
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আসার পর শিক্ষার্থী পড়াশোনার ধরন অনেকটাই বদলে গেছে। বদলে গেছে শেখার ধরন। এখন বইয়ের চেয়ে মোবাইল–ট্যাবে শিক্ষার্থীদেরা পড়ার হার বাড়ছে। কারণ, তাদের হাতে এসেছে নতুন নতুন কিছু প্রযুক্তি।
এমন অবস্থায় গুগল জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের হাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি তুলে দিতে তারা কাজ করছে। গুগল ভারতে শিক্ষার রূপান্তরের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত শিক্ষণ পদ্ধতিগুলোর একটি বিস্তৃত পরিসর ঘোষণা করেছে। এটি গতকাল শুক্রবার (৭ নভেম্বর) ভারতে প্রকাশ করা হয়েছে। এর কেতাবী নাম ‘এআই অ্যান্ড দ্য ফিউচার অফ লার্নিং’। এই পেপারে সব তথ্য দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আগামী এক বছর বিনা মূল্যে গুগলের সর্বাধুনিক এআই টুলগুলো ব্যবহার করতে পারবে।
গুগলের ভাষ্য, তাদের এআই-চালিত শেখার সরঞ্জামগুলো শুধু তাৎক্ষণিক উত্তর দেওয়ার জন্য নয় বরং শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। গুগল বলছে, এসব টুল মানুষের শেখার মনোবিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। সম্প্রতি গুগল তার তিনটি মূল টুল—জেমিনি, নেটাবুকএলএম এবং সার্চ (Gemini, NotebookLM And Search)-এর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শেখার ৯টি কার্যকর উপায় প্রকাশ করেছে। নিচে গুগলের সেই নির্দেশনাগুলোর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো—
১. গাইডেড লার্নিং ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত করে
জেমিনির গাইডেড লার্নিং বা দিকনির্দেশনাভিত্তিক বৈশিষ্ট্যটি শেখার সুবিধা দেয়। এখানে প্রশ্ন করলে সরাসরি উত্তর না দিয়ে টুলটি সমস্যাকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে চিন্তা করতে শেখায়। তাৎক্ষণিক সমাধান প্রদানের পরিবর্তে, খোলামেলা প্রশ্ন উত্থাপন করে যা শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করতে এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে অর্থপূর্ণ আলোচনায় জড়িত হতে উৎসাহিত করে।
২. স্মার্ট প্রস্তুতি সরঞ্জামগুলো অধ্যয়ন উপযোগী উপকরণ তৈরি করে
শিক্ষার্থীরা এখন তাৎক্ষণিকভাবে ক্লাস উপকরণ, পাঠ্য অনুচ্ছেদ বা হাতে লেখা নোটের ছবি থেকে ফ্ল্যাশকার্ড, অধ্যয়ন নির্দেশিকা এবং ইন্টারেক্টিভ কুইজ তৈরি করতে পারে। এই কাস্টমাইজেবল প্রস্তুতির সরঞ্জামগুলো শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মূল ধারণাগুলো পর্যালোচনা করতে শেখায়। বিদ্যমান বিষয়বস্তুগুলো অনুশীলনে রূপান্তরিত করে পরীক্ষার জন্য কার্যকরভাবে প্রস্তুত করতে সহায়তা করে।
৩. জেমিনি লাইভ ভয়েস-অ্যাক্টিভেটেড টিউটরিং সেবা
ভয়েস ও ক্যামেরা ব্যবহার। ফোনের ক্যামেরা দিয়ে জ্যামিতির সমস্যা বা কোনো চিত্র দেখিয়ে প্রশ্ন করলে এআই তাৎক্ষণিকভাবে কথার মাধ্যমে গাইড দেয়। এতে আর টাইপ করার ঝামেলা নেই। রিয়েল-টাইম কথোপকথন এই বৈশিষ্ট্যটি শিক্ষার্থীদের হ্যান্ডস-ফ্রি শেখার সহায়তার জন্য একই সঙ্গে ভয়েস এবং ক্যামেরা ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। প্রজেক্ট অ্যাস্ট্রা গবেষণার ক্ষমতা দিয়ে তৈরির কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের ফোনগুলোকে গণিত চ্যালেঞ্জিং সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারে।
৪. অডিও এবং ভিডিও ওভারভিউ গবেষণাকে রূপান্তরিত করে
দীর্ঘ লেখা বা জটিল ডকুমেন্টের সারাংশ তৈরি করে দেয় এই বৈষ্টিট্য। কোনো ৩০ পাতার গবেষণাপত্র আপলোড করলে টুলটি সহজ ভাষায় অডিও বা ভিডিও সারাংশ তৈরি করে দেয়। এটি ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষাতেও এ সুবিধা মিলবে। অর্থাৎ নোটবুকএলএম জটিল গবেষণা নথিগুলোকে একাধিক ভারতীয় ভাষায় উপলব্ধ করে সারাংশে রূপান্তর করে। সাম্প্রতিক আপগ্রেডগুলোতে জেমিনির ইমেজ জেনারেশন মডেল দ্বারা চালিত বিভিন্ন অডিও ওভারভিউ ফরম্যাট এবং উন্নত ভিডিও ওভারভিউ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের তথ্য যাছাইয়ে একাধিক উপায় প্রদান করে।
৫. মাইন্ড ম্যাপ বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে সংযোগ
ঐতিহ্যবাহী রৈখিক নোট নেওয়ার (লিনার নোট টেকিং) বাইরে গিয়ে নোটবুকএলএমের মাইন্ড ম্যাপিং বৈশিষ্ট্যটি শিক্ষার্থীদের চিন্তাভাবনাগুলোকে দৃশ্যমানভাবে একীভূত করে। বিভিন্ন শিক্ষণ উপকরণের মধ্যে সম্পর্ক শনাক্ত করতে সহায়তাও করে। অর্থাৎ ভিজ্যুয়াল মানচিত্রে ধারণাগুলোর সংযোগ দেখানো যায় এখানে। এতে আলাদা আলাদা নোটের বদলে ধারণাগুলোর সম্পর্ক বোঝা যায়। যেমন, ‘ইনপুট ডেটা’, ‘ইউজার বিহেভিয়ার’, ‘আউটকাম’, ‘বায়াস’-এই উপাদানগুলো কীভাবে যুক্ত, তা মানচিত্রে দেখা যায়।
৬. স্বয়ংক্রিয় ফ্ল্যাশকার্ড এবং কুইজ পরীক্ষার জ্ঞান
নোটবুকএলএম স্বয়ংক্রিয়ভাবে একজন শিক্ষার্থীর নোটবুকের মধ্যে আপলোড করা নোট এবং নথির ওপর ভিত্তি করে ইন্টারেক্টিভ লার্নিং এইড তৈরি করে দেয়। শিক্ষার্থীরা তাদের ক্লাস নোট, খাতার ছবি বা টাইপ করা লেখা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফ্ল্যাশকার্ড, কুইজ বা গাইড তৈরি করতে পারে। নিজস্ব উপকরণ থেকে ইন্টারঅ্যাকটিভ সিলেবাস তৈরি করতে পারে। ক্লাস নোট, পিডিএফ, স্লাইড আপলোড করলে টুলটি সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে কুইজ ও ফ্ল্যাশকার্ড তৈরি করে দেয়।
৭. সুবিন্যস্ত নথিগুলো ফোকাসড সারাংশ প্রদান করে
প্ল্যাটফর্মটি তাৎক্ষণিকভাবে উৎস উপকরণ থেকে ব্রিফিং ডকুমেন্ট এবং অধ্যয়ন নির্দেশিকা তৈরি করে দেয় এবং বিষয়বস্তুতে উল্লিখিত থিম, বিষয় বা শিল্পের ওপর ভিত্তি করে গতিশীলভাবে নানা বিকল্প সুপারিশ করে। এই বৈশিষ্ট্যটি শিক্ষার্থীদের অনেক বড় তথ্য–গবেষণার বিষয়বস্তু থেকে দ্রুত প্রয়োজনীয় তথ্য বের করতে সহায়তা করে।
৮. এআই মোডে লেন্স ভিজ্যুয়াল লার্নিং চ্যালেঞ্জগুলো ডিকোড করে
গুগল সার্চের উন্নত লেন্স বৈশিষ্ট্য এখন একাধিক ভারতীয় ভাষায় আছে। শিক্ষার্থীদের ছবি সম্পর্কে জটিল প্রশ্নের উত্তর দেয়। পাঠ্যপুস্তক এবং অধ্যয়ন উপকরণগুলোতে কঠিন ডায়াগ্রাম, চার্ট বা ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনা বোঝার জন্য এটি বিশেষভাবে সহায়তা করে। অর্ধাৎ লেন্স–এ এআই মোডে সার্চ করা যায়। এখানে লেখার বদলে বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি তুলে প্রশ্ন করা যায়।
৯. সার্চ লাইভ তাৎক্ষণিক ক্যামেরাভিত্তিক সহায়তা প্রদান করে
রিয়েল-টাইম ভয়েস ও ক্যামেরার প্রশ্নোত্তরের সুযোগ। ইংরেজি বা হিন্দিতে সরাসরি প্রশ্ন করলে তাৎক্ষণিকভাবে দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট সমস্যায় আটকে থাকা শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যামেরা উপাদানের দিকে নির্দেশ করতে পারে এবং রিয়েল টাইমে দ্রুত ইঙ্গিত বা বিস্তৃত ব্যাখ্যার জন্য অনুরোধ করতে পারে।
গুগল জানিয়েছে, এই দ্রুত উন্নয়নশীল এআই টুলগুলো শেখাকে করছে মজাদার, ইন্টারঅ্যাকটিভ ও বহুমাত্রিক। শিক্ষার্থীরা এখন তাদের নিজের নোট ব্যবহার করে ভিজ্যুয়াল ও অডিও দুইভাবেই পড়াশোনা করতে পারছে এবং ভাষাগত বাধাও কাটিয়ে উঠছে। তবে গুগলের পরামর্শ—এসব টুল শেখাকে সহজ করবে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মনোযোগ, পরিশ্রম ও অনুপ্রেরণার বিকল্প কিছু নেই।