
গাজায় ইসরায়েলে ভয়াবহ হামলার কারণে বিশ্বের নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও একাডেমিক সংস্থা ইসরায়েলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে। তাদের দাবি, ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে হামলাসহ বিভিন্ন উদ্যোগে ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশটির সরকারের দমননীতির সঙ্গে জড়িত।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। নিহতদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। জাতিসংঘ–সমর্থিত বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, গাজার বেশ কিছু এলাকা এখন ‘মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে’ পতিত হয়েছে এবং বহু শহর প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এই মানবিক বিপর্যয়ের প্রতিবাদে বিভিন্ন দেশ একাডেমিক বয়কট শুরু করেছে। ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব সিয়ারা গত বছর ইসলায়ের সঙ্গে একটি যৌথ উদ্ভাবন সম্মেলন বাতিল করে। পরবর্তী সময়ে নরওয়ে, বেলজিয়াম ও স্পেনের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইসরায়েলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এ বছরের গ্রীষ্মে ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনও একই পদক্ষেপ নেয়।
বয়কট কার্যকর হবে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সমালোচকেরা মনে করেন, এটি ব্যক্তিগত শিক্ষাবিদদের প্রতি অন্যায় এবং সরকারকে তেমন চাপে ফেলতে পারবে না। তবে সমর্থকেরা বলছেন, এটি শান্তিপূর্ণ কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবাদের মাধ্যম।
সম্প্রতি আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচি বাতিল করেছে। ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলজিস্টস (ইএএসএ) ঘোষণা করেছে, তারা আর কোনো ইসরায়েলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করবে না এবং তাদের সদস্যদেরও একই পথে চলার আহ্বান জানিয়েছে। ফিলিস্তিনি একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক বয়কট আন্দোলনের মুখপাত্র স্টেফানি অ্যাডাম বলেন, ‘ইসরায়েলি একাডেমিক বা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক দশক ধরে সামরিক দখলদারত্ব, বর্ণবাদী দমননীতি এবং এখন গণহত্যার সঙ্গে জড়িত।’
গাজায় ইসরায়েলের হামলা “অত্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত”, তবে বয়কটের ফলে এমন সব ইসরায়েলি শিক্ষাবিদও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, যাঁরা নিতান্তই সরকারের বিরোধী।রয়্যাল সোসাইটি র সাবেক সভাপতি ও নোবেল বিজয়ী ভেনকি রামাকৃষ্ণান
তবে অনেক দেশ একডেমিক সম্পর্ক ছিন্ন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এমন বয়কট দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশির ভাগই এখনো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধায় রয়েছে। ইউনিভার্সিটিজ ইউকে (ইউইউকে) নামের সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা একাডেমিক বয়কটের বিরোধী।
সংস্থাটির একজন মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা সর্বজনীন একাডেমিক বয়কটকে সমর্থন করি না; কারণ, এটি একাডেমিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে। জাতীয়তা বা রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে মুক্তচিন্তার আদান-প্রদান অব্যাহত রাখা জরুরি।
একইভাবে রয়্যাল সোসাইটি জানিয়েছে যে তারাও একাডেমিক বয়কটের বিরোধিতা করে। সংস্থাটির সাবেক সভাপতি ও নোবেল বিজয়ী ভেনকি রামাকৃষ্ণান বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েলের হামলা “অত্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত”, তবে বয়কটের ফলে এমন সব ইসরায়েলি শিক্ষাবিদও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, যাঁরা নিতান্তই সরকারের বিরোধী। অন্যদিকে আমি যেসব ইসরায়েলি একাডেমিককে চিনি, যাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে আমি আমার বন্ধু হিসেবেও গণ্য করি, তাঁদের বেশির ভাগই নেতানিয়াহু এবং তাঁর সরকারকে ঘৃণা করেন। এমন একটি উদ্যোগ বা বয়কট তাঁদের শাস্তি দেবে, যাঁরা ইসরায়েলি সরকারের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী নন বরং যাঁরা আসলে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল।’
এটি খুব কঠিন এবং কঠোর হলেও প্রয়োজনীয় একটি আলোচনা। এই বয়কট ইসরায়েলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে এবং দেখিয়ে দেয় যে তারা একটি দমনমূলক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ।ইলান পাপ্পে, ইসরায়েলের ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানী
ইসরায়েলের ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ইলান পাপ্পে অনেক শিক্ষাবিদ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীল—এই ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘যদি সত্যিই তা হতো, তাহলে আমি তাঁদের সেই কয়েক শ সাহসী ইসরায়েলির মধ্যে দেখতে পেতাম যাঁরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। কারণ, এটি একটি গণহত্যা, এমন নয় যে এটি জিম্মিদের ফেরত আনতে ব্যর্থ হয়েছে। (এই বিক্ষোভগুলো ইসরায়েলে বেআইনি হিসেবে গণ্য করা হয়)।’ তিনি বলেন, ইসরায়েলি শিক্ষাবিদদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দেশের সেনাবাহিনীতে সেবা দিতে অস্বীকারও করে না।
ইলান পাপ্পে বলেন, ‘তারা (বিশ্ববিদ্যালয়) গোপন সংস্থা, পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থার জন্য কোর্স এবং ডিগ্রি প্রদান করে, যারা প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বয়কট প্রসঙ্গে পাপ্পে বলেন, ‘এটি খুব কঠিন এবং কঠোর হলেও প্রয়োজনীয় একটি আলোচনা। এই বয়কট ইসরায়েলি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে এবং দেখিয়ে দেয় যে তারা একটি দমনমূলক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ৭৭ বছর ধরে চলছে এবং এখন ইসরায়েলি একাডেমিয়াকে বলা হচ্ছে যে এ ধরনের আচরণের জন্য মূল্য দিতে হবে।’
ব্রিটিশ–ফিলিস্তিনি সার্জন ও গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর ঘাসান সুলেমান আবু-সিত্তা জানান, যুক্তরাজ্যে শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা বয়কট চাইলেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ সেগুলো আটকে দিচ্ছে। তিনি বলেন, অনেক গবেষক ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলি সহকর্মীদের সঙ্গে যৌথ প্রকল্প থেকে সরে যাচ্ছেন।
গবেষণা তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়া ইসরায়েলি একাডেমিয়ার জন্য বড় হুমকি হতে পারে। ইসরায়েল হরাইজন ইউরোপ গবেষণা কর্মসূচি থেকে ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৮৭৫.৯ মিলিয়ন ইউরো পেয়েছে।
তবে গত জুলাইয়ে ইউরোপীয় কমিশন প্রস্তাব দেয়, যেসব প্রকল্প সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন সাইবার সিকিউরিটি, ড্রোন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সে প্রকল্পগুলোয় ইসরায়েলের অংশগ্রহণ সীমিত করার। যদিও এই প্রস্তাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ২০২৮ সালে শুরু হতে যাওয়া হরাইজন ইউরোপের উত্তরসূরি কর্মসূচি থেকে ইসরায়েলকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হতে পারে।
এদিকে ইসরায়েলের গবেষণা অনুদান ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। ২০২৪ সালে ইইউর গবেষণা অনুদানপ্রাপ্ত তরুণ গবেষকের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ জন, যা আগের বছরের ৩০ জনের তুলনায় অনেক কম। এর প্রতিক্রিয়ায় এ বছরের শুরুতে ইসরায়েলি সরকার ২২ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে একাডেমিক বয়কট মোকাবিলায়।
যদি গবেষণা তহবিল বন্ধ হয়ে যায় এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা হ্রাস পায়, তাহলে ইসরায়েল থেকে শীর্ষ গবেষকেরা স্থায়ীভাবে বিদেশে চলে যেতে পারেন। বিশেষ করে চিকিৎসা খাত ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এটি বড় ক্ষতি হবে।
বয়কট কার্যকর হবে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সমালোচকেরা মনে করেন, এটি ব্যক্তিগত শিক্ষাবিদদের প্রতি অন্যায় এবং সরকারকে তেমন চাপে ফেলতে পারবে না। তবে সমর্থকেরা বলছেন, এটি একটি শান্তিপূর্ণ কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবাদের মাধ্যম।
বিশ্বজুড়ে বয়কট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকায় এটি ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয় ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে বড় ধরনের দ্বন্দ্বের জন্ম দিতে পারে বলে ধারণা করছে বিশেষজ্ঞরা।
ইসরায়েলের গবেষকেরা গার্ডিয়ানকে বলেছেন যে একাডেমিয়া বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বয়কটের সঠিক লক্ষ্য নয় এবং কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, একাডেমিক বয়কট এটা কোনো কার্যকর সমাধান বয়ে আনতে পারবে না, অন্যদিকে অনেকে মনে করেন এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
আবু-সিত্তা বলেন, একাডেমিক বয়কটের হুমকিই যথেষ্ট, যা ইসরায়েলি সরকারকে এই গণহত্যা বন্ধ করতে বাধ্য করবে।