আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস (ফিপরেস্কি) নির্বাচন করেছে সর্বকালের সেরা ১০ ভারতীয় সিনেমা। ফিপরেস্কি ইন্ডিয়ার ৩০ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে ছবিগুলো। সেরা ১০ সিনেমার মধ্যে ৪টিই বাঙালি পরিচালকদের নির্মিত ছবি। ফিপরেস্কি সেই সেরা ১০ ছবির তালিকা অবলম্বনে এই প্রতিবেদন–
১. সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’
পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি। ফিপরেস্কি ইন্ডিয়ার ৩০ সদস্যের ভোটে সেরা ভারতীয় ছবি নির্বাচিত হয়েছে এটি। চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রর প্রথম, দুই শিল্পীরও প্রথম—অনেক ‘প্রথম’ নিয়ে নির্মিত ছবিটি মুক্তির পরেই ইতিহাস গড়ে। এটিই ভারতের প্রথম সিনেমা, যা বিশ্বচলচ্চিত্রে সাড়া ফেলে, মুক্তির এত বছর পরও অনেক নির্মাতা প্রেরণা খুঁজে নেন ছবিটি থেকে। ফিপরেস্কি ইন্ডিয়ার সদস্যদের ভোটে সর্বকালের সেরা ছবি হয়েছে ‘পথের পাঁচালী’। এর আগে এটি জায়গা পেয়েছিল প্রখ্যাত সমালোচক রজার এবার্টের ‘সেরা ছবি’র তালিকায়ও। ছিল ২০০৫ সালে টাইম সাময়িকীর করা সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায়। এ ছাড়া ২০১৮ সালে বিবিসির করা সমালোচকদের চোখে সেরা অ-ইংরেজিভাষী সিনেমার তালিকায় ‘পথের পাঁচালী’ ছিল ১৫ নম্বরে।
আকিরা কুরোসাওয়ার প্রিয় ১০০ ছবির তালিকারও শীর্ষে ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি। এই সময়ের প্রখ্যাত নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলানেরও প্রিয় সিনেমা এটি।
২. ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’
তালিকার দুইয়ে রয়েছে আরেক প্রখ্যাত বাঙালি পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ ছিল ‘অপু ট্রিলজি’র প্রথম কিস্তি। ঋত্বিকের ছবিটিও তাঁর ‘দেশভাগ ট্রিলজি’র প্রথম কিস্তি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থী নীতার (সুপ্রিয়া চৌধুরী) চোখ দিয়ে দেশভাগের পরের অবস্থা তুলে ধরেছেন পরিচালক।
মনে করা হয়, ঋত্বিকের এ ছবিই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরিচালকের মৃত্যুর পর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আরও বেশি কদর পায়। ভারত তো বটেই, ঋত্বিক হয়ে ওঠেন বিশ্বচলচ্চিত্রে সমীহ–জাগানো এক নাম।
৩. অমিতাভ বচ্চনের যোগ ‘ভুবন সোম’
মৃণাল সেন পরিচালিত ছবিটিকে ভারতের নিউ ওয়েভ সিনেমার অন্যতম পথপ্রদর্শক বলে মনে করা হয়। দেশটির জাতীয় চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের অর্থায়নে নির্মিত প্রথম দিককার সিনেমা ‘ভুবন সোম’। এটি রয়েছে সমালোচকদের তালিকার তিনে।
হিন্দি ছবিটির জন্য পরিচালক মৃণাল সেন, অভিনেতা উৎপল দত্ত জাতীয় পুরস্কার পান। ছবিটিতে শহুরে ও গ্রামীণ ভারতের বিভাজনের সঙ্গে পারস্পরিক আস্থা, মমত্ববোধও তুলে ধরেন পরিচালক। ছবিতে ধারা বর্ণনাকারী ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, ‘ভুবন সোম’ দিয়েই শুরু হয় তাঁর চলচ্চিত্র-যাত্রা।
৪. মালয়ালম পরিচালকের ‘এলিপ্পাথাইয়াম’
মালয়ালম পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণনের ছবিটি জায়গা পেয়েছে সর্বকালের সেরা ভারতীয় সিনেমার তালিকার চারে। ‘এলিপ্পাথাইয়াম’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ারের পর লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের বার্ষিক পুরস্কার জেতে। এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক জানিয়েছিলেন, নিজের পরিবারের সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে ছবির প্রেরণা নিয়েছেন তিনি।
৫.কন্নড় সিনেমা ‘ঘটশ্রাদ্ধ’
কন্নড় সিনেমার অন্যতম পরিচালক গিরিশ কাসারাভাল্লির প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা এটি। ২০০২ সালে ন্যাশনাল আর্কাইভ অব প্যারিসে ১০০ সিনেমার মধ্যে একমাত্র ভারতীয় ছবি হিসেবে জায়গা পায় ‘ঘটশ্রাদ্ধ’। ২০০৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব ইন্ডিয়ায় ১৬ লাখ ভোট পেয়ে সেরা ২০ ভারতীয় সিনেমার একটি হয় ‘ঘটশ্রাদ্ধ’।
৬.ভারত ভাগ নিয়ে নির্মিত ‘গরম হাওয়া’
ভারত ভাগের পর এক মুসলিম ব্যবসায়ী ও তার পরিবারের সংগ্রাম নিয়ে এম এস সথ্যুর সিনেমা। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আশঙ্কায় ছবিটি বছরখানেক আটকে রাখার পর ছাড়পত্র দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ড।
তবে মুক্তির পর দর্শক, সমালোচক উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়। উর্দু লেখিকা ইসমত চুগতাইয়ের অপ্রকাশিত গল্প অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন কাইফি আজমি ও শামা জাইদি। ভারত ভাগ নিয়ে নির্মিত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র মনে হয় এটিকে।
৭. গদারের প্রিয় ‘চারুলতা’
সর্বকালের সেরা ভারতীয় সিনেমার তালিকায় সত্যজিতের দ্বিতীয় ছবি ‘চারুলতা’। তালিকার তিনিই একমাত্র পরিচালক, যাঁর দুটি সিনেমা স্থান পেয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত ছবিটিকে নিজের অন্যতম প্রিয় বলে অভিহিত করেছিলেন সত্যজিৎ। ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সমালোচকেদের সেরা ছবির তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিল ‘চারুলতা’। এটি প্রয়াত নির্মাতা জঁ-লুক গদারের সব সময়ের প্রিয় ছবির একটি। ১৯৯৬ সাল থেকে দ্য একাডেমির আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে ‘চারুলতা’।
৮.কৃষকদের অর্থায়নে ‘অঙ্কুর’
হায়দরাবাদে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দিয়ে নির্মাতা হিসেবে যাত্রা শুরু করেন শ্যাম বেনেগাল। ছবিটি নির্মিত হয় স্থানীয় কৃষকদের অর্থায়নে। ২৪তম বার্লিন উৎসবে সোনার ভালুকের জন্য লড়েছিল ছবিটি। লক্ষ্মী ও সূর্য চরিত্রটির জটিল বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে জাতবৈষম্য, ধনী-গরিব বৈষম্যসহ নানা সামাজিক বিষয়কে তুলে ধরেছেন পরিচালক।
৯. আমির খানের প্রিয় ‘পিয়াসা’
বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ঘরানার সিনেমার মিশ্রণের অন্যতম সেরা উদাহরণ মনে করা হয় গুরু দত্তের সিনেমাটিকে। এতে ওয়াহিদা রেহমানের গুলাবো চরিত্রটি তৈরি হয়েছে বাস্তব চরিত্রের প্রেরণায়। ছবির অন্যতম চিত্রনাট্যকার আকবর আলভির একবার গুলাবো নামে এক যৌনকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাঁর কাছ থেকেই চরিত্রটির প্রেরণা নেন তিনি। কলকাতার প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমাটিতে গুরু দত্ত ছাড়াও অভিনয় করেন মালা সিনহা, ওয়াহিদা রেহমান, জনি ওয়াকার। ২০০৫ সালে টাইম সাময়িকীর করা সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায় জায়গা পেয়েছিল সিনেমাটি। ছবিটির প্রধান চরিত্রে প্রথম পছন্দ ছিলেন দিলীপ কুমার। তবে অজানা কারণে শুটিংয়ের প্রথম দিন সেটে আসেননি অভিনেতা, পরিচালক গুরু দত্ত নিজেই তাই প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ছবিটিতে প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দেওয়ায় পরে আফসোস করেছেন দিলীপ কুমার। আমির খানের সবচেয়ে পছন্দের হিন্দি সিনেমা এটি।
১০. বলিউড তারকাদের ‘শোলে’
বলিউডের ইতিহাসে বানিজ্যিক ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের নাম ‘শোলে’। ১৯৭৫ সালে মুক্তির পরপরই সাড়া জাগিয়েছিল ছবিটি। এই ছবি তৈরির টাকাই ছিল না শুরুতে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সেই দিনের সংকটের কথা জানালেন ছবির পরিচালক। ‘শোলে’ ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন একঝাঁক বলিউড তারকা। তাঁরা হলেন সঞ্জীব কুমার, অমিতাভ বচ্চন, ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, জয়া বচ্চন প্রমুখ। বক্স অফিস সফলতার পাশাপাশি ভারতের একটি ধ্রুপদি চলচ্চিত্রের মর্যাদাও পেয়েছে ‘শোলে’। রমেশ সিপ্পির ছবিটি ফিল্ম কম্পানিয়নের তালিকায় শীর্ষে ছিল।