সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। আইএমডিবি
সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। আইএমডিবি

ধনেপাতা বিক্রেতা থেকে আজকের বলিউড তারকা

অর্থকষ্টে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন, টিকিট ছাড়াই ট্রেনে চেপে বসা ছিল নিয়মিত ঘটনা। পরে সিনেমায় অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাই এসেও শুরুতে সুযোগ হয়নি। কখনো কখনো সুযোগ মিলত এক্সট্রা চরিত্রে, পারিশ্রমিক হিসেবে যা মিলত, বেশির ভাগই দিয়ে দিতে হতো কাস্টিং সমন্বয়কারীদের। অথচ তাঁর এখন মুম্বাইয়ের বুকে রাজপ্রাসদসম বাড়ি। হচ্ছিল হিন্দি সিনেমার এই সময়ের অন্যতম শীর্ষ অভিনেতা নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর কথা। ১৯ মে অভিনেতার জন্মদিন। এ উপলক্ষে জেনে নেওয়া যাক অভিনেতার জীবনের নানা জানা-অজানা কথা।

নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। এএনআই

উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরের ছোট্ট একটি শহর বুধানা। সেখান থেকেই অভিনয়ের নেশার বলিউডে আসেন। কাজের খোঁজে এসে প্রেমে পড়েন মঞ্চনাটকের। সেই প্রেম তাঁকে টেনে নিয়ে যায় ভারতের নামকরা নাটকের প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় (এনএসডি)। আমির খান অভিনীত ১৯৯৯ সালের সিনেমা ‘সারফারোশ’-এ ছোট একটা চরিত্রে অভিনয় করেন। এলাকার ছোট এক গুন্ডার চরিত্রে দেখা যায় নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীকে। সেই থেকেই শুরু। এরপরে তাঁকে প্রশংসা এনে দেয় ইরফান খানের সঙ্গে জুটি হয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যে অভিনয়। তাঁরা অভিনয় করেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য বাইপাস’-এ। বিএফআই লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মনোনয়ন পায়। কিন্তু বড় চরিত্র তখনো অধরাই ছিল।

২০১২ সালের ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ সিনেমায় নাম লিখিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। তাঁর চরিত্রের নাম ছিল ‘ফয়জাল খান’। সিনেমাটি দিয়ে দর্শকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পান নওয়াজ। সে বছরই তিনি নাম লেখান ‘কাহানি’, ‘পাতাং’, ‘পান সিং তুমার’, ‘চিটাগং’, ‘তালাশ’, ‘মিস লাভলি’ সিনেমায়। পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
এর আগে রাজকুমার হিরানির ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ সিনেমায় পকেটমারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সিনেমায় একটি দৃশ্য ছিল। তখনো সিনেমার মূল অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি। বড় বড় সিনেমায় ছোট চরিত্রে কাজ করলেও সেসব সিনেমার তারকাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হতো না। এমন শত শত বঞ্চনাই এই অভিনেতাকে সাহস জুগিয়েছিল।

সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। আইএমডিবি

খ্যাতির পর বেড়ে চলে অভিনয়ের পথচলা। একে একে ‘মুনসুন শুটআউট’, ‘দ্য লাঞ্চবক্স’, ‘আনওয়ার কা আজব কিস্‌সা’, ‘বদলাপুর’, ‘বজরঙ্গি ভাইজান’, ‘মাঝি: দ্য মাউন্টেনম্যান’, ‘লায়ন’, ‘রইস’, ‘হারামখোর’, ‘মম’, ‘মান্টো’, ‘রাত আকেলি হ্যায়’...নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকীর অভিনয়যাত্রা চলছেই।

ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করতে করতে আজ বড় তারকা হয়েছেন বলিউডের নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। তাঁর দীর্ঘ পথ ছিল কাঁটা বিছানো। এমন দিনও গেছে, যখন তাঁকে ধনেপাতা বিক্রি করতে হয়েছে। চাইলেও সেই দিন আর ফিরবে না। একবার ২০০ রুপির ধনেপাতা কিনেছিলেন নওয়াজুদ্দিন। সেগুলো খুচরা বিক্রি করেন কিছু লাভ করার জন্য। পাতাগুলো ক্রমেই বাদামি রং ধারণ করতে শুরু করলে তিনি দৌড়ে পাতাওয়ালাকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার পাতা তো মরে যাচ্ছে।’ পাতাওয়ালা তাঁকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ‘বারবার পানি ছিটাতে হবে, তাহলেই পাতা সতেজ থাকবে।’ নওয়াজের পকেটে সেদিন তেমন টাকা ছিল না। টিকিট ছাড়া রেলগাড়িতে চড়েছিলেন তিনি। কিন্তু নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ধনেপাতা ঠিকই বাদামি হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ২০০ রুপিই জলে গিয়েছিল সেদিন।

সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। আইএমডিবি

আরেকটি গল্প বলতে গিয়ে নওয়াজ বলেন, জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে একবার চার হাজার রুপি সম্মানী পান তিনি। সেদিন এই রুপির অর্ধেক তাঁকে দিয়ে দিতে হয়েছিল তাঁর সমন্বয়কারীকে। বাকিটা থেকে হোটেলভাড়া দিয়েছিলেন ১ হাজার ৮০০ রুপি আর ২০০ রুপি দিয়ে রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।

তবে এরপর অভিনয়শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরুর পর জীবনে যা যা হয়েছে, সেসব নিয়ে সন্তুষ্ট অভিনেতা। নওয়াজের ভাষ্যে, ‘অভিনয়জীবন নিয়ে আমি খুবই সন্তুষ্ট। একজন অভিনেতার উচিত, সব ধরনের ঘরানার জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলা। যে ধরনের ছবিতে কাজ করতে চেয়েছি, সুযোগ পেয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার প্রতি আস্থা রেখেছেন পরিচালকেরা।’ ক্যারিয়ারের ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে গত বছর। এই ২৫ বছরে নানা বৈচিত্র্যময় চরিত্রে তাঁকে দেখা গেছে। তবে তাঁর অভিনীত ছবির প্রদর্শনীর সংখ্যা আর সময় নিয়ে আক্ষেপও আছে। অভিনেতা বলেন, ‘আমাদের মতো অভিনেতাদের ছবি অত্যন্ত কম হল পায়। মাত্র দুটি শো পায়। তা-ও একটা সকাল, একটা রাতে। সেখানে তথাকথিত তারকাদের দখলে থাকে সিংহভাগ স্ক্রিন। আমার “আফওয়া”, “জোগিরা সারা রা রা”র ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল। এর চেয়ে ছবিগুলো ওটিটিতে মুক্তি পেলে ভালো হতো।’

সিনেমার দৃশ্যে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। আইএমডিবি

নওয়াজকে ইদানীং বড় পর্দার চেয়ে ওটিটিতে দেখা যাচ্ছে বেশি। বড় পর্দা প্রসঙ্গে অভিনেতা বলেন, ‘বড় পর্দার একটা জাদু আছে নিশ্চয়। কিন্তু আমি তো মঞ্চের মানুষ, তাই আমার কাছে মাধ্যম গুরুত্ব পায় না। আমি একজন অভিনেতা, তাই ভালো অভিনয় করতে পারলেই খুশি।’

নওয়াজুদ্দিন জানান, কন্যা শোরা তাঁর অভিনয়ের সবচেয়ে বড় সমালোচক। তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘শোরা আমার ছবি খুব কম দেখে। কোনো ছবি যদিওবা দেখে, হাজারটা ভুল খুঁজে বের করে। নির্দয়ভাবে আমার সমালোচনা করে। আমি শোরার বয়সী, মানে ১৪-২০ বয়সীদের সমালোচনা খোলামনে গ্রহণ করি। কারণ, ওদের ওপর কারও প্রভাব থাকে না। তাদের সমালোচনা খুব খাঁটি হয়। আমাদের ওপর অন্যের প্রভাব থাকে।’

‘কোস্টাও’ সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি

নওয়াজ একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শোরা তার বাবার পথ অনুসরণ করতে চায়। এ প্রসঙ্গে অভিনেতা জানান, শোরা অভিনয়ে আসতে চায়। নওয়াজ বলেন, ‘আমি কখনো ওকে অভিনয়ে আসার কথা বলিনি, ওর ওপর অযথা চাপ সৃষ্টি হবে। তবে ও কখনো আমার কাছে কোনো পরামর্শ চাইলে, আমি নিশ্চয় দেব।’
অভিনেতাকে সবশেষ দেখা গেছে চলতি মাসেই জি-ফাইভে মুক্তি পাওয়া ওয়েব সিনেমা ‘কোস্টাও’-এ। গোয়ার এক কাস্টমস অফিসার কোস্টাও ফার্নান্দেজের জীবন অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা এটি।

তথ্যসূত্র: প্রথম আলোর মুম্বাই প্রতিনিধির নেওয়া সাক্ষাৎকার, বলিউড হাঙ্গামা ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস