব্যবস্থা, পণ্য পরিবহনসহ বিভিন্ন ধরনের অ্যাপের বিশাল ইকোসিস্টেম আছে তাদের। কোম্পানিটি ২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০২৪ সালে তাদের আয় হয়েছে ৮৮৮ কোটি ডলার।

পিডিডি হোল্ডিংস, দেশ: চীন, বাজার মূলধন: ১৫ হাজার ৫৪৬ কোটি ডলার

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের সাংহাইতে প্রতিষ্ঠিত হয় এই কোম্পানি। এই কোম্পানির বিশেষত্ব হলো, তারা যৌথ কেনাকাটার রীতি চালু করেছে। মূলত গ্রামাঞ্চল ও শহরের নিম্ন আয়ের মানুষদের লক্ষ্য করে তারা বিপণন করে থাকে। কৃষি ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি করে তারা।

চীনের বিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে পিডিডি। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের নাসডাক সূচকের তালিকাভুক্ত এই কোম্পানি উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সেবা দিয়ে থাকে। তারা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে। ২০১৮ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব ছাড়ার মাধ্যমে কোম্পানিটি ১৬০ কোটি ডলার সংগ্রহ করে। ২০২৪ সালে তাদের আয় হয়েছে ৫২ দশমিক ১২ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ২১২ কোটি ডলার।

মার্কাডো লিব্রে, দেশ: আর্জেন্টিনা, বাজার মূলধন: ১০ হাজার ১২৭ কোটি ডলার

মার্কাডো লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। ফিনটেক বা আর্থিক প্রযুক্তি খাতেরও অনেক বড় কোম্পানি তারা। ১৯৯৯ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস শহরে মার্কোস গ্যালপেরিন নামের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। শহরের এক গ্যারেজে এই কোম্পানির কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ব্রাজিল, মেক্সিকো, চিলিসহ ১৮টি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এই কোম্পানি। কোম্পানিটি ২০০৭ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। লাতিন আমেরিকার প্রথম প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নাসডাক সূচকের অন্তর্ভুক্ত হয় এই কোম্পানি। মূলত কোভিড-১৯-এর সময় এই কোম্পানির বাড়বাড়ন্ত হয়।

কারভানা, দেশ: যুক্তরাষ্ট্র, বাজার মূলধন: ৯ হাজার ৭৬০ কোটি ডলার

অনলাইন দোকান থেকে মানুষ সাধারণত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনে, কিন্তু কারভানা সে ক্ষেত্রে অনেকটাই ব্যতিক্রম। তারা বিক্রি করে গাড়ির মতো দীর্ঘস্থায়ী পণ্য। নতুন গাড়ি নয়, ব্যবহৃত পুরোনো গাড়ির পসরা সাজিয়েছে তারা। গাড়ি বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, সাত দিনের মধ্যে ফেরত নেওয়া ও অর্থায়নের মতো সুবিধাও তারা দিয়ে থাকে। এই কোম্পানির প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায়। কোম্পানিটি ২০১৭ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ২০২০ সালে মহামারির সময় তাদের বিক্রি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালের তাদের বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় মোট ৫৬০ কোটি ডলার। কিন্তু ২০২৩ সালে কোম্পানিটির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৫০ কোটি ডলার। তবে ২০২৪ সালেই তারা ঘুরে দাঁড়ায়। আয়ের ক্ষেত্রে নিট প্রবৃদ্ধি হয় ৪ শতাংশ।

মেইতুয়ান, দেশ: চীন, বাজার মূলধন: ৮ হাজার ৫২ কোটি ডলার

চীনে বেশ কিছু সুপার অ্যাপ আছে, যেসব অ্যাপ মানুষের জীবনের অনেক কিছুর সমাধান দিয়ে থাকে। মেইতুয়ান তেমন এক সুপার অ্যাপ। এই অ্যাপ দিয়ে খাদ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে স্থানীয় বিভিন্ন পরিষেবা, যেমন রেস্তোরাঁ অনুসন্ধান, আগাম সংরক্ষণ, ভ্রমণ ও হোটেলের কক্ষ আগাম সংরক্ষণ, বাইক শেয়ারিং ও জীবনযাপন–সংক্রান্ত আরও সেবা দেওয়া হয়।

সামগ্রিকভাবে চাপের মুখে আছে এই ই-কমার্স কোম্পানি। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি হলেও কোম্পানির মুনাফা কমেছে। তৃতীয় প্রান্তিকে তাদের বড় ধরনের ক্ষতিও হয়েছে। পণ্য সরবরাহ, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও গবেষণা-উন্নয়নে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

সি লিমিটেড, দেশ: সিঙ্গাপুর, বাজার মূলধন: ৭ হাজার ২২০ কোটি ডলার

২০০৯ সালে সিঙ্গাপুরে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি মূলত তিনটি খাতে কাজ করে। সেগুলো হলো ই-কমার্স, ডিজিটাল আর্থিক সেবা ও ডিজিটাল বিনোদন। তারা অনলাইনের জন্য বিভিন্ন গেম তৈরি করে থাকে। তাদের ই-কমার্স শাখা শপি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে প্রভাবশালী। ডিজিটাল আর্থিক সেবা কোম্পানির নাম মনি—ডিজিটাল ব্যাংকিং ও ঋণ সেবা দিয়ে থাকে এই কোম্পানি। বিনোদন কোম্পানির নাম গারেনা। ব্যবসা-বাণিজ্যের দক্ষতা বৃদ্ধিতে তারা এআই ও লজিস্টিক খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে মুনাফা ধরে রাখা তাদের এখন মূল লক্ষ্য।

জে ডি মল, দেশ: চীন, বাজার মূলধন: ৪ হাজার ২৫২ কোটি ডলার

জেডিডটকম চীনের অন্যতম বৃহৎ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এই মলের মাধ্যমে তারা মূলত অনলাইন ও অফলাইনের মিলন ঘটিয়েছে। ভোক্তারা সেখানে আসেন ইলেকট্রনিক, গৃহস্থালি পণ্য ও আসবাব দেখতে। সেখানে এসব পণ্য দেখার পর কিউআর কোড স্ক্যান করে ভোক্তারা অনলাইনে পণ্যের কার্যাদেশ দিতে পারেন। এসব দোকানের দৈর্ঘ্য ৩০ হাজার থেকে ৭০ হাজার বর্গফুট। এসব দোকানে দুই শতাধিক ব্র্যান্ডের পণ্য, থিমভিত্তিক প্রদর্শনের ব্যবস্থা ও রোবট আছে। চীনে এ ধরনের দোকান আছে ২৬টি। তারা দ্রুত গতিতে সম্প্রসারণ করছে।

কুপাং, দেশ: যুক্তরাষ্ট্র, বাজার মূলধন: ৪ হাজার ২৩৭ কোটি ডলার

কুপাং মূলত দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক কোম্পানি, যদিও এটি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। তারা মূলত দ্রুত পণ্য সরবরাহের জন্য বিখ্যাত। যেদিন পণ্যের কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে, সেদিন বা তার পরের দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয় কুপাং। মূল ধারার ই-কমার্সের সঙ্গে খাদ্য সরবরাহ, স্ট্রিমিং পরিষেবা, আর্থিক প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন সেবা দিয়ে থাকে এই কোম্পানি। সেই সঙ্গে বিলাসবহুল পণ্যের বড় বাজার হয়ে উঠেছে এই কোম্পানি। তাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে দ্রুত। সেই সঙ্গে তারা এখন গ্রাহকদের আরও উন্নত সেবা দিতে প্রযুক্তি উন্নয়নে ব্যয় করছে।

সূত্র: কোম্পানিসমার্কেটক্যাপডটকম