অতিথি

হৃদয়ে যার মণিপুরি নাচ

কলাবতী দেবী ছবি: খালেদ সরকার
কলাবতী দেবী ছবি: খালেদ সরকার

হওয়ার কথা ছিল পুরোদস্তুর গানের মানুষ। কিন্তু পথ বেঁকে তা চলে গেল নাচে। মণিপুরি নাচের অন্যতম কিংবদন্তি কলাবতী দেবীর কথা বলা হচ্ছে। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এ নৃত্য নিয়ে যে গুণীরা বিস্তর কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি একজন। ভারতের মণিপুরে জন্ম নেওয়া এই নৃত্যগুরু সম্প্রতি এসেছিলেন বাংলাদেশে, নৃত্যদল ‘ভাবনা’র আমন্ত্রণে একটি কর্মশালা পরিচালনা করতে। সে সময়ই এই শিল্পী কথা বললেন তাঁর শিল্পীজীবন আর ভাবনা নিয়ে।
কথার শুরুতেই কলাবতী দেবী তাঁর জীবনের সেই সময়ের কথা বললেন, যখন তিনি ছিলেন নৃত্যগুরু বিপিন সিংয়ের শিষ্য। ভোরবেলা থেকে শুরু হতো তাঁদের নৃত্য সাধনা, চলত রাত পর্যন্ত। গুরুর জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিল শিষ্যরা।
আর এখন? এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিতেই কলাবতী দেবী গম্ভীর মুখে বললেন, এখন আর সেই চর্চা দেখা যায় না। সামিনা হোসেন প্রেমার দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওদের সময় পর্যন্ত দেখা যেত গুরুর প্রতি একাগ্র থাকার চর্চাটা। কিন্তু আর তেমন নেই। এখনকার বাচ্চারা গুরুর প্রতি একাগ্র থাকা কিংবা শিল্পের সাধনার পেছনে সময় দিতে চায় না। তাদের মন নানান দিকে ঘোরে। টেলিভিশন, কম্পিউটার, মুঠোফোন—এসবই তাদের সময়টাকে বিভক্ত করে দেয়।’ ওদের সময় বলতে কলাবতী দেবী বোঝাচ্ছিলেন নব্বই দশকের শুরুর দিকের কথা। ছায়ানটের শিক্ষার্থীদের মনিপুরী নাচের পাঠ দিতে তিনি তখন প্রায়ই বাংলাদেশে আসতেন।
লম্বা সময়ের আলাপে কলাবতী দেবী কয়েকবার বললেন, নৃত্য গুরুমুখী বিদ্যা। এই বিদ্যায় পারঙ্গম হওয়ার জন্য সাধনা আর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা অপরিহার্য। একই কথার জের ধরে নৃত্যশিল্পী প্রেমা বললেন, ‘গুরুকে নিজের ভেতর ধারণ করতে হয়, তাহলে সাধনা সফল হয়। আমাদের কাছে যেমন কলাবতী দেবী।’
লম্বা নৃত্যজীবনে কলাবতী দেবী নিজেই অনেক কিংবদন্তি নৃত্যগুরুর শিষ্য ছিলেন। জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে তাঁর গুরুদের সান্নিধ্যে। আর এখন তিনিই হলেন শত শত নৃত্যশিল্পীর অনুপ্রেরণা, তাদের শিক্ষাগুরু। বাংলাদেশে আছে কলাবতী দেবীর একনিষ্ঠ কয়েকজন শিষ্য। তাদের প্রসঙ্গ আনতেই চোখ যেন চিকমিক করে ওঠে তাঁর। বোঝাই যায়, নিজের শিষ্যদের নিয়ে কতটা গর্ব এই শিল্পীর। এ দেশে কলাবতী দেবী তাঁর শিক্ষার্থীদের কথা মনে করে বললেন, ‘প্রতিবারই আমি এখানে এসে এখানকার শিল্পীদের ভেতর নাচের প্রতি একটা বিশেষ আগ্রহ খুঁজে পেয়েছি। এখানে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, তামান্না রহমান, ওয়ার্দা রিহাব, প্রেমা—সবাই এত ভালোবেসে মণিপুরি নাচটা করছে, যা আমাকে গর্বিত করে। আমি অনেক ভাগ্যবতী, ওদের মতো শিল্পীদের শেখাতে পেরে।’
কলাবতী দেবীর ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি অধ্যায়েই জড়িয়ে আছে মণিপুরি নাচ। জীবনের একপর্যায়ে এসে নৃত্যগুরু বিপিন সিংকেই পেয়ে যান জীবনসঙ্গী হিসেবে। তারপর তাঁর নৃত্যচর্চার পথটা হয়ে ওঠে আরও প্রসারিত। এই একটি নৃত্যধারা নিয়েই কলাবতী দেবী ঘুরেছেন নানান দেশে। অর্জন করেছেন নানান সম্মাননা। কলাবতী দেবী তাঁর মেয়ে বিম্বাবতী দেবীর মনেও বুনেছেন মণিপুরি নাচকে ভালোবাসার বীজ। তাঁর মেয়েও এখন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মণিপুরি নাচের ঘরানায়। বিপিন সিং ও কলাবতী দেবীর হাতে গড়া ভারতের মণিপুরি নর্তনালয়ের সঙ্গেও জুড়েছে মেয়ে বিম্বাবতীর নাম। এখন মণিপুরি নাচের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের একটি এটি। ভারতের তিনটি রাজ্যে রয়েছে এর শাখা। কলাবতী দেবী এখনো সেই প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতিনিয়ত নিজের সময় আর সাধনা বিনিয়োগ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এরপরও নাকি নিজেকে কখনোই তৃপ্ত মনে করেন না তিনি। কথার শেষে এসে বললেন, ‘এ পর্যন্ত যাদেরই মণিপুরি নাচের শিক্ষা দিতে পেরেছি, সেটাই জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করি। কারণ, মণিপুরি নাচ হলো অনেক সময় আর সাধনার ব্যাপার। ক্ষুদ্র এই জীবনে এতটুকু শিক্ষাও যদি কাউকে দিতে পারি, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হতে পারে না। তাই মণিপুরি নাচের শিক্ষা এমন করেই দিয়ে যেতে চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, তাহলেই হয়তো শেষ জীবনে গিয়ে তৃপ্ত হতে পারব।’