২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে সরকারি তিতুমীর কলেজের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ২৪৬ জন শিক্ষার্থী। প্রায় চার বছর পর তাঁদের মধ্যে থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষার ফরম পূরণ করেন ১১৭ জন। নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলিয়ে মোট পরীক্ষার্থী ১৩৪।
শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার এই চিত্র শুধু রসায়ন বিভাগের নয়, দেশের অন্যতম বৃহৎ সরকারি এই কলেজের অনেক বিভাগেরই। শিক্ষার্থীদের একটা অংশ মাঝপথে ঝরে পড়ে। আবার ক্লাসে উপস্থিতিও বেশ কম।
পরীক্ষায় অংশ নিতে নির্দিষ্টসংখ্যক ক্লাস করার নিয়ম থাকলেও ‘বাস্তব কারণ’ দেখিয়ে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদেরও সুযোগ দেওয়া হয়। অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস বাদ দিয়ে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। ফলে নিয়মিত পড়াশোনায় অনাগ্রহ রয়েছে। ৫৭ বছর আগে রাজধানীর মহাখালীতে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে এখন শুধু স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গত জানুয়ারিতে তিতুমীর কলেজসহ ঢাকার সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করেছে। তবে বর্তমান শিক্ষার্থীরা এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়ছেন।
তিতুমীর কলেজে এখন ২১ হাজার শিক্ষার্থী, অথচ শিক্ষক মাত্র ২২০ জন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১: ৯৫। কলেজটিতে কয়েক বছর ধরেই শিক্ষকের পদসংখ্যা অপরিবর্তিত—১৭৩টি। তবে এসব পদের বাইরেও ইনসিটু হিসেবে কিছুসংখ্যক শিক্ষক আছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে সংযুক্ত হলেও তাঁরা ক্লাস নেন এই কলেজে। আবার এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চললেও (আগে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী, এ বছর ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকবেন না।) পাঠ্যসূচি খুব একটা যুগোপযোগী হয়নি।
শিক্ষকেরা বলছেন, তাঁরা আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠদান করলেও শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি ও আবাসনসংকটের কারণে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন।
কলেজগুলোর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।এস এম হাফিজুর রহমান, অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৬ ও ২০১৯ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিতুমীর কলেজে শ্রেণিকক্ষ ও আবাসনসংকটের চিত্র উঠে এসেছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ১০ তলাবিশিষ্ট দুটি নতুন একাডেমিক ভবন নির্মিত হওয়ায় শ্রেণিকক্ষের সংকট অনেকটাই কেটেছে।
আবাসনব্যবস্থারও কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে। ছাত্রদের জন্য পুরোনো তিনতলার একটি আবাসিক ছাত্রাবাসে সংস্কার চলছে। সেটি এখন বন্ধ। তবে পাশেই ১০ তলা নতুন শহীদ মামুন ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীরা থাকেন। এখানে প্রায় ৮০০ শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ছাত্রীদের নতুন আবাসিক হলে প্রায় ৬০০ ছাত্রী থাকার ব্যবস্থা আছে। আগে ছিল দুটি ছাত্রীনিবাস, যার মধ্যে কলেজ ক্যাম্পাসে আছে সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাস। বনানীতে অবস্থিত আরেকটি ছাত্রীনিবাস নামমাত্র চালু রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীর আবাসনসুবিধা আছে।
একাধিক শিক্ষার্থীর ভাষ্য, শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ঢাকার বাইরের। ফলে নতুন দুটি আবাসিক হল হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
গত কয়েক বছরে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির সমস্যা বেশি হয়েছে। এমনও হয়েছে, ক্লাসে শিক্ষার্থী ২০০-২৫০ জন। কিন্তু উপস্থিতি থাকে ১০ থেকে ১৫ জন। এটি কেন হচ্ছে, এটি নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।ছদরুদ্দীন আহমদ, অধ্যক্ষ, তিতুমীর কলেজ
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্লাসে উপস্থিতি আশানুরূপ নয়। কোনো কোনো বিভাগে ৩০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন মাত্র ৪০-৫০ জন। প্রথম বর্ষে উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি থাকলেও দ্বিতীয় বর্ষ থেকে কমতে শুরু করে।
অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের একজন ছাত্র প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথম বর্ষে দুটি শাখা ছিল, এখন একটিতেই ক্লাস হয়। শিক্ষকেরা আসেন, কিন্তু শিক্ষার্থী কম।’ উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের দুই ছাত্রী জানান, পরীক্ষার আগে কিছুদিন ক্লাসে বেশি শিক্ষার্থী দেখা যায়, তবে সারা বছর উপস্থিতি কম।
পরীক্ষায় অংশ নিতে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি আবশ্যক। ৬০-৭৪ শতাংশ উপস্থিতি থাকলে দেড় হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া যায়। ৬০ শতাংশের নিচে উপস্থিত থাকলে পরীক্ষার অনুমতি নেই। কিন্তু এই নিয়ম কঠোরভাবে মানা হয় না।
চারজন শিক্ষক প্রথম আলোকে জানান, বাস্তবতা হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষ শেষে খণ্ডকালীন কাজে যুক্ত হয়ে যান বা পড়াশোনায় আগ্রহ হারান। পরে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়। ফলে কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষায় ঘাটতি থেকে যায়। তাঁরা মনে করেন, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ক্লাসে উপস্থিতির নিয়ম আরও কঠোর করা প্রয়োজন।
একাধিক শিক্ষার্থীর ভাষ্য, নিয়মিত ক্লাস না হওয়ায় অনেককেই প্রাইভেট পড়তে হয়। ফিন্যান্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তাঁদের বিভাগে শিক্ষকসংকট বেশি। ফলে সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস হয়। ঠিকমতো ক্লাস না হওয়ায় মাসে দেড় হাজার টাকা দিয়ে বাইরে ব্যাচে পড়েন।
কলেজের একজন শিক্ষক বললেন, সংকটের মধ্যেই ফলাফল তুলনামূলক ভালো। ফলাফলে কোনো কোনো বছর কোনো কোনো বিভাগ সাত কলেজের মধ্যে শীর্ষে থাকে।
২২ অক্টোবর সরেজমিন নানা বিষয় জানা যায়। ওই সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছদরুদ্দীন আহমদ তাঁর দপ্তরে ছিলেন না। পরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির এই সমস্যা দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই। প্রায় ৩৩ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে এটি বেশি হয়েছে। এমনও হয়েছে, ক্লাসে মোট শিক্ষার্থী ২০০-২৫০ জন। কিন্তু ক্লাসে উপস্থিতি থাকে ১০ থেকে ১৫ জন। এটি কেন হচ্ছে, সেটা তিনিও বুঝতে পারছেন না। এটি নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। আর শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষকও কম। এই অনুপাত কমাতে হবে এবং শিক্ষকদের সুযোগ–সুবিধা বাড়াতে হবে।
১৯৬৮ সালে সরকারি কলেজ হিসেবে তিতুমীর কলেজের যাত্রা শুরু। প্রায় এক দশক আগে এখানে শিক্ষার্থী ছিল প্রায় ৫০ হাজার। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে, বর্তমানে ২১ হাজারে নেমে এসেছে।
কলেজে এখন ২২টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাঠদান হয়।
ঢাকার সাত কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কলেজগুলোর আসনসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেমন তিতুমীর কলেজে এবার রসায়নে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি আসন প্রায় আড়াই শ থেকে আশিতে নামানো হয়েছে।
তবে প্রস্তাবিত কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের উদ্যোগ নিয়ে সাত কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। অনেকেই এর বিরোধিতা করছেন, আবার তিতুমীর কলেজের অনেক শিক্ষার্থী চান কেবল তাঁদের কলেজটিই পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হোক। তবে যা–ই হোক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত কমানোর পক্ষে অনেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি তিতুমীর কলেজসহ অধিকাংশ কলেজেই ঠিকমতো ক্লাস হয় না, ক্লাসে অনুপস্থিতি বেশি থাকে। তাই কলেজগুলোর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।