জন্মদিন

অকুণ্ঠচিত্ত ফেরিওয়ালা

সেলিম আল দীন
সেলিম আল দীন

চুয়াত্তর পর্যন্ত সেলিম আল দীনের নাম শুনিনি। আর্ট কলেজে পড়তাম। ছিলাম কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। কলেজের রজতজয়ন্তী উৎসব ধুমধামে করা হবে, সে জন্য নানান আয়োজন চলছিল। সে উদ্যাপনে একটা নাটক অভিনীত হবে, ভাবা হয়েছিল। নাটকের বই খুঁজতে গিয়ে টিএসসিতে বইয়ের দোকানে অদ্ভুত নামের একটা বই চোখে পড়ে। আতর আলীদের নীলাভ পাট। নাট্যকারের নামটাও আলাদা, সেলিম আল দীন। বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়েই দুপাতা পড়ে ফেলি। অল্প জ্ঞান তবু বুঝতে পারি অন্য রকম লেখা। আর্ট কলেজে নাটক হবে, আলাদা রকমই হওয়া উচিত ভেবে বইটা কিনে সে রাতেই পড়ে শেষ করি। মানুষটার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা জাগে কিন্তু আরও দু-একদিন ভাববার পর পিছিয়ে পড়ি। ভয়ের কারণে পিছিয়ে পড়া।
যার লেখা খুব আলাদা, তিনি আলাদাই হবেন ধরে নেওয়া যায়। অদেখা সে মানুষ বয়সে তরুণ হবেন মোটেও ভাবিনি। কেন জানি মনে হয়েছিল মানুষটার চেহারা দাড়ি চুলে কার্ল মার্ক্সের মতো হবে। তেমন চেহারার কথা ভেবে ভয় বাড়ে। যোগাযোগের সাধ মন থেকে পালিয়ে যায়।
তবু তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা কপালে লেখাই ছিল। রজতজয়ন্তী উৎসবে নাটক হয়েছিল। অন্য নাটক। সে নাটকে আমার অভিনয়ের কথা না থাকলেও ঘটনাচক্রে অভিনয় করতে হয়। ঢাকা থিয়েটার ছিল সে নাটকের সব নেপথ্য কর্মকাণ্ডের কান্ডারি। নাটক শেষে ঢাকা থিয়েটারের দলনেতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ থিয়েটারে উৎসাহ থাকলে আমাকে দলে যোগ দিতে বলেন। দল মানে ঢাকা থিয়েটার।
দলে যোগ দিয়ে জানতে পারি সেলিম আল দীনের ডেরায় ঢুকে পড়েছি। কোনো পূর্ব প্রস্তুতি নেই অথচ একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে কত কী বদলে যেতে থাকে। সব যেন লিখে রাখা চিত্রনাট্য অনুযায়ী ঘটে চলে।
মানুষের সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা বিশেষ হলে, কখন কীভাবে তা হয়েছিল বিশেষভাবেই মনে থাকে। যখন সেলিম আল দীনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় কখন কীভাবে হয়েছিল তা খুঁজতে বসি, কিছুই মনে করতে পারি না। খুবই অবাক লাগে।
তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণ অবশ্য স্পষ্টভাবে জানা। দলের বড়-ছোট কেউই তাঁর কাছে বড় বা ছোট ছিল না। মনে পড়লে হাসি পায়, নতুন লেখা নাটক যখন মহড়াকক্ষে পড়ে শোনানো হতো, পড়া শেষে যে কারও মতামত হাসিমুখে মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কেউ ঠিকমতো বুঝতে না পেরে হয়তো হাস্যকর কথা বলেছে, তার মতামতও হেসে উড়িয়ে দিতে দেখিনি।
বোধ হয় আমি ছবি আঁকতে পারি বলে অনেকের মধ্যে থেকেও আমার সঙ্গে আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। যে কারণেই হোক, অমন এক মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এক জীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তি মনে হয়।
ভাবনায়, চিন্তা-চেতনায় বিস্ময়কর একজন মানুষ। জীবনযাপনে ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল, ধুলো মাটির মতো সাধারণ।

আফজাল হোসেন

যত দেখেছি, জেনেছি অনর্গল অতৃপ্তির শোকে, যন্ত্রণায়, সৃজনের আনন্দে নিজেকে ভেঙেছেন আর গড়েছেন। সব সময় সওয়ার ছিলেন সময়ের চেয়ে দ্রুতগামী এক ঘোড়ার পিঠে। সে ঘোড়া সর্বদাই সময়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। তাতে তার সাফল্য, সন্তুষ্টি, প্রাপ্তির আনন্দ ফেনিয়ে উঠেছে, আর তার নিচে মানুষটা চাপা পড়ে গেছেন, তেমনটা ঘটেনি। একাই অসীমে ঘোড়া ছুটিয়ে আপন বাহাদুরি উপভোগের চেয়ে পিছিয়ে পড়া সময়কেও শক্ত মুঠোয় ধরে একই উচ্চতায় ভাসিয়ে নিতে চেয়েছেন।
সেই সংবাদ কার্টুন থেকে আজ অবধি তাঁর সব নাটক, যখন যেটির মঞ্চায়ন হয়েছে, মিলনায়তনে উপচে পড়া সাধারণের ভিড় নিয়মিত ঘটনা। এ আগ্রহ অবিরাম বেড়েছে, বেড়েই চলেছে মানুষের কৌতূহলের ঘনত্ব।
নিজস্ব এক ভাষা ভঙ্গিমা তৈরি করে নিয়েছিলেন। প্রতিটি নাটক যেন বিস্ময়ের ভান্ডার। নব নব ভাবনা কেবলই বিস্মিত করেছে, সম্পন্ন হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছে সাধারণকে।
মঞ্চ, টেলিভিশন, সাহিত্যে আগে যা ঘটেনি, যেমনটা পূর্বে ভাবা হয়নি সেসবের আস্বাদই একের পর এক উপহার পেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন সাধারণ পাঠক, দর্শক।
সৃজনশীল ক্ষমতাকে পোষা পাখির মতো দাঁড়ে বসাতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে জীবনযাপনের দর্শন ছিল বেঁচে থাকাটা বড় নয়, কীভাবে বেঁচে আছি সেটাই বড়। নির্মোহ কিশোরের মতো অসাধ্যের পথে অবলীলায় হেঁটে আলাদা থেকেছেন তবু একা হয়ে যাননি, অবিশ্বাস্য ঘটনাই।
বোধ হয় তাঁর জানা ছিল, খুব বেশি সময় হাতে নেই। তাই লিখেছেন অনর্গল। লেখার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য নয়, কর্তব্যের তাড়নায়। সময়টা যেন আগামী দিনেও গৌরবোজ্জ্বল হয়ে থাকে সে আশায়।
সেলিম আল দীন শিল্পের হাটে অকুণ্ঠচিত্ত ফেরিওয়ালা। পণ্য বাজারে পসারিও হতে পারতেন। বহু দফায় পায়ে ঠেলেছেন সে সুযোগ। সে পায়ে ঠেলার শক্তি ও সাহস খুব অল্প মানুষের থাকে।
বাজার সাম্রাজ্যের প্রবল দাপটে যেন ভুলে না যাই, বাংলাদেশের নিজস্ব নাট্যদর্শন ও রীতির নবজাগরণে সেলিম আল দীন ছিলেন অকপট, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, একাই এক শ।
রুটি মাখনের মতো পারস্পরিক দরকারি সম্পর্কের কালে ভাতের গন্ধের মতো মৌলিক সেলিম আল দীনকে চর্চা করার মানসিকতা যেন বেঁচে থাকে। অন্তত তাঁর যাওয়া-আসার দিন যেন প্রতিবছর মনে করিয়ে দেয় ঋণ আছে, ঋণী হয়ে আছি।
সৌভাগ্য যে আমাদের কালে সেলিম আল দীনকে পেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য, খুব বেশিদিন পাওয়া হয়নি। দুর্ভাগ্য কেন বলি, এক শ বা তারও বেশি বছর পর সে সময়ের মানুষেরা যখন বাংলা সাহিত্য, নাটক নিয়ে ভাববেন, তখন অবধারিত এ মানুষটিই জ্বলজ্বল করবে নক্ষত্রের মতো। তখন আরও একবার সগৌরবে হেসে উঠবে বাংলাদেশ।