Thank you for trying Sticky AMP!!

হারিয়ে গেছে খুঁজে পাব না...

বিনোদন অঙ্গন থেকে এ বছর যাঁরা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন, তাঁদের কেউ লম্বা সময় ধরে অসুস্থ ছিলেন। কেউবা করোনার ধাক্কা সামলাতে পারেননি। চলচ্চিত্র, টেলিভিন নাটক ও সংগীতাঙ্গনের গুণীদের হারিয়ে বিপর্যস্ত দেশের বিনোদন অঙ্গনও। পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে অনেকে শোকাচ্ছন্ন। জেনে নিই, ২০২১ সালে আমরা শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে কোন কোন গুণী আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন।

এ টি এম শামসুজ্জামান

এ টি এম শামসুজ্জামান
৮০ বছর বয়সে এ বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি শনিবার সকাল আটটায় নিজ বাসায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন চলচ্চিত্রের বরেণ্য অভিনয়শিল্পী এ টি এম শামসুজ্জামান। বেশ কয়েক বছর ধরে নানা শারীরিক সমস্যায় ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল রাতেও বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতাল–বাসা, বাসা–হাসপাতাল—ভাবেই কাটছিল তাঁর দিনকাল। ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে জানা যায়, তিনি মারা গেছেন। ১৯৪৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এ টি এম শামসুজ্জামান। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ভোলাকোটের বড়বাড়ি আর ঢাকায় থাকতেন দেবেন্দ্র নাথ দাস লেনে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পোগোজ স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহীর লোকনাথ হাইস্কুলে। তাঁর বাবা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা উকিল এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে শামসুজ্জামান ছিলেন বড়। এ টি এম শামসুজ্জামানের চলচ্চিত্রজীবনের শুরু ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে। প্রথম কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের জন্য। অভিনয়ের জন্য আজীবন সম্মাননাসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ছয়বার। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন নন্দিত এ অভিনেতা। দেশের শিল্পানুরাগী মানুষের মনে তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন।

সারাহ বেগম কবরী

সারাহ বেগম কবরী
অসম্পূর্ণ অনেক কাজ, অনেক স্বপ্ন রেখেই এ বছরের ১৭ এপ্রিল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন বাংলার অন্যতম সেরা অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। ঢাকার সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’ কবরী সক্রিয় ছিলেন সিনেমায়। ক্যামেরার সামনে থেকে চলে গিয়েছিলেন পেছনে, পরিচালকের আসনে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৩ দিনের মাথায় তিনি পাড়ি জমান অনন্তের পথে। খুসখুসে কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে করোনার নমুনা পরীক্ষায় দেন সারাহ বেগম কবরী। ৫ এপ্রিল দুপুরে পরীক্ষার ফল হাতে পেলে জানতে পারেন, তিনি করোনা পজিটিভ। ওই রাতেই তাঁকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭ এপ্রিল দিবাগত রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। পরদিন ৮ এপ্রিল দুপুরে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে কবরীর জন্য আইসিইউ পাওয়া যায়। এরপর তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় কবরীর। ১৯৬৫ সালে অভিনয় করেন ‘জলছবি’ ও ‘বাহানা’য়, ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘আবির্ভাব’, ‘বাঁশরি’, ‘যে আগুনে পুড়ি’। ১৯৭০ সালে ‘দীপ নেভে নাই’, ‘দর্পচূর্ণ, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বিনিময়’ ছবিগুলো। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। সেখান থেকে পাড়ি জমান ভারতে। কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন কবরী। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ২০০৫ সালে ‘আয়না’ নামের একটি ছবি নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন কবরী। এরপর রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্ত হয়েছেন অসংখ্য নারী অধিকার ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭-তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে জন্মগ্রহণ করেন কবরী। তাঁর আসল নাম ছিল মিনা পাল। বাবা শ্রীকৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। এরপর টেলিভিশন ও সবশেষে সিনেমায়। কবরী বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করেন সফিউদ্দীন সরোয়ারকে। ২০০৮ সালে তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। কবরী পাঁচ সন্তানের মা। সবশেষ সরকারি অনুদানের ‘এই তুমি সেই তুমি’ চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন ঢাকাই ছবির এই ‘মিষ্টি মেয়ে’।

ফকির আলমগীর গানের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখিও করতেন

ফকির আলমগীর
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৭১ বছর বয়সে গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর এ বছরের ২৩ জুলাই মারা যান। কোভিড ইউনিটে ভেন্টিলেশনে থাকা অবস্থায় ফকির আলমগীরের হার্ট অ্যাটাক হয়। ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় দিনটিতে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. হাচেন উদ্দিন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেসা। শিল্পী কালামৃধা গোবিন্দ হাইস্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ফকির আলমগীর ষাটের দশক থেকে সংগীতচর্চা করেছেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি বংশীবাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিনি তাঁর গান দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ১৯৬৬ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী ও গণশিল্পীগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে ষাটের দশকে বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামে এবং উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানে গণসংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। গণ–অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের সামরিক শাসনবিরোধী গণ–আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন তাঁর গান দিয়ে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করার জন্যই দেশজ সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ও তাঁর সময়ের কয়েকজন শিল্পী শুরু করেছিলেন প্রথম বাংলা পপ ধারার গান। বাংলা পপগানের বিকাশেও তাঁর রয়েছে বিশেষ অবদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা ফকির আলমগীর গানের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখিও করেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বিজয়ের গান’, ‘গণসংগীতের অতীত ও বর্তমান’, ‘আমার কথা’, ‘যাঁরা আছেন হৃদয়পটে’সহ বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। সংগীতের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য এ পর্যন্ত পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় ‘একুশে পদক’, ‘শেরেবাংলা পদক’, ‘ভাসানী পদক’, ‘সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার’, ‘তর্কবাগীশ স্বর্ণপদক’, ‘জসীমউদ্‌দীন স্বর্ণপদক’, ‘কান্তকবি পদক’, ‘গণনাট্য পুরস্কার’, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মহাসম্মাননা’, ‘ত্রিপুরা সংস্কৃতি সমন্বয় পুরস্কার’, ‘ঢালিউড অ্যাওয়ার্ড যুক্তরাষ্ট্র’, ‘জনসংযোগ সমিতি বিশেষ সম্মাননা’, ‘চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড বিশেষ সম্মাননা’ ও ‘বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ’।

মিতা হক

মিতা হক
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১১ এপ্রিল সকালে ৫৯ বছর বয়সে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী মিতা হক মারা যান। মিতা হক পাঁচ বছর ধরে কিডনি রোগেও ভুগছিলেন। নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিয়ে ভালোও ছিলেন তিনি। কিন্তু এবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। মিতা হকের জন্ম ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায়। তিনি প্রয়াত অভিনেতা খালেদ খানের স্ত্রী। তাঁর চাচা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক ও রবীন্দ্র গবেষক ওয়াহিদুল হক। মেয়ে জয়িতাও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। মিতা হক প্রথমে তাঁর চাচা ওয়াহিদুল হক এবং পরে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান ও সন্‌জীদা খাতুনের কাছে গান শেখেন। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি তবলাবাদক মোহাম্মদ হোসেন খানের কাছে গান শেখা শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশ বেতারের সর্বোচ্চ গ্রেডের তালিকাভুক্ত শিল্পী। ১৯৯০ সালে বিউটি কর্নার থেকে প্রকাশিত হয় মিতা হকের প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘আমার মন মানে না’। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় ২০০টি রবীন্দ্রসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন মিতা হক। তাঁর এককভাবে মুক্তি পাওয়া মোট ২৪টি অ্যালবাম আছে। এর মধ্যে ১৪টি ভারত থেকে ও ১০টি বাংলাদেশ থেকে। তিনি ২০১৬ সালে শিল্পকলা পদক লাভ করেন। সংগীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০২০ সালে একুশে পদক প্রদান করে।। ‘সুরতীর্থ’ নামে একটি গানের স্কুলও রয়েছে তাঁর। একসময় ছায়ানটের রবীন্দ্রসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদের সহসভাপতিও ছিলেন।

জানে আলম

জানে আলম
‘একটি গন্ধমেরও লাগিয়া’, ‘স্কুল খুইলাছে রে মাওলা’, ‘দয়াল বাবা কেবলা কাবা’সহ অনেক গানের শিল্পী জানে আলম ২ মার্চ মারা যান। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। জন্মস্থান মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে পারিবারিক কবরস্থানে চিরশায়িত হন নন্দিত এই শিল্পী। মৃত্যুর এক মাস আগে জানে আলম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এরপর করোনা নেগেটিভ হলেও নিউমোনিয়াসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন। এর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। এরপর আর শেষরক্ষা হয়নি। জানে আলম শুধু কণ্ঠশিল্পীই নন, তিনি একজন সুরকার, গীতিকার, প্রযোজকও ছিলেন। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম দোয়েল প্রোডাক্টস। সত্তরের দশকে পপ ও ফোকের মিশ্রণে গান তৈরি করে জানে আলম তুমুল জনপ্রিয়তা পান। ঢাকা রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম ‘বনমালী’ দিয়ে তৈরি হয় ভালো পরিচিতি। সেই লং প্লে সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে ‘একটি গন্ধমের লাগিয়া’, ‘স্কুল খুইলাছে রে মাওলা’, ‘কালি ছাড়া কলমের মূল্য যে নাই, ফুল ছাড়া ফাগুনের নামটাই বৃথা’, ‘তুমি পিরিতি শিখাইয়া’, ‘দয়াল বাবা কেবলা কাবা’ প্রভৃতি। বাংলা গান নিয়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। পপসংগীতের মধ্যে লোক ধাঁচ ও অধ্যাত্মবাদ যুক্ত করে গান করা তাঁর বৈশিষ্ট্য। সত্তরের দশকে স্বাধীন বাংলাদেশে পপগানের চর্চা করে যে কয়জন শিল্পী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ফিরোজ সাঁই, আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ ও জানে আলমের নাম বেশি উচ্চারিত হয়। জানে আলমের গাওয়া, লেখা ও সুর করা গানের সংখ্যা চার হাজারের মতো। ৮০টির বেশি একক গানের অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে তাঁর। জানে আলমের সুরারোপিত গান গেয়েছেন ফরিদা পারভীন, সামিনা চৌধুরী, মমতাজ, মনির খান, এসডি রুবেল প্রমুখ শিল্পী। সামিনা চৌধুরীর প্রথম একক অ্যালবামের প্রকাশক তিনি।

ইনামুল হক

ইনামুল হক
অভিনেতা, নির্দেশক, নাট্যকার ইনামুল হক ১১ অক্টোবর হঠাৎ করেই মারা যান। এদিন বিকেল চারটায় বেইলি রোডের বাসায় তিনি মারা যান। ইনামুল হক স্ত্রী ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ইনামুল হকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৯ মে ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নে। তাঁর বাবা ওবায়দুল হক ও মা রাজিয়া খাতুন। ইনামুল হকের পুরো পরিবারই নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তাঁর স্ত্রী লাকী ইনাম নাট্যজগতেরই মানুষ। তাঁদের সংসারে দুই মেয়ে হৃদি হক আর প্রৈতি হক। দুই জামাতা অভিনেতা লিটু আনাম ও সাজু খাদেম। ফেনী পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে তিনি বিএসসি ও এমএসসি সম্পন্ন করেন। পরে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি লাভ করেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘ ৪৩ বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার সময় ১৫ বছর রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং দুই বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নটর ডেম কলেজে পড়াশোনাকালে তিনি প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন। ফাদার গাঙ্গুলীর নির্দেশনায় তখন তিনি ‘ভাড়াটে চাই’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। দলটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ইনামুল হক। এ দলের হয়ে প্রথম তিনি মঞ্চে অভিনয় করেন আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে। এরপর এ দলের হয়ে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’সহ বহু নাটকে অভিনয় করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে তিনি এ দল থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’। মৃত্যুর আগপর্যন্ত দলটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন গুণী এই নাট্যজন।

ওয়াসিম

ওয়াসিম
ঢাকাই সিনেমার একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক ওয়াসিম এ বছরের ১৮ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭১ বছর বয়সে মারা যান। মোহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নায়ক হিসেবে রুপালি পর্দায় অভিষেক হয় ওয়াসিমের। এরপর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া এস এম শফী পরিচালিত ‘দ্য রেইন’ সিনেমাটি তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে শীর্ষ অভিনেতাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। সমগ্র অভিনয়জীবনে ১৫২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন ওয়াসিম। ওয়াসিম অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো ‘দ্য রেইন’, ‘ডাকু মনসুর’, ‘জিঘাংসা’, ‘কে আসল কে নকল’, ‘বাহাদুর’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘মানসী’, ‘দুই রাজকুমার’, ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘ইমান’, ‘রাতের পর দিন’, ‘আসামি হাজির’, ‘মিস ললিতা’, ‘রাজদুলারী’, ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’, ‘লুটেরা’, ‘লাল মেম সাহেব’, ‘বেদ্বীন’, ‘জীবন সাথী’, ‘রাজনন্দিনী’, ‘রাজমহল’, ‘বিনি সুতার মালা’, ‘বানজারান’ প্রভৃতি। অভিনেতা ওয়াসিম বেশ কিছুদিন ধরেই কিডনি, ফুসফুস, উচ্চ রক্তচাপ ও চোখের জটিল সমস্যায় ভুগছিলেন। হাঁটতে পারতেন না বলে বিছানায় শুয়ে-বসে দিন কাটত তাঁর। ওয়াসিম অভিনয় করেছেন অলিভিয়া, অঞ্জু ঘোষ ও শাবানার সঙ্গে। তাঁর ‘দ্য রেইন’ সিনেমায় নায়িকা ছিলেন অলিভিয়া। এরপর ‘বাহাদুর’, ‘লুটেরা’, ‘লাল মেম সাহেব’, ‘বেদ্বীন’ সিনেমাগুলোতেও তিনি অলিভিয়ার সঙ্গে অভিনয় করেন। ‘রাজদুলালী’ ছবিতে শাবানার সঙ্গে তাঁর অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল। অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে ওয়াসিম অভিনয় করেছেন ‘সওদাগর’, ‘নরম গরম’, ‘আবেহায়াত’, ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘রসের বাইদানী’সহ বেশ কিছু সিনেমায়।

ইন্দ্রমোহন রাজবংশী

ইন্দ্রমোহন রাজবংশী
এ বছরের ৭ এপ্রিল মারা যান একুশে পদকপ্রাপ্ত লোকগানের শিল্পী ও সংগীতগুরু ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। এদিন বেলা ১১টার দিকে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তার আগে শারীরিক অসুস্থতা অনুভূত হলে শুরুতে ইন্দ্রমোহন রাজবংশীকে ঢাকার মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করানো হয় এবং ফলাফল পজিটিভ হয়। এ ছাড়া বুকের সিটিস্ক্যান রিপোর্টে তাঁর ফুসফুসে ৮৫ শতাংশ ইনফেকশন ধরা পড়ে। এরপর ঢাকার আরেকটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরিস্থিতির অবনতি হলে হাসপাতাল বদল করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ইন্দ্রমোহন রাজবংশী ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মুর্শিদিসহ বিভিন্ন ধরনের গান গাইতেন। তিনি সরকারি সংগীত কলেজে লোকসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। তিনি বাংলাদেশ লোকসংগীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা। চলচ্চিত্র, বেতার ও টেলিভিশন অনেক গান গেয়েছেন তিনি। ১৯৬৭ সালে ‘চেনা–অচেনা’ চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্লেব্যাক শুরু করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ইন্দ্রমোহন রাজবংশী যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য মনস্থির করেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ায় সম্মুখযুদ্ধে তিনি যেতে পারেননি। পাকিস্তানিরা সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করায় ইন্দ্রমোহন রাজবংশী নিজের নাম–পরিচয় গোপন করে পাকিস্তানিদের দোভাষী হিসেবে কাজ করেন কিছুদিন। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে চলে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গাওয়া শুরু করেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকগান সংগ্রহ করতেন তিনি। এক হাজারের বেশি কবির লেখা কয়েক লাখ গান সংগ্রহ করেছেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে একুশে পদক লাভ করেন ইন্দ্রমোহন রাজবংশী।

তা ছাড়া এ বছরে অভিনয়শিল্পী শাহীন আলম, মাহমুদ সাজ্জাদ, ‘ঢাকা ৮৬’ খ্যাত চলচ্চিত্রকার শফিকুর রহমান, ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক কামরুল, অভিনয়শিল্পী শামীম ভিস্তি, নৃত্য পরিচালক সুমন রহমান, সংগীত পরিচালক ফরিদ আহমেদ, নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা কায়েস চৌধুরীকে হারিয়েছে দেশের বিনোদন অঙ্গন।