তরুণদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল। তবে বিক্রেতারা বলছেন, বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়লেও এ ধরনের গাড়ি বিক্রি এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়েনি।
ঢাকা মোটর শোর এবারের আসরে নতুন নতুন মডেলের গাড়ি প্রদর্শন করে মিতসুবিশি, হোন্ডা, এমজি, প্রোটন, চাংগান, সুজুকি, গ্যাক মোটরস, ডংফেন, দিপালসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ড। এসব গাড়ির মধ্যে এই মেলা বা প্রদর্শনীতে আগত ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল নতুন নতুন মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মরিস গ্যারেজের (এমজি) সাইবারস্টার মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়িটির প্রতি ছিল বেশি আগ্রহ। দেশের বাজারে গাড়িটির বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। গাড়িটি একবার চার্জ করলে চলে ৫০০ কিলোমিটার। বৈদ্যুতিক এই গাড়িটিতে রয়েছে ৩৭৫ কিলোওয়াটের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। দেশের বাজারে গাড়িটি এনেছে র্যানকন ব্রিটিশ মোটরস।
বিক্রেতারা জানান, গাড়িটিতে শূন্য থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিবেগ উঠতে ৩ সেকেন্ডের কিছু বেশি সময় লাগে। গাড়িটি চারটি রঙে পাওয়া যাবে। বর্তমানে বাজারে এই মডেলের দুটি গাড়ি বিক্রি হয়েছে। র্যানকন ব্রিটিশ মোটরসের বিক্রয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দুই আসনের স্পোর্টস কনভার্টেবল বৈদ্যুতিক গাড়ি আমরাই প্রথম বাজারে এনেছি। বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার এসইউভি গাড়ির চাহিদা বেশি।
গাজীপুরে র্যানকনেরই আরেক প্রতিষ্ঠানের তৈরি মিতসুবিশি এক্সপ্যান্ডার মডেলের গাড়িও প্রদর্শিত হয় এবারের মোটর শোতে। এই গাড়ির দাম ৩৪ লাখ টাকা। গাড়িটি সাত আসনের। বিক্রেতারা জানান এই গাড়ি শহর কিংবা ঢাকার বাইরে চলাচলের জন্য বেশ আরামদায়ক ও কার্যকর।
রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় তিন দিনের মোটর শোতে ১৭৫টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। তার মধ্যে গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ছিল ৯টি। আর অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল গাড়ি ও মোটরসাইকেলশিল্প–সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসহায়তা প্রদানকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ছিল। ১৮ বারের মতো ঢাকায় এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে সেমস গ্লোবাল। গত শনিবার তিন দিনের এই প্রদর্শনী শেষ হয়।
প্রদর্শনী ঘুরে দেখা যায়, উত্তরা মোটরসের ‘সুজুকি জিমনি ৫-ডোর’ মডেলের গাড়িটিও ছিল প্রদর্শনীতে আগত দর্শনার্থীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রে। উত্তরা মোটরসের বিক্রয়কর্মীরা জানান, গাড়িটি দুর্গম পথেও সহজে চলতে পারে। দেশের বাজারে গাড়িটি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ লাখ টাকায়।
এবারের মোটর শোকে সামনে রেখে এসিআই মোটরস প্রথমবারের মতো বাজারে এনেছে ফোটন ব্র্যান্ডের ফ্রিজার ভ্যান। এটির দাম ঠিক করা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কর্মীরা জানান, খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য, ওষুধ কোম্পানিসহ করপোরেট গ্রাহকদের প্রয়োজন মাথায় রেখে এই গাড়ি বাজারে আনা হয়েছে। ক্রেতারা ২০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিয়ে ইএমআই বা কিস্তি সুবিধায় এই ভ্যানটি কেনার সুযোগ পাবেন।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) ‘ফর্মুলা আইইউটি’ নামের গাড়ি তৈরির দল নিজেদের তৈরি একটি ফর্মুলা গাড়িও এবারের প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়। গাড়িটি নিয়ে আগামী অক্টোবরে চীনে আয়োজিত ‘ফর্মুলা স্টুডেন্টস চায়না ২০২৫’ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কথা রয়েছে বলে দলটির সদস্যরা জানান। আইইউটি দলের প্রধান আহসানুল আমিন বলেন, ‘চীনের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আমরা চালকের নিরাপত্তা ও গাড়ির কারিগরি দিকটিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি।’
আগ্রহ বেশি বৈদ্যুতিক গাড়িতে
গাড়ি বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়লেও এ ধরনের গাড়ি বিক্রি এখনো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়েনি। বরং প্লাগ-ইন হাইব্রিড ধরনের ইঞ্জিনসহ বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা এখন বেশি। এ ধরনের গাড়ি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উভয় মাধ্যমে চলতে পারে বলে এসব গাড়ির চাহিদা বেশি।
ঢাকা মোটর শোতে চীনা প্রতিষ্ঠান জিএসি তাদের এমপিভি ‘ই৯ পিএইচইভি’ মডেলের গাড়ি বাজারে এনেছে। একবার চার্জে গাড়িটি চলতে পারে প্রায় ১৩৬ কিলোমিটার। এই গাড়িতে রয়েছে পুরোপুরি ডিজিটাল ককপিট, প্যানোরামিক সানরুফ ও শব্দদূষণ কমানোর প্রযুক্তি। গাড়িটির দাম ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
ঢাকা মোটর শোতে আগত দর্শনার্থীদের কাছে আগ্রহ দেখা গেছে চীনা আরেক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চাংগানের সহযোগী প্রতিষ্ঠান দিপালের বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতি। চীনের চাংআন, হুয়াওয়ে ও ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিএটিএলের সহযোগিতায় এসব গাড়ি তৈরি করা হয়। গত মার্চে বাজারে আনা প্রতিষ্ঠানটির ছয়টি গাড়ির মধ্যে পাঁচটি এরই মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান দিপালের বিক্রয় প্রতিনিধিরা। তাঁরা জানান, দিপালের এলজিরোসেভেন ও এসজিরোসেভেন মডেলের গাড়ি দুটি পুরোপুরি বৈদ্যুতিক। এর মধ্যে এলজিরোসেভেন সিডান মডেলের গাড়িটির দাম ৬০ লাখ টাকা। আর এসজিরোসেভেন মডেলের এসইউভির দাম ৬৫ লাখ টাকা। গাড়ি দুটি একবার চার্জে যথাক্রমে ৫৪০ ও ৪৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষ এখনো বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর পুরোপুরি আস্থা না রাখতে পারলেও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে মন্তব্য করে দিপালের এদেশীয় বিক্রয় প্রধান আলফাত হোসাইন বলেন, আধুনিক গাড়ি সম্পর্কে যাঁরা ধারণা রাখেন, তাঁরাই বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনতে আগ্রহ দেখান। সরকার বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানিতে কর ও নিবন্ধন মাশুল কমালে এ ধরনের গাড়ি কেনায় ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়বে বলে জানান তিনি।
এ ছাড়া তিন দিনের প্রদর্শনীতে বিভিন্ন মডেলের বৈদ্যুতিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাগি কার, ট্রাইসাইকেল, থ্রি হুইলার ও ডেলিভারি ভ্যানও প্রদর্শন করা হয়। বিভিন্ন মডেলের এসব বৈদ্যুতিক যানের দাম দেড় লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা। বৈদ্যুতিক এসব যানবাহন ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। একবার চার্জে এসব বাহন ৮০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলবে।
তরুণদের আগ্রহ বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেলে
প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া মোটরসাইকেলের ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে ছিল বাজাজ, স্পিডোজ, ডংজিন গ্রুপ ও সালিদা ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া মোটরসাইকেলের দুই-তৃতীয়াংশই ছিল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেল। এর মধ্যে চীনা প্রতিষ্ঠান সালিদা ইলেকট্রিক ভেহিকেলের ৬০০ থেকে ৩ হাজার ওয়াটের মোট ১২টি মডেলের মোটরসাইকেল বাজারে পাওয়া যায়। বৈদ্যুতিক এসব মোটরসাইকেল একবার চার্জে ৮০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে। এসব মোটরসাইকেলের দাম ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকার মধ্যে। চীনা আরেক প্রতিষ্ঠান ডংজিনের ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার কিলোওয়াটের একেকটি মোটরসাইকেলের দাম ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা।
ডংজিনের বিক্রয় নির্বাহী জাহিদ হাসান বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে বৈদ্যুতিক মোটরসাইকেলের চাহিদা বাড়ছে। তাই এ বছর আমরা সাতটি মডেল বাজারে এনেছি। মেলায় বেশ সাড়া পেয়েছি। পরিবেশবান্ধব ও দাম কিছুটা কম হওয়ায় দিন দিন বৈদ্যুতিক যানবাহনের চাহিদা বাড়ছে।’
এবারের ঢাকা মোটর শোতে উত্তরা মোটরসের বাজাজ পালসার এফ২৫০ ডুয়েল চ্যানেল এবিএস মোটরসাইকেলের উদ্বোধন করা হয়। ২৫০ সিসি ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেলটির দাম ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া মোটরসাইকেল যন্ত্রাংশের প্রতিষ্ঠান আরসিবির স্টলেও ছিল তরুণ বাইকারদের চোখে পড়ার মতো ভিড়।