
মধ্য রাত। মুম্বাইয়ের ওরলির রাস্তায় একটা ছায়া বসে আছে একা, সিটি বেকারির দরজার সামনে। দোকান বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা। জানে, রাত ১২টার পর বিস্কুটের দাম অর্ধেক হয়ে যাবে। ক্ষুধার জ্বালায় কাঁপছে পেট, কিন্তু মুখে অনড় এক দৃঢ়তা—‘একদিন হবে, একদিন এই শহর আমায় চিনবে।’ সেই যুবকের নাম—অমিতাভ বচ্চন।
এই উপমহাদেশে অমিতাভ বচ্চনের আলাদা কোনো পরিচয় এর প্রয়োজন নেই। আজ ১১ অক্টোবর ৮৩ বছর পূর্ণ হলো এই কিংবদন্তি অভিনেতার। এ বয়সেও তিনি সদর্পে অভিনয় করে চলেছেন। ১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রে যে জয়যাত্রা শুরু করেছিলেন, আজও কাজের প্রতি অটল নিষ্ঠা ও অনমনীয় মনোবল নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সংশপ্তকের মতো। তাঁর ৫৬ বছরের বর্ণাঢ্য অভিনয় জীবন যেন এক অনন্য অনুপ্রেরণার গল্প!
চাকরি ছেড়ে ট্রেনে চেপেছিলেন স্বপ্নের খোঁজে
সবাই হয়তো জানে, অমিতাভ বচ্চনের জীবন সিনেমার মতোই নাটকীয়। কিন্তু খুব কম মানুষ জানে—তাঁর প্রথম পেশা ছিল করপোরেট চাকরি।
কলকাতায় ‘বার্ড অ্যান্ড হিলজার্স’, পরে ‘ব্লাকার্স’ নামের একটি শিপিং কোম্পানিতে কাজ করতেন তিনি। ভালো বেতন, অফিসের গাড়ি, সন্ধ্যার পার্টি—সবই ছিল।
তবু মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। অভিনয়ের নেশা মাথায় ঘুরত, যেন বাবার কবিতার ছন্দে এক অনিবার্য সুর। ওই যে মাথায় অভিনয়ের পোকা নিয়ে দিল্লি থেকে কলকাতা এসেছিলেন। কলকাতায় থিয়েটারও করতেন। কিন্তু নিজের ভেতর আরও বড় কিছু করার তাগিদ বাড়ছিল!
কলকাতায় ‘বার্ড অ্যান্ড হিলজার্স’, পরে ‘ব্লাকার্স’ নামের একটি শিপিং কোম্পানিতে কাজ করতেন তিনি। ভালো বেতন, অফিসের গাড়ি, সন্ধ্যার পার্টি—সবই ছিল।তবু মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। অভিনয়ের নেশা মাথায় ঘুরত, যেন বাবার কবিতার ছন্দে এক অনিবার্য সুর। ওই যে মাথায় অভিনয়ের পোকা নিয়ে দিল্লি থেকে কলকাতা এসেছিলেন।
তখনো কেউ জানত না—এই লম্বা, শ্যামবর্ণ, শান্ত মুখের তরুণটি একদিন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস বদলে দেবেন।
স্বপ্নের পিছু ছুটতে একদিন ট্রেনে চেপে বসেছিলেন বোম্বের পথে। সঙ্গে ছিল নিজের সামান্য সঞ্চয় আর একগুচ্ছ আশা।
প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—বাড়ি থেকে এক পয়সাও নেবেন না, নিজের রোজগারেই বাঁচবেন। কিন্তু চলচ্চিত্র জগতের পথটি তাঁর জন্য মোটেও মসৃণ ছিল না।
ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, ঢ্যাঙা শরীর আর গায়ের রং শ্যামলা হওয়ায় কেউই তাঁকে সুযোগ দিতে চায়নি। প্রথম সিনেমা ‘সাত হিন্দুস্তানি’ জাতীয় পুরস্কার জিতলেও পরের সিনেমায় সুযোগ পেতে তাঁর আরও দুই বছর লেগেছিল! তিনি যে হার মানেননি তার প্রমাণ পরে দুই শতাধিক সিনেমায় তাঁর অনবদ্য অভিনয়!
হাল ছেড়ো না বন্ধু
বলিউডের কণ্টকাকীর্ণ রাস্তায় দৃঢ় পায়েই হেঁটেছেন অমিতাভ! বিখ্যাত কবি হরিবনশ্ রাই বচ্চনের পুত্র, এই পরিচয় থাকা সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত না হয়ে কাজের জন্য তিনি ছুটেছেন স্টুডিও থেকে স্টুডিওতে! চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের শুরুর কোনো একসময় বোম্বের মেরিন ড্রাইভের বেঞ্চিতে দুরাত কাটাতে হয়েছিল তাঁর! পকেটের অবস্থা ছিল শোচনীয়। বোম্বের ওরলিতে, সিটি বেকারির মিষ্টি বিস্কুটের দাম মধ্যরাতে অর্ধেক হয়ে যেত। চার আনার বিস্কুট তখন বিক্রি হতো দুই আনায়। অমিতাভ প্রচণ্ড খিদে নিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত বিস্কুটের দাম কমার অপেক্ষা করেছেন বহুদিন!
কবি হরিবনশ্ রাই বচ্চনের পুত্র, এই পরিচয় থাকা সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত না হয়ে কাজের জন্য তিনি ছুটেছেন স্টুডিও থেকে স্টুডিওতে! চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের শুরুর কোনো একসময় বোম্বের মেরিন ড্রাইভের বেঞ্চিতে দুরাত কাটাতে হয়েছিল তাঁর!
এখন রূপকথার মতো শোনালেও বিখ্যাত পরিচালক তারা চাঁদ বরজাতিয়া, প্রমোদ চক্রবর্তী, শক্তি সামন্ত, বি আর চোপড়ারদুয়ারে নিয়ম করে ‘ধরনা’ দিয়েছেন তিনি! তাঁরা পাত্তা দেননি। কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরেছিল কিছুদিন পরই। পরবর্তীকালে এই পরিচালকদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই কাজ করেছেন তিনি—এটাই ছিল অমিতাভের নীরব, সৌম্য প্রতিশোধ।
বোম্বের ওরলিতে, সিটি বেকারির মিষ্টি বিস্কুটের দাম মধ্যরাতে অর্ধেক হয়ে যেত। চার আনার বিস্কুট তখন বিক্রি হতো দুই আনায়। অমিতাভ প্রচণ্ড খিদে নিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত বিস্কুটের দাম কমার অপেক্ষা করেছেন বহুদিন!
‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’—এক প্রজন্মের মুখপাত্র
চতুর্থ ছবি ‘আনন্দ’ (১৯৭১) দিয়ে নজর কাড়লেন অমিতাভ, কিন্তু এরপর টানা আটটি ছবি ফ্লপ। তবু তিনি দমে যাননি। ১৯৭৩ সালে ‘জাঞ্জির’ মুক্তি পেল। এ যেন ছিল বজ্রাঘাতের মতো প্রত্যাবর্তন।
ভারতের সিনেমায় তখন নতুন এক প্রতীক জন্ম নিল—‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’। ‘দিওয়ার’, ‘শোলে’, ‘ডন’, ‘কুলি’—প্রতিটি ছবিই তাঁকে পৌঁছে দেয় জনপ্রিয়তার অজেয় শিখরে।
একটা সময় এমন এল, যখন বলিউড মানেই ছিল অমিতাভ বচ্চন। চোখের ভেতর ছিল বঞ্চনার ক্ষোভ, কণ্ঠে ছিল বজ্রের গর্জন, আর সেই কণ্ঠই পরবর্তীকালে হয়ে উঠল ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী কণ্ঠগুলোর একটি।
কিন্তু ভাবা যায়? এই ভরাট ‘ব্যারিটোন’ কণ্ঠের মানুষটিকেই একসময় রেডিও অডিশনে ফেল করেছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও। তাঁর গলা নাকি ‘উপযুক্ত নয় সম্প্রচারের জন্য’। অমিতাভ সেই সময় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তারা বলেছিল আমার গলা ভালো না। আমি ভেবেছিলাম, একদিন এই গলায়ই মানুষ শুনবে ইতিহাস।’ এবং সেটাই হয়েছে। আজ বলিউডের পরিচালকেরা তাঁর ভয়েস-ওভার পাওয়ার জন্য দিন গুনে অপেক্ষা করেন।
ভরাট ‘ব্যারিটোন’ কণ্ঠের মানুষটিকেই একসময় রেডিও অডিশনে ফেল করেছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও। তাঁর গলা নাকি ‘উপযুক্ত নয় সম্প্রচারের জন্য’। অমিতাভ সেই সময় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তারা বলেছিল আমার গলা ভালো না। আমি ভেবেছিলাম, একদিন এই গলায়ই মানুষ শুনবে ইতিহাস।’ এবং সেটাই হয়েছে।
দেউলিয়া থেকে কিংবদন্তি
সাফল্যের চূড়ায় থাকা অবস্থায়ও জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন অমিতাভ। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অমিতাভ বচ্চন করপোরেশন লিমিটেড’।
কিন্তু সেই কোম্পানিই হলো কাল—ব্যর্থ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে লোকসান গুনতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা। ৫৫টি মামলা তাঁর নামে। নিজের বাড়িও বন্ধক রাখতে হয়। ক্যারিয়ার তখন প্রায় শেষ।
‘মৃত্যুদাতা’ (১৯৯৭) সিনেমাটিও ব্যর্থ। দেউলিয়া, হতাশ, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত—তবু তিনি হারেননি। একদিন নিজেই হাজির হন যশ চোপড়ার অফিসে, বিনীতভাবে বলেন, ‘আমাকে কাজ দিন, ঋণ শোধ করতে হবে।’ সেই বিনয়ই ফিরিয়ে আনে তাঁকে জীবনে। টেলিভিশনের পর্দায় ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ উপস্থাপনা শুরু করেন।
সেই অনুষ্ঠানই তাঁকে ফেরায় লাখ লাখ দর্শকের ঘরে, হৃদয়ে। তারপর যশ চোপড়ার ‘মোহাব্বাতে’–তে ফিরে এলেন এক ভিন্ন অমিতাভ—রাশভারী, গুরুগম্ভীর, অথচ কোমল। তিনি যেন নিজেরই নতুন রূপের জন্ম দিলেন।
সাফল্যের চূড়ায় থাকা অবস্থায়ও জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন অমিতাভ। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অমিতাভ বচ্চন করপোরেশন লিমিটেড’। কিন্তু সেই কোম্পানিই হলো কাল—ব্যর্থ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তে লোকসান গুনতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা। মামলা তাঁর নামে।
ভয়কেও করেছেন বন্ধু
অমিতাভ একবার বলেছিলেন, ‘আমি চাই আমার পেটে সব সময় প্রজাপতি উড়ুক। ভয় যেন কখনো না যায়। নতুন কিছু করার ভয়ই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে।’ এমন কথাই বলে দেয়, কেন তিনি আজও প্রাসঙ্গিক, কেন এখনো তরুণ প্রজন্মের আইকন। ‘পা’, ‘নিশব্দ’, ‘চিনি কম’, ‘পিকু’—প্রতিটি ছবিতে নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেন হয়ে উঠেছেন আরও পরিণত, আরও সূক্ষ্ম এক শিল্পী।
আজ ৮৩ বছর বয়সেও প্রতিদিন সকালে সময়মতো জেগে ওঠেন, স্ক্রিপ্ট পড়েন, শরীর চর্চা করেন, শুটিং সেটে হাজির হন নির্ধারিত সময়ের আগেই। সময়ানুবর্তিতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ—এই দুই গুণই তাঁকে অনন্য করেছে।
৮৩ বছর বয়সেও প্রতিদিন সকালে সময়মতো জেগে ওঠেন, স্ক্রিপ্ট পড়েন, শরীর চর্চা করেন, শুটিং সেটে হাজির হন নির্ধারিত সময়ের আগেই। সময়ানুবর্তিতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ—এই দুই গুণই তাঁকে অনন্য করেছে
শেষ নেই তাঁর গল্পের
অমিতাভ বচ্চন শুধু এক অভিনেতা নন—তিনি এক ‘পাঠশালা’। তাঁর জীবন শেখায়—ব্যর্থতা মানেই শেষ নয়, বরং নতুনভাবে শুরু করার ঘোষণা।
রেডিওতে ফেল করা তরুণ থেকে সিনেমার রাজা, দেউলিয়া ব্যবসায়ী থেকে টেলিভিশনের প্রাণপুরুষ—প্রতিবারই তিনি ফিরে এসেছেন আরও দীপ্ত হয়ে। আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে বলা যায় একটাই কথা—তিনি শিখিয়েছেন, সফলতা নয়, লড়ে ওঠাই জীবনের আসল সৌন্দর্য।
শুভ জন্মদিন, বলিউডের ‘শাহেনশাহ’।