স্মরণ

শেষ বাতিঘর

খোন্দকার নূরুল আলম
খোন্দকার নূরুল আলম

খোন্দকার নূরুল আলম সম্পর্কে কিছু লেখা আমার জন্য খুবই কষ্টকর। এভাবে তাঁর মৃত্যুর পর লিখতে হবে তা কখনো ভাবিনি। এমনিতেই সংগীত জগতের কিছু নেপথ্যের বরেণ্য মানুষ, যেমন গীতিকবি, সুরস্রষ্টা ও যন্ত্রসংগীতশিল্পী সম্পর্কে একটি বই লেখার কাজে হাত দিয়েছি। তার মধ্যে খোন্দকার নূরুল আলম, অবশ্যই একজন। এই নামটিতে এসে মনে হলো যে এটি একটি অধ্যয়ে শেষ হওয়ার মতো নয়। কারণ তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি নিয়েই একটা পৃথক বই হতে পারে। যে মানুষটির সঙ্গে সম্পর্ক কাজের পরিধি পেরিয়ে পারিবারিক এবং ধীরে ধীরে আত্মিক হয়ে যায়, তাঁকে নিয়ে কী রেখে কী লিখব সেটা নির্ণয় করাই কষ্টের। আমি এখানে তাঁর কাজের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়েই লিখব।
খোন্দকার নূরুল আলম ভাইকে কখনো দেখিনি, কোনো গানের কবিতা হাতে পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতে। তিনি বারবার ওটা পড়তেন কখনো এক দিন কখনো দুই দিন, কখনো সপ্তাহ লেগে যেত। নিজের মনের মধ্যে সুরটা এসে গেলেই তিনি বসতেন হারমোনিয়মে। এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ‘আমি তো অত প্রতিভাধর নই যে কবিতাটা হাতে পেয়েই সুর এসে যাবে। কবিতার অন্তরে না ঢুকলে কি সুর আসে?’
একবার আমি একটা গানের কবিতা লিখে নিজেই বিপদে পড়ে যাই। কারণ আস্থায়ীর দুটি পঙ্ক্তিতেই এবং অন্তরা শেষের দুটি সেতুবন্ধ পঙ্ক্তিতেই একটা ‘যে’ থাকা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ওই ‘যে’টা বসাতে কিছুতেই মন চাইছিল না। আকাশটা তো নীল চিঠি নয় (যে) জানালা খুলেই আমার লেখা পড়বে। তা ছাড়া গানটির আস্থায়ী এবং দুটি সেতুবন্ধ পঙ্ক্তিতেই একই অন্ত্যমিল (পড়বে) বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছি। খোন্দকার ভাইকে গানটা দেখালে তিনি বেশ কয়েকবার পড়লেন। তারপর কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন। বললেন, ভালো সুর হবে। আমি অন্ত্যমিল এবং ‘যে’ না থাকার কথাটা বললাম। খুব মজা করে হাসলেন, হাত তুলে বোঝালেন. দেখলাম যে সুরে ও গাওয়ায় ওই ‘যে’-এর অনুপস্থিতি কারও কানেই দ্বিধা সৃষ্টি করেনি। আর অন্ত্যমিলের একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে এমনভাবে উচ্চারিত হয়েছে যে তা-ও অতি যথার্থতা পেয়ে গেছে।
মানুষের মার্জিত রুচির ছাপ, যা আধুনিক গানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন, তাঁর সুরে স্পষ্টভাবে তা প্রতিফলিত হতো। জন্মসূত্রে অহমিয়া হওয়ায় আসামের পাহাড়ি সুর তাঁর স্বভাবেই ছিল। তার সঙ্গে বাংলার মাটির সুরও তিনি আয়ত্ত করেছিলেন দক্ষতার সঙ্গে। রাগ সংগীতের সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়গুলো তাঁর দখলে ছিল। এসব ব্যবহারের পরিমিতিবোধ তাঁকে ‘বিশেষ’ করে তুলেছিল। এই বৈশিষ্ট্য যেকোনো বিদগ্ধ শ্রোতাকে যেমন আকৃষ্ট করত, তেমনই সাধারণ শ্রোতারাও তা থেকে রস গ্রহণে বঞ্চিত হতেন না। সে, ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’, ‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে আমার পৃথিবী থেকে’, ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ ইত্যাদি থেকে শুরু করে, ‘জনম জনম ধরে প্রেম-পিয়াসী দুটি আঁখি নিশি জাগে’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে’, ‘এত সুখ সইবো কেমন করে।’ এসব চলচ্চিত্রের গান থেকেই বোঝা যায়।
মৌলিক সুরের ব্যপারে তিনি ছিলেন আপোসহীন। শুধু এই কারণেই তিনি বহু ছবির কাজ প্রত্যাখ্যান করেছেন নির্দ্বিধায়। সুর এবং সংগীতায়োজনে তিনি কখনোই কারও হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না। প্রয়োজনের বাইরে কোথাও একটি টোকাও ছিল তাঁর প্রথাবিরুদ্ধ। বাংলাদেশে সাহিত্যনিভর্র যত চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোর সংগীত পরিচালনার জন্য পরিচালক-প্রযোজকবৃন্দ তাঁরই শরণাপন্ন হয়েছেন। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনের বাইরেও প্রচুর মৌলিক গানে সুর সৃষ্টি করেছেন তিনি। বেতার এবং টেলিভিশনে তাঁর সুরে গান করে প্রচুর শিল্পী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। দেশের গানে তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর সৃষ্টি করা দেশের গানগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, তা স্লোগানধর্মী নয়। দেশের প্রতি গভীর মমতা এবং স্বদেশচেতনার গভীর দর্শন যেসব গানের কবিতায় ফুটে উঠত, যেমন ‘মাঠের কবি বলে এসো নবীন’, ‘স্মৃতি ঝলমল সবুজ মাঠের কাছে’, ‘আমার মন-পাখিটা যায়রে উড়ে যায়’, ‘ফসলের মাঠে মেঘনার তীরে’, ‘যদি মরণের পরে কেউ প্রশ্ন করে’, ‘আমার বাউল মনের একতারাটা’, ‘নদীর ধারেই পথ’, ‘আমি আর কাঁদব না’, ‘স্বাধীনতা তোমার জন্যে’, ‘ওই সূর্য বলেছে আমাকে’, ‘দোয়েল পাখি গান শুনিয়ে ঘুম ভাঙায়’, ‘বাংলা আমার প্রাণের ভাষা’, ‘দু নয়ন ভরে যত দেখি তারে’ ইত্যাদি প্রায় হাজারখানেক গান তাঁকে বেঁধে রেখেছে বাংলাদেশের হৃদয়বীণায়।
সত্তর-আশির দশকে আগত ভালো গীতিকবিদের মধ্যে বিতর্ক হতে দেখেছি, কার কয়টা লেখায় খোন্দকার ভাই সুরারোপ করেছেন, তা নিয়ে। ওটাই যেন ভালো লেখার মানদণ্ড।
‘নীরবতা শুধু ঢেকে রয় যেন অপরূপ নীরবতা’ এই গানের কবিতায় যে সুর তিনি করেছিলেন, মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের কণ্ঠে তা যে ধ্বনি তুলেছিল, তা শুনে এই গানের কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেছিলেন, ‘সুর সার্থক হলে কবিতা যে কতটা ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠতে পারে, এটাই হয়তো তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।’ কবি শামসুর রাহমান বলতেন, ‘শুধু খোন্দকার সাহেবের সুরের আকর্ষণে আমি গান লিখতে উৎসাহিত বোধ করি।’
আজ বাংলাদেশের সংগীতজগৎ যা হারিয়েছে, তা পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে দৃশ্যমান নয়। মার্জিত রুচির এমন শিক্ষিত সংগীতগুণী সব সময় ঝাঁকে ঝাঁকে আসেন না।