ব্যবসায় তিনটি বড় হুমকি দেখছেন দেশের সিইওরা

  • জরিপে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের ৩২ জন সিইও।

  • ৪৭% সিইও মনে করেন, ব্যবসা–বাণিজ্যে বড় হুমকি মূল্যস্ফীতি।

  • ৩৪% সিইও মনে করেন, ব্যবসা–বাণিজ্যে বড় হুমকি সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা।

ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আগামী এক বছর মূল্যস্ফীতি, সামষ্টিক অর্থনীতির অস্থিরতা ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাকে বড় হুমকি মনে করছেন দেশের বেসরকারি খাতের শীর্ষ নির্বাহীরা। তাঁরা বলছেন, প্রতিটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পর্কিত।

বৈশ্বিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের (পিডব্লিউসি) ২৬তম বার্ষিক বৈশ্বিক সিইও জরিপে ১০৫ দেশের ৪ হাজার ৪১০ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও অংশ নেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৩২ জন সিইও রয়েছেন। বৈশ্বিক জরিপের ফলাফল গত জানুয়ারিতে প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশ অংশটি গতকাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।

বৈশ্বিক জরিপে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ সিইও মনে করছেন, চলতি বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার কমবে। যদিও গত দুই বছরের জরিপে প্রধান নির্বাহীরা আশার কথা শুনিয়েছিলেন। ২০২১ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে ৭৬ ও ৭৭ শতাংশ প্রধান নির্বাহী বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে।

বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও মনে করেন, আগামী এক বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় হুমকি মূল্যস্ফীতি। 

পিডব্লিউসির সিইও জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনে করেন, আগামী এক বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় হুমকি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এ ছাড়া ৩৪ শতাংশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ২২ শতাংশ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতাকে বড় হুমকি মনে করছেন।

ইতিমধ্যে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। বিদ্যুৎ আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হয়েছে। নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। এসব কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। আবার ভূরাজনৈতিক অস্থিরতায় রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার উৎপাদনেও প্রভাব পড়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিরতাও বাড়ছে।

এসব চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্ধেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনে করেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে রূপান্তর না করলে আগামী ১০ বছর অর্থনৈতিকভাবে টেকসই থাকবে না তাঁদের প্রতিষ্ঠান। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুনত্ব আনার বিষয়ে মত দেন তাঁরা।

মুনাফা হ্রাসের কারণ হিসেবে ৬৯ শতাংশ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, গ্রাহকদের অগ্রাধিকার বদলে যাওয়াই প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, বিধিবিধান পরিবর্তন, শ্রমিক ও দক্ষতার সংকট, নতুন প্রতিযোগীর আবির্ভাব ও নতুন জ্বালানির ব্যবহার—এসব বিষয়ও বড় প্রভাব ফেলবে। যদিও ৬৯ শতাংশ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেছেন, ব্যবসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনা তাঁরা করছেন না। বরং দক্ষ ও মেধাবীদের ধরে রাখতে চেষ্টা করছেন তাঁরা।

দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আশাবাদও প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা। জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকের বেশি প্রধান নির্বাহী বলেছেন, স্বল্প (এক বছর) ও মধ্য মেয়াদে (তিন বছর) তাঁদের ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হবে।

দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত নিয়ে পিডব্লিউসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশ কয়েকটি তৈরি পোশাক কোম্পানি উদীয়মান দেশগুলোকে নতুন বাজার হিসেবে দেখছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। ফলে তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপ-আমেরিকায় বর্তমানে যে মন্দাভাব বিরাজ করছে, সেই ক্ষতি কিছুটা পোষানো সম্ভব হবে।

দেশের ৬৬ শতাংশ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মনে করেন, আগামী ১২ মাসে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার কমবে। তা সত্ত্বেও ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি হবে বলে মত দিয়েছেন ৫৩ শতাংশ সিইও।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পণ্য ও সেবার বহুমুখীকরণের মধ্য দিয়ে দেশের কোম্পানিগুলো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে। সেই সঙ্গে পরিচালন ব্যয় হ্রাস ও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মধ্য দিয়েও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে তারা। বেশির ভাগ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সচেতন। প্রতি পাঁচজনের চারজন সিইও বলেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে এসব করা শুরু করে দিয়েছেন।

দেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে খুব একটা উদ্বেগ নেই। যদিও আগামী এক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যবসার ব্যয় বাড়বে এবং সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে বলে মনে করেন তাঁরা।

পিডব্লিউসির বৈশ্বিক প্রতিবেদনে গত বছর প্রধান নির্বাহীদের উদ্বেগের মূল জায়গা ছিল সাইবার ও নিরাপত্তাঝুঁকি। এ বছর সেটি অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে; বরং অর্থনৈতিক শ্লথগতির প্রভাব কী হবে, তা নিয়ে প্রধান নির্বাহীরা উদ্বিগ্ন। স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে তাঁরা চিহ্নিত করেছেন মূল্যস্ফীতি ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে।

যথাক্রমে ৪০ ও ৩১ শতাংশ প্রধান নির্বাহী এ কথা বলেছেন। এর সঙ্গে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেছেন ২৫ শতাংশ প্রধান নির্বাহী। সাইবার নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলেছেন যথাক্রমে ২০ ও ১৪ শতাংশ।