Thank you for trying Sticky AMP!!

অনলাইন শিক্ষার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

অনলাইন ক্লাস প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারিতে বিশ্ব এখন চরম হুমকিতে। সারা বিশ্বের মানুষ দুশ্চিন্তায় আছে, চিন্তা করছে কখন এ করোনা মহামারির সমাপ্তি হবে? তবে এখন বাংলাদেশে দ্রুত করোনার সংক্রমণ বেড়েই চলছে, এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সরকার ও জনগণ। কোভিড-১৯–এর কারণে অর্থনীতি, ব্যবসা, পর্যটন ও শিক্ষা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। করোনা দুর্যোগে সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। প্রতিরোধমূলক হিসেবে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষার অনিশ্চয়তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। অলস সময় পার করছে এবং সেশনজট নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে না পারায় তারাও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সশরীর পরীক্ষা শুরু করে আবার তা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে সশরীর পরীক্ষাগুলো অন্তত নেওয়া উচিত।

দিন দিন জ্যামিতিক হারে মৃত্যু এবং করোনায় সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। যেকোনো স্তরের শিক্ষার্থীরা কোভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই সরকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে কোভিড-১৯ নিয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কোভিড-১৯–এর কারণে অনলাইন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনেক গুণ বেড়েছে। সম্প্রতি কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নেওয়া শুরু করছেন এবং কিছু শিক্ষক অনলাইন অ্যাসাইনমেন্ট ও হোমওয়ার্ক নিচ্ছেন। এমনকি অনেক শিক্ষক মিডটার্ম পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া শুরু করেছেন। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকেরা টিভিতে ক্লাস নিচ্ছেন। তবে এটি শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা কার্যকর? অনলাইন ক্লাস শ্রেণিকক্ষে সরাসরি ক্লাসের চেয়ে বেশি কার্যকর বলে মনে হয় না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের; আর্থিক সংকটের কারণে অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না। অনেকেরই নেই অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণের মতো মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃশ্যপট আলাদা। সেখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের। তারা সহজেই ইন্টারনেট সুযোগ–সুবিধা পেয়ে থাকে।

কোভিড-১৯ মহামারিতে বিশ্বব্যাপী ৩০০ মিলিয়নের বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতীতে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হয়নি। উন্নত দেশ যেমন চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের ই-লার্নিং সিস্টেম চালু করছে। চীন জুম ও টেনসেন্ট অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, পরীক্ষা নিচ্ছে এবং ডিগ্রিও প্রদান করছে। অর্থাৎ এটি অত্যন্ত কার্যকর। তবে এটির জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ডিভাইসে উচ্চ ইন্টারনেট গতিসম্পন্ন সংযোগ থাকা প্রয়োজন। আমিও পিএইচডির ছাত্র হিসেবে দেশে থেকেই অনলাইনে ক্লাস, গবেষণা প্রস্তাবের ডিফেন্স ও অন্যান্য পরীক্ষাসংক্রান্ত কাজে অংশগ্রহণ করছি।

অনলাইন শিক্ষার মূল শর্ত হলো সব শিক্ষার্থীর জন্য ইন্টারনেট এবং অনলাইনে কোর্সের ডকুমেন্ট নিশ্চিত করা। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্সের ডকুমেন্ট আরও প্রাণবন্ত করা উচিত। এ সিস্টেমে ছাত্রদের টিমওয়ার্ক গঠন করে ব্রেইন স্টর্মিং কঠিন। তারপরও আমাদের এ পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে হবে এবং অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া উচিত। কর্তৃপক্ষ যদি অনলাইন পাঠদানের বাধ্যতামূলক নির্দেশনা দেয়, তবে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী ল্যাপটপ, ইন্টারনেটের অভাবে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারবে না বলে মনে করি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে এমনটি বলছি। এ ছাড়া গ্রাম ও পার্বত্যাঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাব রয়েছে, যা অনলাইন শিক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

যদিও অনলাইন টিচিং শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক সহজেই ক্লাস নিয়ন্ত্রণ এবং একই সঙ্গে সব শিক্ষার্থীর কাজ মূল্যায়ন করতে পারেন। শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কম মনোযোগী শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করতে পারেন এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ক্লাসে আকৃষ্ট করতে পারেন। তদুপরি শ্রেণিকক্ষে লেকচারের সময় শিক্ষার্থীদের যেকোনো প্রশ্ন কোনো জটিলতা ছাড়াই সহজেই উত্তর দেওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরাসরি কথোপকথনের অভাবে অনলাইন ক্লাসকে সফল করা কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে সরকার অনলাইন শিক্ষার জন্য ঋণ দিচ্ছে, যাতে তাঁরা ডিভাইস কিনতে পারে।

দেশে বিদ্যুতের বিঘ্নিত সরবরাহ অনলাইন শিক্ষার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা। এখনো কিছু মানুষ বিদ্যুৎ–সংযোগের বাইরে রয়েছে। অস্থিতিশীল বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দুর্বল বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা অনলাইন শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষক বিদ্যুৎ–সংযোগ পাচ্ছেন, কিন্তু এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীরা থাকে, যেখানে বিদ্যুৎ নেই। সুতরাং এটি বাংলাদেশের জন্য সাধারণ একটি চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে অনেক শিক্ষার্থী এ–জাতীয় ই-লার্নিংয়ে অভ্যস্ত নয়। কেবল শিক্ষার্থীরা নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অনেক শিক্ষকই পুরোনো পাঠদান পদ্ধতিকে বেশি পছন্দ করেন। আমার পর্যবেক্ষণে, এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লেকচারে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন (পিপিটি) এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করতে নারাজ। এখন অধিকাংশ শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন। উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলোর পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষা ব্যয়বহুলও। এতে শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপের মতো প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম থাকা একান্ত দরকার। এ ছাড়া ডেটা কিনতে হয়। স্মার্টফোন প্রযুক্তি অতীতের চেয়ে সর্বব্যাপী হতে পারে, তবে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য স্মার্টফোন ক্রয় এবং তার সম্ভাব্য সুবিধা অর্জনের দক্ষতা এখনো সম্ভব হয়নি। সুতরাং এটি অনলাইন শিক্ষার আরেকটি চ্যালেঞ্জ।

চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আছে সুবিধা

চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষারও সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষককে অনলাইনে তাঁর কোর্স আপডেট করতে হয়। অনলাইন শিক্ষা প্রচলিত পদ্ধতি থেকে পৃথক, যা অনলাইন শিক্ষাদানে কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত বা কী অন্তর্ভুক্ত করবে না, সে সম্পর্কে শিক্ষকেরা গভীরভাবে চিন্তা করে থাকেন। তাই পাঠদানের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। শিক্ষককে অনলাইনে পাঠদানের জন্য কোর্সের আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী পুনরায় তৈরি করতে হয়, যা তাকে নতুনভাবে ক্লাস নিতে অনুপ্রেরণা দেয়। দ্বিতীয়ত, অনলাইন শিক্ষা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে শিক্ষকেরা ভিডিও লেকচার শিট ও পিপিটি তৈরি করেন, যাতে শিক্ষার্থীরা কোর্সের বিষয় একাধিকবার দেখতে বা বিশ্লেষণের সুযোগ পেয়ে থাকে। প্রযুক্তিচালিত বিশ্বে কীভাবে অনলাইন এবং শ্রেণিকক্ষে উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করবে, সেই সম্পর্কে এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা নতুন ধারণা লাভ করতে পারে। তবে শিক্ষকেরা চূড়ান্ত পরীক্ষা কীভাবে অনলাইনে নেবেন, তার একটি শক্তিশালী বাস্তবসম্মত নীতিমালা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে যেহেতু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার আশঙ্কা রয়েছে, তাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতে দিনে ও রাতে দুই শিফট চালু এবং সেশনজট কমাতে ঐচ্ছিক, শিক্ষাবর্ষের সময় কমিয়ে নিয়ে আসা এবং সাপ্তাহিক ছুটি বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। এ ছাড়া শিক্ষকেরা যদি নিয়মিত ক্লাস ঘণ্টার বেশি ক্লাস নেন, তবে তাঁদের অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আন্তরিকভাবে এসব বিষয়ে বিবেচনা করা উচিত এবং শিক্ষা খাতের জন্য উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি। সার্বিক বিবেচনায় অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ও স্কুল পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া দরকার। আমি মনে করি যদি সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দরিদ্র শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা দেয়; তাহলে একমাত্র অনলাইন শিক্ষা সে ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হতে পারে। যদিও সরকার ইন্টারনেট ব্যবহারে কিছু ব্যয় কমিয়েছে। এ ছাড়া কিছু মোবাইল অপারেটর কোম্পানি করোনাকালীন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীসহ গ্রাহকদের অসুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য কিছুটা কমিয়েছি। অন্যথায় কিছু শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা ও পাঠদান থেকে বঞ্চিত হতে পারত। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তত দিন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে জাতীয় পরামর্শক কমিটি। তবে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে উৎসাহ দিতে বলেছে।

*লেখক: সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি), ত্রিশাল, ময়মনসিংহ