Thank you for trying Sticky AMP!!

জন্মদিন মানে তো মৃত্যুর আরও কাছাকাছি চলে যাওয়া

করোনার অভিশাপ আসার পর এক দিনের জন্যও বাড়ির বাইরে যাননি ববিতা। ছবি: প্রথম আলো

করোনার অভিশাপ আসার পর এক দিনের জন্যও বাড়ির বাইরে যাননি ববিতা। এমনকি লিফট পর্যন্তও নয়। দীর্ঘ পাঁচ মাস এভাবে একা থাকার কারণে অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি। কিছু পড়তে ভালো লাগে না, ফোনে কথা বলতে ভালো লাগে না, অদ্ভুত এক নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসেছে তাঁকে।

কবে কাটবে এই করোনাকাল, অন্য সবার মতো সে ভাবনা তাঁকেও শঙ্কিত করছে।

বুধবার মধ্যদুপুরে যখন তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনো তাঁর কণ্ঠে ছিল বিষণ্নতা। অস্থিরতাও প্রকাশ পাচ্ছিল কথোপকথনে। এই বিশাল একাকিত্বের একটা বড় কারণ হলো, ছেলে অনীকের সঙ্গে দেখা হয় না অনেক দিন। বছরে দুবার কানাডায় যেতেন ছেলের কাছে, থাকতেন কাছাকাছি, তাতে পূর্ণ হতো মনের রসদ। কিন্তু এখন দেশের বাইরে যাওয়া মানা। ঝুঁকি নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তাই মেসেঞ্জারে ভিডিও কলই সম্বল। অন্যদিকে বড় বোন সুচন্দা আমেরিকায় গিয়ে এখনো ফিরতে পারেননি। পাঁচ মাস তিনি সেখানে বন্দী। আর ছোট বোন চম্পা তাঁর স্বামী-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। তাই একাকিত্ব থেকে চাইলেও মুক্তি পাচ্ছেন না ববিতা।
তাঁর মন ভালো করার জন্য বলি, ‘গতকাল খাবার টেবিলে মোবাইলের ফেসবুক থেকে হঠাৎ বেজে উঠেছিল পরপর দুটো গান। “হায় রে কপাল মন্দ/ চোখ থাকিতে অন্ধ” আর “আমি কোথায় থাকি রে/ বটগাছের পাতা নাই রে।”’
হঠাৎ কণ্ঠে তাঁর ফুটে উঠল উচ্ছ্বাস, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ আর ‘নয়নমনি’।

ফরিদা আক্তার ববিতা। ছবি প্রথম আলো

‘হ্যাঁ, আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন হাউসফুল ছবি দুটো দেখেছিলাম।’ তাঁকে আরও খানিকক্ষণ আবিষ্ট রাখার জন্য বলি, ‘ধরুন, আপনি ফিরে গেছেন গত শতাব্দীর সত্তর বা আশির দশকে আপনার প্রবল জনপ্রিয়তার সময়টিতে। এখন যদি তখনকার যেকোনো দুটো ছবি রিমেক করার কথা ভাবা হয়, কোন দুটো ছবিতে অভিনয় করবেন?’

ভাবতে বসলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’-এর কথা একেবারেই আনতে চাইলেন না। বললেন, ‘মানিকদা (সত্যজিৎ রায়) যে রকম খুঁতখুঁতে, তাতে ওই ছবিতে নতুন করে আমি কিছুই যোগ করতে পারতাম না। আমি হয়তোবা “গোলাপী এখন ট্রেনে”টা আর একবার করতে চাইতাম। অসাধারণ একটা সংলাপ ছিল সেই ছবিতে, “আমরা সবাই এক কেলাশের মানুষ।” “আলোর মিছিল” ছবিটাতেও মনে হয় ভালোই করেছিলাম। সে সময় রাজ্জাক ভাই অনেক বড় তারকা। তাঁর সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করা এক কথা, আর তাঁর ভাগনি হওয়া আরেক কথা। অনেকেই আমাকে ছবিটা করতে মানা করেছিলেন। আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে, এ রকম শঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু আমি মিতা ভাইয়ের ছবিটির স্ক্রিপ্ট দেখে বুঝলাম, এ তো অসাধারণ একটি চরিত্র। এটা আমাকে করতেই হবে! তাই আর কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ছবিটা হাতে নিলাম।‌ দর্শক ছবিটা গ্রহণ করল। তবে দ্বিতীয় যে ছবিটা করতে চাইতাম, সেটা “আলোর মিছিল” নয়, “দহন”।’

‘অনেক নায়কের সঙ্গেই অভিনয় করেছেন। আপনি আগেও বলেছেন, তাঁদের সবারই কোনো না কোনো গুণ আপনাকে মুগ্ধ করেছে। তারপরও বলি, যদি তাঁদের মধ্য থেকে দুজন নায়ককে বেছে নিতে বলা হয়, কোন দুজনকে নেবেন?’
‘অবশ্যই রাজ্জাক ভাইকে নেব। আর দ্বিতীয়জন হবেন জাফর ইকবাল।’
‘আর যদি দুজন পরিচালককে বেছে নিতে বলি?’
‘চোখ বন্ধ করে জহির রায়হান আর আমজাদ হোসেনের কথা বলব।’

চিত্রনায়িকা ফরিদা আক্তার ববিতা। ছবি প্রথম আলো

কথোপকথনে স্পষ্ট হয়, একাকিত্ব ও বিষণ্নতার মধ্যে নতুন একটা স্পন্দন যোগ হয়েছে মনে। সে কারণেই আরও কিছু অন্য রকম কথা বলে ফেলেন তিনি। ‘জানেন, ছাদে একটা টবে যে আমগাছটা আছে, ছোট্ট একটা আমগাছ! সেটায় এক দেশি ঘুঘু বাসা বানিয়েছে। সেটা দেখতে প্রায়ই ছাদে যাই হেঁটে হেঁটে। লিফটে না। আমি ওদের ছবিও তুলেছি। প্রায়ই ওদের দেখি আর মন ভালো হয়ে যায়। ঘরে যে ময়নাটা, ওটাও আমাকে পপি পপি ডেকে অস্থির করে তোলে! পাখিগুলো নিয়ে ভালো আছি।’
‘কিন্তু আরও কিছু প্রয়োজন হয় বেঁচে থাকার জন্য। সিনেমা দেখেন না?’

‘ওটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম! মানিকদার সবগুলো ছবি আবার নতুন করে দেখছি। “পথের পাঁচালী” তো বারবার দেখছি। “আগন্তুক”, “তিন কন্যা”, “শাখা প্রশাখা”—যা পাচ্ছি সব দেখছি। এমনকি সন্দীপ রায়ের করা ফেলুদা সিরিজও বাদ রাখছি না। আর বেছে বেছে দেখছি সোফিয়া লরেনের ছবিগুলো। “টু উইমেন” তো বড় পর্দায় দেখেছিলাম আগে। অসাধারণ ছবিটা।’

‘একটা অসাধারণ অভিনয়জীবন পার করেছেন। এখন যারা কাজ করছে, তাদের ব্যাপারে কিছু বলবেন?’
‘আসলে তাদের ব্যাপারে নয়, অভিনয়ের খুঁটিনাটি ঠিক করার ব্যাপারে কিছু বলব। সুভাষ দত্ত‌ ঠিকভাবে কাঁদতে পারছি না বলে সেটে প্রচণ্ড ধমক লাগিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “চোখ দিয়ে কাঁদতে হয় না, কাঁদতে হয় মন দিয়ে।” এরপর নাচের অভিনয় রয়েছে যেখানে, সেটা নিখুঁত করার জন্য গওহর জামিল, রওশন জামিলের কাছে গেছি দুপুরের লাঞ্চ বাদ দিয়ে। “বাঁদী থেকে বেগম” ছবিতে যখন অভিনয় করেছি, অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, ববিতা কি ক্ল্যাসিক্যাল ড্যান্সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে কোথাও? আমরা অভিনয়টাকে নিপুণ করার চেষ্টা করতাম। সেটার প্রতি নজর দিতে বলব এখনকার শিল্পীদের।’

‘কাল তো (৩০ জুলাই) জন্মদিন (কথা হচ্ছিল ২৯ জুলাই দুপুরে)। অনীককে মনে পড়বে বেশি?’

ফরিদা আক্তার ববিতা। ছবি প্রথম আলো


‘জানেন, অনীকের কানাডার বাড়িতে আমার জন্য একটা ঘর আছে। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। সেদিন ফোন করে বলল, “মা, আমি এখন আমার ঘরে ঘুমাই না, তোমার ঘরটায় ঘুমাই। কেন জানো? মনে হয়, এই ঘরে তোমার শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে!”’

ববিতার গলাটা যে ধরে এল, তাতে কোনো অভিনয় ছিল না। তারপর বললেন, ‘কম বয়সে জন্মদিনটাকে মনে হতো একটা দারুণ ব্যাপার। এখন মনে হয়, একটা জন্মদিন মানে তো মৃত্যুর আরও কাছাকাছি চলে যাওয়া। তবুও ভালো, এই পাখিরা, এই চলচ্চিত্র, মাঝে মাঝে লতা মঙ্গেশকরের পুরোনো দিনের গান আমার মনটা ভালো রাখছে।’

আগাম শুভ জন্মদিন জানানো হয়, তিনি বললেন, ‘আসুন, সবাই মিলে প্রার্থনা করি, এই ভয়াবহ সময়টা কেটে যাক।’