
ঢাকার কোলাহল, স্টার্টআপের ব্যস্ত অফিস বা বড় করপোরেটের আলোঝলমলে বোর্ডরুম—মার্কেটিং এখন তরুণের কাছে আকর্ষণীয় পেশা। ডিজিটাল বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন, ব্র্যান্ডিং থেকে শুরু করে ক্রেতাদের আচরণ বোঝা—সবই এই পেশার অংশ। চাকরিপ্রার্থীদের অনেকেই নিজের ক্যারিয়ারের পথ হিসেবে মার্কেটিং বেছে নিচ্ছে।
বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিব হাসান একটি ই-কমার্স স্টার্টআপে ডিজিটাল মার্কেটার হিসেবে কাজ করছেন। তার কাজের মধ্যে রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন প্রচারণা পরিকল্পনা করা এবং অনলাইন বিক্রয় বাড়ানো। রাকিব বলেন, ‘প্রথম দিকে সবকিছুই নতুন এবং চ্যালেঞ্জিং মনে হচ্ছিল। এখন যখন আমার কৌশল কাজে লাগছে এবং বিক্রি বাড়ছে, মনে হচ্ছে—এই পেশার আনন্দই আলাদা।’ তার মতে মার্কেটিং একটি সজীব পেশা। প্রতিদিন তাঁকে নতুন ধারণা নিয়ে আসতে হয়, কখনো ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করতে হয়, আবার কখনো পণ্যের নতুন প্যাকেজিং বা প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন পরিকল্পনা করতে হয়।
মার্কেটিংয়ে কর্মজীবন শুরু করতে নির্দিষ্ট কোনো ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা নেই, তবে বিজনেস, মিডিয়া, কমিউনিকেশনস বা ডিজিটাল স্টাডিজের ডিগ্রি থাকলে তা বাড়তি সুবিধা দেয়।
মার্কেটিং শুধু পণ্যের বিজ্ঞাপন বা বিক্রির কাজ নয়। এটি হলো ব্যবসার প্রাণ—যেখানে পণ্য বা সেবা মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা, বিশ্লেষণ এবং সৃজনশীলতা একসঙ্গে কাজ করে। প্রতিটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেরই লক্ষ্যে থাকে নিজেদের পণ্য বা সেবাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সেই কাজটিই পরিচালনা করে মার্কেটিং টিম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভোক্তার সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বেড়েছে প্রতিযোগিতাও। ফলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এখন শুধু পণ্য বানিয়ে বসে থাকার দিন শেষ—এখন তাদের জানতে হয় গ্রাহক কী চায়, কীভাবে সেই চাওয়া তৈরি করা যায়।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে—বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি ও কনটেন্টভিত্তিক মার্কেটিং রোলগুলো দ্রুত বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়া, ই-কমার্স আর ব্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজির যুগে ডিজিটাল মার্কেটিং এখন ব্যবসার প্রথম সারির সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন ব্র্যাক, গ্রামীণফোন, স্কয়ার, রবি এমনকি নতুন স্টার্টআপগুলোর এখন নিজেদের ইন-হাউস মার্কেটিং টিম বা ডিজিটাল এজেন্সি রয়েছে।
মার্কেটিং পেশাসংশ্লিষ্ট সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার মাসে আয় করতে পারেন ১-২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এর পাশাপাশি এই পেশায় বোনাস পাওয়ার অফুরান সুযোগ রয়েছে। শুরুতে নতুন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভদের বেতন কম থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ২০-২৫ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করতে হয়। তবে এই পেশায় পরিশ্রম, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার সমন্বয় করতে পারলে বেতন দ্রুত সময়ে বাড়ে।
মার্কেটিংয়ে কর্মজীবন শুরু করতে নির্দিষ্ট কোনো ডিগ্রির বাধ্যবাধকতা নেই, তবে বিজনেস, মিডিয়া, কমিউনিকেশনস বা ডিজিটাল স্টাডিজের ডিগ্রি থাকলে তা বাড়তি সুবিধা দেয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এখন ডিজিটাল মার্কেটিং, ব্র্যান্ডিং, কনজিউমার বিহেভিয়র বা ডেটা অ্যানালিটিকস নিয়ে বিশেষায়িত কোর্স চালু হয়েছে। কিন্তু শুধু বই মুখস্থ নয়, কাজের দক্ষতাই এখানে আসল মুদ্রা। একটি সফল মার্কেটিং পেশাজীবীর যে দক্ষতাগুলো দরকার—মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষমতা; সৃজনশীলতা এবং গল্প বলার দক্ষতা; কনটেন্ট রাইটিং, স্ক্রিপ্ট বা ক্যাম্পেইন আইডিয়া প্রস্তুতের ক্ষমতা; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন ফেসবুক অ্যাডস, গুগল অ্যানালিটিকস, এসইও, সোশ্যাল মিডিয়া টুল ব্যবহারের দক্ষতা এবং তথ্য বিশ্লেষণ ও বাজার বোঝার সামর্থ্য।
তবে সবকিছুর মতো মার্কেটিং পেশারও রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা ও বাস্তব সমস্যা। প্রথমত, এই খাতে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রতি পাঁচজন ব্যবসায় শিক্ষার্থীর একজন এখন মার্কেটিংয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছেন। ফলে সিভি জমা দিলেই চাকরি হয়ে যায়—এমনটা ভাবলে হতাশ হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এটি একধরনের ফলনির্ভর কাজ। মাস শেষে লক্ষ্যে পূরণ না হলে চাকরির চাপ বাড়ে, কখনো কখনো লক্ষ্যে পূরণ করতে গিয়ে সময় ও সৃজনশীলতা ধাক্কা খায়। অনেক এজেন্সিতে রাত জেগে কাজ করা, কঠিন টাইমলাইন আর ক্লায়েন্টের চাপ নিতেই হয়।
তৃতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), স্বয়ংক্রিয়তা ও অ্যালগরিদমভিত্তিক বিজ্ঞাপন এখন অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, আগামী পাঁচ বছরে মার্কেট অ্যানালাইসিস, বিজ্ঞাপনের অ্যালগরিদমিক পরিকল্পনা ও গ্রাহকের আচরণ বিশ্লেষণ—এসব কাজে এ আই মানুষের ভূমিকা আংশিকভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারে। তাই এই পেশায় টিকে থাকতে হলে শুধু টুল ব্যবহার না, বরং কৌশল তৈরি করার দক্ষতা, সৃজনশীল মন আর মানবিক বোধ জরুরি।