বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির (মাসে বেতন বাবদ সরকারি টাকা) কাজে চার স্থানে ‘হাদিয়া বা সম্মানী’ দিতে হয়। এ কাজে পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি আজ বুধবার ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওভুক্তি, নিয়োগ, বদলি, পাঠদানের অনুমতিসহ বিভিন্ন কাজে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত (ঘুষ) দিতে হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও এর অধীন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষা–সংশ্লিষ্টদের এ ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া আছে পদে পদে অনিয়ম ও সমস্যা।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি গুণগত গবেষণা। বেশির ভাগ তথ্যদাতা এসব কথা বলেছেন। অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেছেন টিআইবির সাবেক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক তাসলিমা আক্তার। আর সঞ্চালনা করেন টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম।
টিআইবির এ প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিকভাবে শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতি একটি চ্যালেঞ্জ, এটা অনস্বীকার্য। এর কারণ হলো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত যে দীর্ঘসূত্রতা থাকে, তার কারণে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনা অত্যন্ত কঠিন। কারও দোষের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ ধরনের অভিযোগ ও ধারণা কমবে না। তাই শিক্ষা প্রশাসনে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। তাঁরা এখন সেই কাঠামোগত সংস্কার আনার চেষ্টাই করছেন।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা—এই তিন প্রধান ধাপে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাটি চলছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষার স্তরটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে ২০ হাজারের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬০০–এর বেশি। বাকিগুলো বেসরকারি। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য এমপিওভুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত, সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে মাসে মূল বেতন এবং কিছু ভাতা পেয়ে থাকেন।
আগে মাউশির প্রধান কার্যালয় সরাসরি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির কাজটি করত। তখনো এমপিওভুক্তি নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। এরপর ২০১৫ সাল থেকে মাউশির ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে এমপিওভুক্তির কাজটি চূড়ান্ত হয়। শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বরাবর আবেদন করতে হয়। উপজেলা কার্যালয় যাচাই-বাছাই করে আবেদনটি জেলা শিক্ষা অফিসে পাঠায়। সেখানে আরেক দফায় যাচাই শেষে আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাঠানো হয় এবং সেখানেই এমপিও চূড়ান্ত করা হয়।
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই চার স্থানে ‘হাদিয়া বা সম্মানী’ দিয়ে আবেদন পাঠাতে (অগ্রায়ণ) হয়। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের সঙ্গে আর্থিক চুক্তির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এমপিওভুক্তির আবেদন পাঠান (অগ্রায়ণ)। বর্তমানে শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে নিয়মবহির্ভূতভাবে পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।
টিআইবি বলছে, অনলাইন আবেদনের মাধ্যমে এমপিও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এ ক্ষেত্রে তদবির ও নিয়মবহির্ভূত টাকা আদায় করা হয়। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আর্থিকভাবে সন্তুষ্ট করা না হলে অনেক সময় এমপিও দীর্ঘায়িত হয়। এমপিওভুক্তিতে নিয়মবহির্ভূত টাকা আদায় সব সময়ই বিরাজমান আছে। সবার কাছ থেকে একই পরিমাণে টাকা আদায় হয় না। এটি নির্ভর করে প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সম্পর্ক এবং আবেদনকারী শিক্ষকের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের সম্পর্কের ওপর। সাধারণত নথিগত সমস্যার জন্য ‘বাধ্য হয়ে’ টাকা দেওয়া হয়। আবার সমস্যা না থাকলেও টাকা না দিলে ফাইল অগ্রায়ণ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে টাকা দেওয়া এবং সময়ক্ষেপণ করা হয়। অনেক সময় ‘শিক্ষা অফিসে এবং কমিটির সুপারিশের জন্য টাকা লাগবে’ এটি বলেও প্রতিষ্ঠান প্রধান এমপিওর জন্য আবেদনকারীর কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। আবার কোনো কোনো সময় আবেদনকারী দালালের সহযোগিতা নিয়ে থাকেন।
এ ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজে অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূতভাবে দিতে হয়। এ টাকা দিতে হয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পরিচালনা কমিটিকে। নিয়োগ বোর্ডে থাকা মাউশির মহাপরিচালকের প্রতিনিধিকে (বিদ্যালয়ের শিক্ষক) নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় প্রার্থীর সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ না দেওয়ার ঘটনাও আছে।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সুপারিশ করা সহকারী শিক্ষকদেরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানে দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। এ টাকা দিতে হয় প্রধান শিক্ষক বা পরিচালনা কমিটিকে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষায় উত্থাপিত আপত্তির নিষ্পত্তিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে। টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন নথিপত্রে দুর্বলতা থাকে। নিরীক্ষকের (অডিটর) পক্ষ থেকে এসব দুর্বলতা ব্যবহার করে নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ আদায়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
আবার কখনো কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দুর্বলতার জন্য পরিদর্শককে ‘ম্যানেজ’ করতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়ে থাকে। টাকা না দিলে নিরীক্ষা আপত্তি বেশি থাকে এবং টাকা দিলে নিরীক্ষা আপত্তি থাকে না।
শিক্ষকদের বদলি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদানসহ আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে। এতে মাধ্যমিক শিক্ষায় অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণে ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, শিক্ষক নিয়োগ ও বদলি, এমপিওভুক্তি, পাঠদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক; যা জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠনের পথে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে উঠছে। তিনি বিশ্বাস করেন, সরকার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষা খাতে সুশাসনের এসব ঘাটতি দূর হবে।