
৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে অভূতপূর্ব গতি আনলেও উত্তীর্ণের সংখ্যা কম হওয়ায় এবং ফলাফল নিয়ে বিতর্কের জেরে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রার্থীরা। ফলাফল প্রকাশের পর কারিগরি ত্রুটির কারণে বাদ পড়া ব্যক্তিদের উত্তীর্ণ ঘোষণা এবং দুই প্রার্থীর ফলাফল বাতিলের ঘটনা এই বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে গতি এনেছে বটে, কিন্তু ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি বহু চাকরিপ্রার্থী। দ্রুততার সঙ্গে ফলাফল প্রকাশ করতে পিএসসি এবার খাতা মূল্যায়নে সনাতনী পদ্ধতি বাদ দিয়ে আধুনিক ‘সার্কুলার ইভ্যালুয়েশন সিস্টেম’ ব্যবহার করেছে। যেখানে ৪৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে সময় লেগেছিল প্রায় ১৫ মাস, সেখানে ৪৬তম বিসিএসের ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ে। ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই শুরু হয়ে শেষ হয় ৩ আগস্ট আর ফলাফল প্রকাশিত হয় চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর।
কিন্তু এই দ্রুততা নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, দ্রুত খাতা দেখতে গিয়ে মূল্যায়নে বড় ধরনের বিচ্যুতি হয়েছে, যার ফলস্বরূপ বিগত বিসিএসগুলোর তুলনায় এই ধাপে সবচেয়ে কমসংখ্যক প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করা হয়েছে।
৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ২১ হাজার ৩৯৭ জন প্রার্থী। অথচ পরের ধাপ লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন মাত্র ৪ হাজার ৪৮ জন। এই বিসিএসে ৩ হাজার ১৪০টি পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ মৌখিক পরীক্ষার জন্য পদের বিপরীতে ৯০৮ জন বেশি প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে পিএসসি। শতাংশের হিসাবে পদের বিপরীতে প্রায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি প্রার্থী নির্বাচিত করা হয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে বেশ কম।
বিপরীতে, আগের বিসিএসগুলোর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীর সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি—
তুলনামূলক চিত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রায় একই সংখ্যক প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণের (৪০তম ও ৪১তম) বিপরীতে ৪৬তম বিসিএসে লিখিততে পাসের হার অনেক কমে গেছে।
লিখিত পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিতভাবে কমসংখ্যক প্রার্থীকে পাস করানোয় ক্ষুব্ধ হয়েছেন অংশ নেওয়া পরীক্ষার্থীরা। তাঁদের অভিযোগ, নতুন পদ্ধতিতে খাতা মূল্যায়নে বড় ধরনের বিচ্যুতি হয়েছে।
প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ‘এক বছরে সরকারি কর্ম কমিশন কী করল’ শীর্ষক প্রতিবেদনের মন্তব্যের ঘরে মাসুদুর রহমান নামের এক পাঠক মন্তব্য করেন, ‘৪৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় রুব্রিক বা সার্কুলার পদ্ধতির নামে গণহারে ফেল করানো হয়েছে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এক পরীক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘২১ হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার লিখিত পাস করল। কিছু বুঝতে পারছি না। ৪৫০ পাব না, বিশ্বাস হচ্ছে না। শুনেছি লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে পিএসসি “নমুনা উত্তর পদ্ধতি” চালু করেছে। নমুনা উত্তর পদ্ধতি থাকা মানে তো সেই গাইড বুক স্টাইলেই চলে যাওয়া, তাই না? এখানে নিজের এক্সিলেন্সি, থট প্রসেস দেখানোর সুযোগ তো তাহলে থাকছে না।’
৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর পিএসসি দুটি পৃথক বিজ্ঞপ্তি এই বিতর্ককে তীব্র করেছে। ৩ ডিসেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে পিএসসি জানায়, ‘কারিগরি ত্রুটি’র কারণে ৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে বাদ পড়া আট পরীক্ষার্থীকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। একই দিনে অন্য এক বিজ্ঞপ্তিতে লিখিত পরীক্ষায় অনিয়মের দায়ে দুই পরীক্ষার্থীর ফলাফল বাতিল করা হয়। পিএসসি জানায়, গত ২৭ নভেম্বর প্রকাশিত ফলাফলে অন্তর্ভুক্ত এই দুই পরীক্ষার্থী বাংলা প্রথম পত্রের (বিষয় কোড-০০১) পরীক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত না থাকলেও বেআইনিভাবে ওই বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এটি কমিশনের নির্ধারিত বিধান লঙ্ঘনের দায়ে তাঁদের পরীক্ষা ও ফলাফল বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
এক পরীক্ষার্থী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পিএসসির ইতিহাসে কেউ কখনো শুনেছে, লিখিত পরীক্ষায় কারিগরি ত্রুটির কারণে কারও ফলাফল আসেনি? এই কমিশন সেই রেকর্ড করেছে। প্রথমে দুজন প্রার্থী বেআইনিভাবে পাস করল, পরে ফলাফল বাতিল হলো। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে পিএসসি বড় ধরনের বিচ্যুতি করেছে।’
পিএসসির ভাষ্যমতে, দ্রুত ফলাফল প্রকাশের কারণ হলো খাতা মূল্যায়নে আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার। সনাতনী পদ্ধতিতে খাতা পরীক্ষকদের বাসায় পাঠানো হতো। এতে তাঁরা মাসের পর মাস খাতা নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। নতুন ‘সার্কুলার ইভ্যালুয়েশন সিস্টেমে’ এখন শিক্ষকেরা পিএসসিতে এসে খাতা দেখেন। একই টেবিলে প্রথম পরীক্ষকের পর দ্বিতীয় পরীক্ষক এবং প্রয়োজনে তৃতীয় পরীক্ষক নির্দিষ্ট সময় ধরে মূল্যায়ন কাজ শেষ করেন। ফলাফলে ৪৬তম বিসিএসের খাতা মূল্যায়ন কম সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। তবে দ্রুততার জন্য সাধুবাদ পেলেও ফলাফল নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক ৪৬তম বিসিএসের পুরো প্রক্রিয়াতেই একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।