
ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত রূপালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন মো. আশিক রহমান (ছদ্মনাম)। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর সিনিয়র অফিসার পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় আশিক রহমানেরও নাম রয়েছে। কিন্তু রূপালী ব্যাংক গত সাত মাসেও নিয়োগপত্র দেয়নি।
একটি প্রথম শ্রেণির চাকরিতে সুপারিশ পাওয়ায় আশিক রহমানের পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা—সবাই খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁকে কেউ বিশ্বাস করছেন না। আশিক রহমান বলেন, ‘আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা মনে করেন, আমি মিথ্যা বলেছি, চাকরি হয়নি। যেহেতু হাতে নিয়োগপত্র নেই, তাই তাঁদের কিছু দেখাতেও পারি না। চাকরি পেয়েও লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। দীর্ঘদিনেও নিয়োগপত্র না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছি।’
শুধু আশিক রহমান নন, হতাশায় দিন কাটছে রূপালী ব্যাংকে অফিসার ও সিনিয়র অফিসার পদের চাকরিতে সুপারিশ পেয়ে নিয়োগের অপেক্ষায় থাকা ৮৯২ জন চাকরিপ্রার্থীর। তাঁরা প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করে চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও নিয়োগপত্র পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগসংক্রান্ত ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, রূপালী ব্যাংকে ২টি পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পেয়েও নিয়োগপত্র পাননি মোট ৮৯২ জন। এর মধ্যে ২০১৬ সালভিত্তিক প্যানেল থেকে প্রাথমিক সুপারিশ পাওয়া অফিসার পদের ১৩৪ জন। নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয় গত বছরের ১৯ জুলাই। আরও নিয়োগপত্র পাননি ২০১৮ সালভিত্তিক সিনিয়র অফিসার পদের ২১১ জন। ফল প্রকাশ করা হয় গত বছরের ৩ আগস্ট। ২০১৯ সালভিত্তিক সিনিয়র অফিসার পদের ৭৭ জন এখনো নিয়োগপত্র পাননি। এ পদের ফল প্রকাশ করা হয় গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর। ২০১৮ সালভিত্তিক অফিসার পদের ৪৭০ জনও নিয়োগপত্র পাননি। ফল প্রকাশ করা হয় গত ১৭ জানুয়ারি।
সিনিয়র অফিসার পদে সুপারিশ পাওয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চাকরিপ্রার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদুল ফিতরে বাড়ি যেতে পারিনি লজ্জায়। শুধু আমি না, সুপারিশ পাওয়া অর্ধেক প্রার্থী বাড়িতে যাননি লজ্জায়। অনেকে মেসে থেকেছেন কেউবা আত্মীয়ের বাড়িতে। সবাই জিজ্ঞাসা করে কবে যোগদান করব। এর কোনো উত্তর দিতে পারি না। তাই নিজেকে লুকিয়ে বোনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি। চাকরি পেয়েও লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’
অফিসার পদে সুপারিশ পাওয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন চাকরিপ্রার্থী বলেন, ‘রূপালী ব্যাংকে যোগাযোগ করা হলে তারা শুধু আশার বাণী শোনায়। কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলে না কবে নিয়োগপত্র দেবে। অথচ আমাদের সঙ্গে সুপারিশ পাওয়া ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত অন্যান্য ব্যাংকের সুপারিশপ্রাপ্ত প্রার্থীরা সেসব ব্যাংকে যোগদান করে গত পাঁচ থেকে ছয় মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন।’
ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। এরপর বাকি নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করে নিজ নিজ ব্যাংকগুলো।
সাধারণত চূড়ান্ত ফলের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে নিয়োগপত্র দেয় ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত ব্যাংকগুলো। যেমন ২০১৮ সালভিত্তিক সিনিয়র অফিসার নিয়োগের চূড়ান্ত ফলের এক থেকে দুই মাসের মধ্যে পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের নিয়োগপত্র দিয়েছে সোনালী ও জনতা ব্যাংক।
এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে থাকা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশন সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের গত ডিসেম্বরে নিয়োগ দেয়, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ ও কর্মসংস্থান ব্যাংক নিয়োগ দেয় ফেব্রুয়ারিতে এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক নিয়োগ দেয় মার্চে। কিন্তু রূপালী ব্যাংক ফল প্রকাশের আট মাস অতিবাহিত হলেও সুপারিশ পাওয়া ২১১ জন প্রার্থীকে এখনো নিয়োগপত্র দেয়নি।
এ ছাড়া রূপালী ব্যাংক গত ৯ মাসেও ২০১৬ সালভিত্তিক অফিসার পদের ১৩৪ জনের নিয়োগপত্র দেয়নি। আরও নিয়োগপত্র পাননি ২০১৯ সালভিত্তিক সিনিয়র অফিসার পদের ৭৭ জন ও ২০১৮ সালভিত্তিক অফিসার পদে সুপারিশ পাওয়া ৪৭০ জন।
এ বিষয়ে জানতে রূপালী ব্যাংকে যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৮ সালভিত্তিক সিনিয়র অফিসার পদের ২১১ জনের পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হয়েছে। তাঁদের ঠিকানায় নিয়োগপত্রের চিঠি ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করি মে মাসের মধ্যে তাঁরা নিয়োগপত্র হাতে পাবেন।’
অপর তিনটি নিয়োগের বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৯ সালভিত্তিক সিনিয়র অফিসার পদের ৭৭ জনের এবং ২০১৮ সালভিত্তিক অফিসার পদের ৪৭০ জনের পুলিশ ভেরিফিকেশন চলছে।
পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হলেই তাঁদের নিয়োগপত্র দেওয়া হবে। আর ২০১৬ সালভিত্তিক অফিসার নিয়োগে ১৩৪ জনকে তৃতীয় পর্যায়ে প্যানেল থেকে নির্বাচন করা হয়েছে। যেহেতু এটি তৃতীয় প্যানেল তাই তাঁদের নিয়োগপত্র দিতে সময় একটু বেশি লাগছে।’
ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত অন্য ব্যাংকগুলো চূড়ান্ত ফল প্রকাশের দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে নিয়োগপত্র দিলেও রূপালী ব্যাংকের নিয়োগপত্র দিতে কেন বেশি সময় লাগে, এ প্রশ্ন করা হলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘অন্য ব্যাংকগুলো সুপারিশ পাওয়া প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার পর পুলিশ ভেরিফিকেশন করে।
কিন্তু আমরা পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ করে নিয়োগপত্র দেই। এ জন্য নিয়োগপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে আমাদের দুই থেকে তিন মাসের পার্থক্য থাকে।’