হুমায়ূন বলছেন, ফেরদৌস শটটা দাও তো

হ‌ুমায়ূন আহমেদের একটি নাটক ‘এসো’ ও দুটি চলচ্চিত্র ‘চন্দ্রকথা’ ও ‘আমার আছে জল’-এ অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, যার বেশির ভাগই শুটিং হয়েছে গাজীপুরের নুহাশপল্লীতে। সেই সব স্মৃতিময় দিন স্মরণ করতেই গত সোমবার ফেরদৌস গিয়েছিলেন নুহাশপল্লীতে। স্মরণ করেছেন তাঁর প্রিয় স্যারকে। হ‌ুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘আনন্দ’র পাঠকদের জন্য সেই কথা তুলে ধরেছেন মনজুর কাদের

হ‌ুমায়ূন আহমেদের মুর‍্যালের পাশে খালি পায়ে দাঁড়ালেন অভিনেতা ফেরদৌস। ছবি তুললেন। নেমে এসে তাকালেন মুর‍্যালের দিকে। তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে এল সম্ভবত। পকেট থেকে টিস্যু বের করলেন। দূরে লীলাবতী দিঘি। টিস্যু হাতেই লীলাবতী দিঘির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন ফেরদৌস। ঘাটের পাড়ে বসে খুললেন গল্পের ঝাঁপি। জ্যোৎস্না ও বৃষ্টিপ্রিয় জনপ্রিয় লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদের হাতে গড়া নুহাশপল্লীতে আসার আগে বৃষ্টি ভিজিয়েছে আমাদের। দিঘিজুড়ে সেই বৃষ্টির ছাপ।

নুহাশপল্লীতে হ‌ুমায়ূন আহমেদের মুর‍্যালের পাশে ফেরদৌস। ছবি: খালেদ সরকার
নুহাশপল্লীতে হ‌ুমায়ূন আহমেদের মুর‍্যালের পাশে ফেরদৌস। ছবি: খালেদ সরকার

গত সোমবার এ অভিনেতা গিয়েছিলেন নুহাশপল্লীতে। তাঁর সঙ্গী হয়েছিল প্রথম আলো। যেতে যেতে অনেক কথাই বললেন। জানালেন হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে পরিচয়ের গল্প—‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বইমেলায় অটোগ্রাফ নিতে গিয়েছিলাম। ওই সময়ই স্যারকে প্রথম দেখা। তবে আগুনের পরশমণি সিনেমার শুটিংয়ের সময় পরিচয় হয়। ফিল্ম সোসাইটি করতাম তো, তাই এফডিসিতে গিয়েছিলাম সেদিন। নৃত্যপরিচালক আমির হোসেন বাবু ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন স্যারের সঙ্গে।’ এরপর অনেক দিন কোনো দেখা নেই। ১৯৯৮ সালে ফেরদৌসের হঠাৎ বৃষ্টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এই সময় একদিন হ‌ুমায়ূন আহমেদ ফোন করলেন ফেরদৌসকে। জানতে চাইলেন নাটক করবেন কি না? ফেরদৌস শুরু থেকে নাটক না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ওই দিন স্যারকেও সুন্দর করে বুঝিয়েও বলেছিলেন। কিন্তু শেষমেশ মায়ের কথায় রাজি হন ফেরদৌস। পরে ফোন করে বলতেই স্যার ফেরদৌসকে বলেছিলেন, ‘তোমরা তো বোঝো না। আরে গল্প তো তোমাকে নিয়ে। আচ্ছা, আসো একদিন, গল্প নিয়ে কথা বলি।’ তারপর ধানমন্ডির দখিন হাওয়ায় গিয়েই কথা হয়েছে হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। এত দিন বাদে নুহাশপল্লীতে বসে এই গল্প বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ফেরদৌস।

ভূতের দাঁত

হাঁটতে হাঁটতে নিয়ে গেলেন পল্লীর এক পাশে। যেখানে দাঁড়িয়ে হ‌ুমায়ূন আহমেদের নির্দেশনায় প্রথম শট দিয়েছিলেন চন্দ্রকথা সিনেমায়। তবে সেই শটের চেয়ে ফেরদৌস বেশ মজা করে বললেন প্রথম দিন নুহাশপল্লীতে আসার স্মৃতি—‘এখানে আসার পর ভূত নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। প্রথম দিন আমি বাথরুমে বেসিনে গিয়ে দেখতে পেলাম, মানুষের দাঁত খুলে রাখা। দেখেই চিৎকার করে উঠলাম। স্যার বললেন, “ফেরদৌস, ভূত নাকি?” পরে আস্তে আস্তে জানতে পারলাম, যখনই ভূতের ভয় দেখানোর ব্যাপারগুলো ঘটত, তখন স্যার কাছাকাছি থাকতেন না। স্যার নিজেই এসব ঘটাতেন। আনন্দ দেওয়ার জন্যই এমনটা করতেন বলে শুনেছি।’ গল্প বলতে বলতে এক ফাঁকে দেখালেন সেই বেসিনটাও।

ব্যায়াম করতে দাবার বোর্ড

পল্লীর বাড়ি ‘বৃষ্টি বিলাস’-এ খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলেন অভিনেতা। বৃষ্টি শেষে ততক্ষণে নুহাশপল্লীর আকাশে ঝকঝকে রোদ। বিশ্রাম শেষে বারান্দায় দাঁড়াতেই ফেরদৌস ইশারা করলেন কিছু একটা দেখতে। হাতের ইশারা ধরে চোখ ফেলতেই দেখা মিলল মস্ত বড় দাবার বোর্ড। সেটা নিয়ে আস্ত একটা গল্পের ঝাঁপি খুললেন ফেরদৌস। যার সারসংক্ষেপ হলো—‘দাবার এত বড় বোর্ড ও বড় বড় ঘুঁটি এর আগে দেখিনি। স্যার যখন ছিলেন, তখন খুবই মজা করে আমরা খেলতাম। খেলার চেয়ে শুটিংয়ের ফাঁকে অবসর সময় কাটানোই মুখ্য ছিল। মজার ব্যাপার হলো, দাবার এত বড় ঘুঁটি চালতে গিয়ে আমাদের এক্সারসাইজ হয়ে যেত। আর হারজিতের কোনো ব্যাপার এখানে ছিল না।’

এক ফাঁকে গাছঘরে উঠে বসলেন ফেরদৌস

গাছঘরে এক বেলা

দাবার বোর্ডের কাছেই গাছঘর। কয়েক বছর আগে পরিবার নিয়ে ফেরদৌস এসেছিলেন এখানে। তখন তাঁর সন্তানেরা নাকি গাছের ওপর নির্মিত এই ঘর দেখে ভীষণ মজা পেয়েছিল। এত দিন পর ফেরদৌস গাছঘর দেখে নিজের সন্তানের মতোই আচরণ শুরু করলেন। বেয়ে উঠলেন সিঁড়ি। তারপর ফটোগ্রাফারকে বললেন ক্যামেরার শাটার চাপতে। নেমে এসে বললেন, ‘আমি শুটিংয়ের সময় যতবারই এসেছি, এই গাছঘরে বিকেলে বসে থাকতাম। আর চা খেতে মন চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই চলে আসত গরম চা। এটাই একমাত্র ঘর, যেখানে গেলে আমার শিশু হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। গাছের ওপর এমন ঘর থাকে, তা এই পল্লীতে না এলে বুঝতে পারতাম না। মজার ব্যাপার হলো, স্যারের মধ্যেও ছোট্ট একটা শিশু বাস করত। আমরা কাজ করতে গিয়ে সেটা টের পেয়েছিলাম।’

পাঁচ বছর ধরে এই শিশুসুলভ মানুষটি শুয়ে আছেন নুহাশপল্লীতে। ফেরদৌস বললেন, ‘নুহাশপল্লীতে পা রাখলেই আমার মনে হয়, এখানে স্যার আছেন। হুট করে আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, “ফেরদৌস, এবার ঠিকঠাক শটটা দাও তো।”’