তখনো ডিজিটাল জমানা আসেনি। গ্রামগঞ্জে ভিসিআর চালিয়ে চলচ্চিত্র দেখানোর চল; টিকিট পাঁচ টাকা। নব্বইয়ের দশকে স্কুল পালিয়ে সিরাজগঞ্জের জামতৈল বাজারে ‘নুন শো’তে দেখা ‘শোলে’ কিশোর মনে যতটা আঁচড় কেটেছিল, আজ এত বছর পরেও তা খুব একটা ফিকে হয়নি।
৫০ বছর। কোনো চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা পরিমাপে সময়ের এই হিসাবের চেয়ে জুতসই মাপকাঠি আর কীই–বা হতে পারে! এখনো দর্শককে যেভাবে আবিষ্ট করে রেখেছে ‘শোলে’—আবেগে, মুগ্ধতায় তার তুলনা কেউ কেউ ক্ল্যাসিক সাহিত্য বা শিল্পের সঙ্গে টানতে পারেন। এককথায় একে বলিউডের ‘আলটিমেট ফিল্ম’ বললে এতটুকু অত্যুক্তি হবে না। ‘শোলে’ শুধু চলচ্চিত্রই নয়, এটি ভারতীয় সিনেমার মিথ।
রমেশ সিপ্পি পরিচালিত চলচ্চিত্রটিকে শুরুতে সাধারণ অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার বলেই মনে করা হয়েছিল। তবে কালের চাকায় সমানতালে দৌড়ে এসে এটি এখন ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী এক নির্মাণ। এর সঙ্গে জুড়ে গেছে ‘কালজয়ী’র তকমা। বহুবার দেখেও তাই পুরোনো হয় না।
কেন এখনো ‘নতুন’? কেননা ‘শোলে’ একটি বৃহৎ সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। এটিকে বলা চলে একটি পূর্ণাঙ্গ ‘মাসালা ফিল্ম’; যেখানে রোমাঞ্চ, কমেডি, অ্যাকশন, ট্র্যাজেডি, প্রেম, প্রতিশোধ, সর্বোপরি সুর-অসুরের দ্বন্দ্ব—কী নেই! ‘স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন’ ঘরানার প্রভাব স্পষ্ট, বিশেষ করে এই ঘরানার জনক সার্জো লেওনের চলচ্চিত্র থেকে যে অনুপ্রাণিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আলাদা করে বলার কথাটি হলো ইতালীয় সেই ঘরানাকে পুরোপুরি ভারতীয় বাস্তবতায় রূপান্তরের দুর্দান্ত এক উদাহরণ ‘শোলে’। সেলিম–জাভেদ জুটির চমৎকার চিত্রনাট্যে মহাভারতীয় নৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতীকী উপস্থাপন সমসাময়িক ভারতীয় সমাজবাস্তবতার দারুণ এক প্রতিরূপ।
চলচ্চিত্রটির পটভূমি গ্রামীণ—‘রামগড়’ নামের কাল্পনিক এক গ্রাম। যেখানে রাষ্ট্রের রাশ আলগা, সেখানে জুলুমের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে ব্যক্তি থেকে সামষ্টিকের প্রতিরোধের দেয়াল। ঠাকুর বলদেব সিংয়ের (সঞ্জীব কুমার) মাধ্যমে সেই দৃঢ় নৈতিক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ চলচ্চিত্রটির ‘প্রাণভোমরা’।
শোলের অন্যতম শক্তিশালী দিক এর চরিত্রায়ণ। জয় ও বীরু—অমিতাভ বচ্চন ও ধর্মেন্দ্র অভিনীত চরিত্র দুটির রসায়ন ভারতীয় চলচ্চিত্রে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাই যেন বদলে দিয়েছে। একজন সংযত, ধীর; আরেকজন উচ্ছল ও প্রগলভ—অথচ তাঁদের দোস্তি দিলের দরদ থেকে দায় মেটানোর। হেমা মালিনী অভিনীত বাসন্তী হাস্যরসের মধ্যেও দুঃসাহস ও আত্মমর্যাদার প্রতিমূর্তি। জয়া ভাদুড়ির বিধবা রাধা তাঁর শোক, একাকিত্ব দর্শকহৃদয়কে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে ‘শোলে’কে অমর করেছে গব্বর সিং। আমজাদ খান অভিনীত চরিত্রটি খলনায়কের নতুন সংজ্ঞা। তাঁর কিছু সংলাপ—‘কিতনে আদমি থে’, ‘হোলি কব হ্যায়’, ‘তেরা কিয়া হোগা কালিয়া’, ‘আব গোলি খা’, ‘যো ডর গয়া সমঝো মর গয়া’, ‘ইয়ে হাত হামকো দে দে ঠাকুর’ ইত্যাদি যেমন ভোলা যায় না, তেমনি আলাদাভাবে নজর কাড়ে তাঁর বাচনভঙ্গি, হাঁটাচলার ধরন। গব্বর সিং নিছক এক ডাকু সরদারই নন— রাজনৈতিক-সামাজিক ‘শূন্যতা’র প্রতীক; রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও নৈতিক স্খলনের যোগফল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তি পায় শোলে। স্বাধীনতা দিবস হওয়ায় ভারতের ইতিহাসে দিনটি যেমন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
চলচ্চিত্রটির মুক্তির দিনক্ষণ নিয়ে রয়েছে আরেকটি ‘সমাপতন’। ভারতে তখন জরুরি অবস্থা। তেমন দমবন্ধ সময়ে ‘শোলে’র মুক্তি প্রেক্ষাপটের চেয়েও যেন অধিক প্রতীকী হয়ে উঠেছিল। একটি প্রান্তিক জনপদ, একজন জুলুমবাজ শাসক, একজন প্রতিবাদী মানুষের (প্রতিশোধপরায়ণও বটে) নেতৃত্বে সমবায়ী প্রতিরোধ—এই গল্প সমাজবাস্তবতার ‘ক্ল্যাসিক’ উদাহরণ। তাই শুধু বিনোদন নয়, শোষিত সমাজের মর্যাদা ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ চলচ্চিত্রটির দর্শকপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ।
চিত্রগ্রহণ, আবহসংগীত, অ্যাকশন, সম্পাদনা—সবকিছুতেই যত্নের ছাপ। আর ডি বর্মনের সংগীত চলচ্চিত্রটির আবেগকে আরও গভীর, গতিময়তাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। ‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’ কিংবা ‘মেহবুবা মেহবুবা’র মতো গান এখনো নস্টালজিক করে।
‘শোলে’ শুধু সফল চলচ্চিত্র নয়, এটি ভারতীয় সংস্কৃতির বড় হিস্যা। ঠাকুরের ‘হাত হারানো’, বাসন্তীকে ‘নাচানো’—এসব লোককথার মতো পুনরাবৃত্ত হয়। জয়, বীরু, গব্বরদের অনেক সংলাপ আজও রাজনৈতিক বক্তৃতা, কমেডি শো, বিজ্ঞাপন এমনকি খেলাধুলার মাঠে ব্যবহৃত হয়। একটি চলচ্চিত্রের টিকে থাকার জন্য আর কী লাগে! তাই তো ৫০ পেরিয়েও ‘জ্বলছে’ শোলে (অঙ্গার।