ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সেরা ক্ল্যাসিক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’। কোলাজ
ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সেরা ক্ল্যাসিক বিমল রায়ের ‘দো বিঘা জমিন’। কোলাজ

ঢাকার ছেলের সেই গল্প এবার ভেনিসে

বিমল রায় সেই সময়ে নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে বম্বে টকিজে গেছেন। তাঁকে সদলবল ডেকে পাঠিয়েছেন বম্বে টকিজের প্রধান শেয়ারহোল্ডার অশোক কুমার, ‘মা’ সিনেমার ডিরেকশন দেওয়ার জন্য। কাজকর্ম থেকে ফুরসত পেয়ে, একদিন তিনি পৌঁছালেন বম্বেতে আয়োজিত প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। আর সেখানেই দেখলেন ভিত্তোরিও দে সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’। ইতালিয়ান নিওরিয়েলিজমের কাজ দেখে, ফেরার পথেই মনস্থির করলেন, এবার নিজেই খুলবেন প্রোডাকশন কোম্পানি, যেখানে নিজের স্বাধীনতামতো নিজের দেশের এ রকম বাস্তব ছবি তুলে ধরতে পারবেন।

‘দো বিঘা জমিন’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

এভাবেই তৈরি হয়েছিল ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সেরা ক্ল্যাসিক ‘দো বিঘা জমিন’। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি সম্প্রতি ফোর–কে সংস্করণে রূপান্তর করা হয়েছে। গতকাল ভেনিস উৎসবের ক্ল্যাসিকস সেকশনে হয়ে গেল সিনেমাটির প্রিমিয়ার। তবে আজ থেকে আট দশক আগে সিনেমাটি তৈরির গল্পও কম চমকপ্রদ নয়।

অনেকে বলে থাকেন, ‘দো বিঘা জমিন’-এর মূল কাহিনি নেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে। এমনকি বলরাজ সাহনিও তাঁর আত্মজীবনীতে সামান্য অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন যে বিমল রায় কোথাও রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাননি বা নাম উল্লেখ করেননি। বিমল রায় নিজে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ অনুরাগী। তাঁর দুই কন্যার বক্তব্য অনুযায়ী, কবিগুরুর সৃষ্টি থেকে কোনো কিছু কণামাত্র নিলেও তিনি ঋণস্বীকার করতে নিশ্চয়ই কুণ্ঠা বোধ করতেন না।

শুরুর শুরু
১৯৫০-এর দশকের শুরু। সলিল চৌধুরী হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসকের নির্দেশে, সম্পূর্ণ বেড রেস্ট। ঘরবন্দী অবস্থায়, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে বিছানার পাশে একটা খোলা জানলা। দেখতে পেলেন, নিচের রাস্তায়, কাজকর্মের ফাঁকে জড়ো হয় জনা কয়েক রিকশাচালক। তারা নিজেদের ভেতর গল্প করে; সুখ-দুঃখের কথা বলে; বলে, দেশ-গাঁয়ের ভিটেমাটি ছেড়ে রোজগারের আশায় কলকাতা শহরে দিন গুজরানের কাহিনি।

সলিলের মাথায় একটা গল্প খেলে গেল। লিখলেন, ‘রিকশাওয়ালা’। ঋত্বিক ঘটক তখন চাইছেন, থিয়েটার থেকে সরে এসে ফিল্ম পরিচালনায় হাত দেবেন। সলিলের লেখা গল্পটা ভালো লেগে গেল তাঁর। দুজনের আলাপ-আলোচনা চলছে—এ রকম সময়ে, বম্বে থেকে এসে হৃষীকেশ মুখার্জি (তখন তিনি ফিল্ম এডিটর) খবর দিলেন, বিমল রায় নিজের প্রোডাকশন কোম্পানি খুলছেন; প্রথম সিনেমাটা বানানোর জন্য বাস্তবধর্মী কাহিনি খুঁজছেন।

হৃষীকেশের কাছ থেকে খবর পেয়ে, সলিল গল্পটা শোনালেন বিমল রায়কে। পরিচালক কেবল গল্পই নিলেন না, উপরন্তু ছবিতে সুর বাঁধার দায়িত্বও দিলেন সলিলকে। শুরু হলো ‘দো বিঘা জমিন’-এর তোড়জোড়। মূল গল্পকারের সঙ্গে লেখার কাজে জুড়লেন হৃষীকেশ আর পল মহেন্দ্র, যিনি ছিলেন বিমল রায়ের আরেক ডানহাত।

বলরাজের আবির্ভাব
বলরাজ সাহনি কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করলেও সেভাবে পরিচিত মুখ তখনো হয়ে ওঠেননি। একদিন বম্বের সমুদ্রসৈকতে বাচ্চাদের নিয়ে হুটোপাটি করছেন, এমন সময় দেখলেন, ধুতি পরিহিত একজন বাঙালি বাবু এগিয়ে আসছেন তাঁর দিকে। ইনি অভিনেতা অসিত সেন, তখন ছিলেন বিমল রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট; পরে নিজেও কয়েকটি সিনেমা বানিয়েছেন।

‘দো বিঘা জমিন’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

অসিত সোজাসুজি জানালেন, ‘বিমলদা আপনাকে খুঁজছেন, দেখা করতে চাইছেন।’ বলরাজ তো আত্মহারা! বিমল রায় তাঁকে খুঁজছেন! চটপট লন্ডন থেকে বানিয়ে আনা দামি স্যুট পরে, পাউডার মেখে পৌঁছালেন কুর্লায়, মোহন স্টুডিওতে। বিমল রায় বলরাজকে একঝলক দেখেই, তক্ষুনি পেছন ফিরে সঙ্গীদের নিখাদ বাংলায় বললেন, ‘আমার সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে? ইনি কী করে ওই চরিত্র করবেন?’ বলরাজ হাল ছাড়লেন না; জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রকম রোল?’ খানিকটা উপহাস মিশিয়ে বিমল রায় বললেন, ‘একজন গেঁয়ো চাষার।’ বলরাজ বললেন, ‘ও রকম কাজ আমি করেছি।’ চমকে গেলেন বিমল রায়, ‘কোথায়?’ এইবার বলটা ছুড়লেন আত্মবিশ্বাসী বলরাজ, ‘“ধরতি কে লাল”...শম্ভু মিত্র সহপরিচালনা করেছেন...।’ এতক্ষণ পর, বিমল রায় সন্তুষ্ট হলেন, বোঝা গেল শম্ভু মিত্রর নামটা ম্যাজিকের কাজ করেছে।

প্রস্তুতি
ইংরেজিতে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকাকালে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করা আর বিবিসি লন্ডনে জর্জ অরওয়েলের পাশাপাশি বসে কাজ করা বলরাজ ব্যক্তিজীবনে ছিলেন যথেষ্ট চৌকস ও শহুরে। কিন্তু ‘দো বিঘা জমিন’-এ একজন নিরক্ষর গ্রাম্য কৃষকের চরিত্র করতে গিয়ে প্রথমেই কী করলেন তিনি? বম্বের জোগেশ্বরীর খাটাল এলাকায় হাজির হতে থাকলেন প্রতিদিন। ওই সব খাটালে গরু-মোষ পুষে, সারা শহরে টাটকা দুধের জোগান দেয় উত্তর প্রদেশ আর বিহার থেকে আগত মানুষ; বম্বের পথচলতি ভাষায় যাদের তাচ্ছিল্য করে ডাকা হয় ‘ভাইয়া’ বলে। তাদের চালচলন, হাবভাব, পোশাক-আশাক—সবকিছু খুঁটিয়ে লক্ষ করতে থাকলেন বলরাজ। তারপর, প্রথম দিন শুটিংয়ে এসে, বিমল রায়কে জানালেন, তিনি নিজেই নিজের মেকআপ আর কস্টিউমের সিদ্ধান্ত নেবেন। রাজি হলেন পরিচালক। কিছুক্ষণ পরই, ইউনিটের সবাই দেখলেন, চিত্রনাট্যের পাতা থেকে উঠে এসে হাঁটাচলা করছে রক্তমাংসের চাষি শম্ভু মাহাতো।

‘দো বিঘা জমিন’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

স্টুডিওর বাইরে নতুন পথ
১৯৫০-এর দশকে ভারতীয় সিনেমা ছিল মূলত স্টুডিওভিত্তিক। ‘দো বিঘা জমিন’ রাস্তায় শুট করা হয়েছিল, যা সময়ের প্রচলিত ধারার বিপরীত। বম্বের স্টুডিওতে দু-তিন মাস শুটিংয়ের পর, আউটডোর শিডিউল হলো কলকাতায়। সস্ত্রীক ট্রেন-যাত্রায় বলরাজ বেছে নিলেন থার্ড ক্লাস কামরা। কেন? কারণ, তিনি দেখতে চান, এ দেশের গরিব–গুরবো জনসাধারণ কীভাবে ট্রেনে চড়ে; যানবাহনে বসে তারা কী আচরণ করে। কলকাতায় পৌঁছে, তিনি সোজা গেলেন রিকশাচালকদের ইউনিয়নে। কারণ, নিজে রিকশা চালানোটা শিখবেন। শহরের বেলাগাম ব্যস্ত ট্রাফিকে, হাত-রিকশা টেনে তিনি বুঝতে পারলেন, কতটা সতর্ক হয়ে দেহের প্রতিটা পেশি ও অস্থি নিংড়ে এই কাজ করতে পারা যায়।

‘দো বিঘা জমিন’ কেন গুরুত্বপূর্ণ
এত বছর পরও ‘দো বিঘা জমিন’-এর কৃষক শম্ভুর গল্প আজও ভারতের কৃষকদের বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়। কৃষিজমি বাঁচানোর লড়াই, ঋণের বোঝা আর শহুরে জীবনের নির্মমতা—সবকিছুই যেন এখনো প্রতিধ্বনিত হয় এই ছবিতে। ১৯৪৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ইতালীয় ক্ল্যাসিক ‘বাইসাইকেল থিভস’ বিমল রায়কে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি চেয়েছিলেন ঠিক তেমন একটি গল্প বলতে, যা ভারতীয় জীবনের সঙ্গে সত্যিকার অর্থেই মিলে যাবে। ইতালীয় নিওরিয়েলিস্ট ধারার অনুসরণে রায় চিত্রায়ণ করলেন সংগীতকার সলিল চৌধুরীর লেখা গল্প, যেখানে বাস্তব লোকেশন, বাস্তব অভিনয় এবং জীবনের নির্মম সত্য স্থান পেয়েছিল।

‘দো বিঘা জমিন’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

কৃষক শম্ভু (বলরাজ সাহনি) জমিদারের ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েন। মাত্র দুই বিঘা জমি তাঁর সর্বস্ব, যা তিনি মায়ের মতো আঁকড়ে ধরেন। আদালতের নির্দেশ—তিন মাসের মধ্যে জমিদারকে ২৩৫ রুপি পরিশোধ করতে হবে। গর্ভবতী স্ত্রী পারো (নিরুপা রায়), অসুস্থ বাবা আর ছোট ছেলে কানহাইয়াকে (রতন কুমার) রেখে শম্ভু পাড়ি দেন কলকাতায়। শহরে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন—তাঁর দক্ষতার কোনো মূল্য নেই। একের পর এক অপমান, বঞ্চনা আর হাহাকার শেষে রিকশাচালক হতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু ভাগ্যও যেন প্রতিটি বাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে। এমন গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমাটির বড় বৈশিষ্ট্য, বিমল রায়ের আপসহীন বর্ণনা। তিনি যেন দর্শককে এক শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকার দুনিয়ায় নিয়ে যান, যেখানে আলো প্রবেশ করে না।

যেভাবে নতুন সংস্করণ
‘দো বিঘা জমিন’-এ প্রান্তিক মানুষের দুর্দশা, শহর-গ্রামের ব্যবধান এবং অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনের কষ্টকে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন বিমল রায়। সিনেমাটির পুনরুদ্ধার ও সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কথা বলেছেন ভারতের ফিল্ম হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পরিচালক শিবেন্দ্র সিং ধুঙ্গরপুর। ভ্যারাইটিকে তিনি বলেন, ‘বিমল রায় “দো বিঘা জমিন” তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী”র দুই বছর আগে। সত্যজিৎ রায় বলেছেন, “বিমল রায় পুরোনো রীতির জাল ছেড়ে বাস্তববাদী ও সূক্ষ্ম অভিনয়ধারার পথ দেখিয়েছিলেন।” তাঁর সিনেমায় দেখা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি যুগের পর যুগে টিকে আছে। এ জন্যই সিনেমাটি এত গুরুত্বপূর্ণ।’

ঋত্বিক ঘটক যদিও ওই গল্প নিয়ে সিনেমা বানাননি, তবে ‘রিকশাওয়ালা’ কিন্তু বাংলাতেও হয়েছিল। চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় সত্যেন বসু। মুখ্য ভূমিকায়, কালী ব্যানার্জি ও তৃপ্তি মিত্র। কাহিনির পাশাপাশি এই সিনেমাতেও গান বেঁধেছেন সলিল চৌধুরী। বাংলা ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল ‘দো বিঘা জমিন’-এর ২ বছর পর, ১৯৫৫ সালে।

ধুঙ্গরপুরের মতে, এটি একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি সামাজিক ইতিহাসের আয়না। গল্পে দেখা যায় কৃষককে বাধ্য হয় শহরে গিয়ে রিকশা চালাতে, জমি বাঁচাতে ধনীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। এই ছবিতে উঠে আসে শহর-গ্রামের বৈষম্য, শ্রমিকজীবনের হাহাকার এবং মানসিক চাপ, যা আজও সমসাময়িক।

‘দো বিঘা জমিন’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

তিন বছরের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সিনেমাটি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া সহজ ছিল না। ধুঙ্গরপুরের ভাষায়, ‘মূল ক্যামেরার নেগেটিভ অসম্পূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কাছে ৩৫ মিমি ডুপ নেগেটিভ পাওয়া যায়, যা সম্পূর্ণ ছিল।’ সাউন্ডও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক অংশের সাউন্ড মিসিং বা বিকৃত ছিল। ‘সাউন্ড পুনরুদ্ধারে ব্যাপক পরিশ্রম করতে হয়েছে। প্রতিটি দৃশ্যের শব্দকে জীবন্ত করা সহজ ছিল না,’ বলেন তিনি।

বিমল রায়ের ছেলে জয় বিমল রায় বলেন, ‘ছবিটি এতটাই খারাপ অবস্থায় ছিল যে নিজেরা এটা করা সম্ভব হতো না। ক্রাইটেরিয়নের সহায়তায় এই পর্যায়ের পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে। এখন এ ছবিটি শুধু ভারতে নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রেক্ষাগৃহে দেখানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।’

নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক বিমল রায় ১৯০৯ সালে জন্মেছিলেন ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজে যখন বিমল রায় ছাত্র, তখন মারা যান তাঁর বাবা, ১৯৩০ সালের আশপাশে। এস্টেটের নায়েব জানালেন, মৃত্যুর আগে বাবা প্রচুর ঋণ রেখে গেছেন; সুতরাং ছেলেকে হয় দেনা মেটাতে হবে, নইলে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। বিধবা মা আর দুই ছোট ভাইকে নিয়ে রাতারাতি সুয়াপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন তিনি। ভিটেমাটি খোয়ানোর এই শোক তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। ক্যামেরার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। তাই শুরুটা হয়েছিল নিতিন বোসের হাত ধরে তাঁর ক্যামেরার সহকারী হিসেবে নিউ থিয়েটার্সে। সেই সুবাদে প্রমথেশ বড়ুয়ার ছায়াছবির প্রচারের জন্য ছবি তোলার কাজ পান।

একই গল্প নিয়ে বাংলা সিনেমাও
ঋত্বিক ঘটক যদিও ওই গল্প নিয়ে সিনেমা বানাননি, তবে ‘রিকশাওয়ালা’ কিন্তু বাংলাতেও হয়েছিল। চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় সত্যেন বসু। মুখ্য ভূমিকায়, কালী ব্যানার্জি ও তৃপ্তি মিত্র। কাহিনির পাশাপাশি এই সিনেমাতেও গান বেঁধেছেন সলিল চৌধুরী। বাংলা ছবিটা মুক্তি পেয়েছিল ‘দো বিঘা জমিন’-এর ২ বছর পর, ১৯৫৫ সালে।

সত্যিই কি রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে
অনেকে বলে থাকেন, ‘দো বিঘা জমিন’-এর মূল কাহিনি নেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে। এমনকি বলরাজ সাহনিও তাঁর আত্মজীবনীতে সামান্য অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন যে বিমল রায় কোথাও রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাননি বা নাম উল্লেখ করেননি। বিমল রায় নিজে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ অনুরাগী। তাঁর দুই কন্যার বক্তব্য অনুযায়ী, কবিগুরুর সৃষ্টি থেকে কোনো কিছু কণামাত্র নিলেও তিনি ঋণস্বীকার করতে নিশ্চয়ই কুণ্ঠা বোধ করতেন না।

ঢাকার ছেলে
নির্মাতা ও চিত্রগ্রাহক বিমল রায় ১৯০৯ সালে জন্মেছিলেন ঢাকায়। জগন্নাথ কলেজে যখন বিমল রায় ছাত্র, তখন মারা যান তাঁর বাবা, ১৯৩০ সালের আশপাশে। এস্টেটের নায়েব জানালেন, মৃত্যুর আগে বাবা প্রচুর ঋণ রেখে গেছেন; সুতরাং ছেলেকে হয় দেনা মেটাতে হবে, নইলে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। বিধবা মা আর দুই ছোট ভাইকে নিয়ে রাতারাতি সুয়াপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে এলেন তিনি। ভিটেমাটি খোয়ানোর এই শোক তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। ক্যামেরার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। তাই শুরুটা হয়েছিল নিতিন বোসের হাত ধরে তাঁর ক্যামেরার সহকারী হিসেবে নিউ থিয়েটার্সে। সেই সুবাদে প্রমথেশ বড়ুয়ার ছায়াছবির প্রচারের জন্য ছবি তোলার কাজ পান।

বিমল রায়। আইএমডিবি

চল্লিশের দশকের শেষে দেশভাগের পর নিউ থিয়েটার্সের প্রতিপত্তি কমতে থাকে। একসময় নিউ থিয়েটার্স বন্ধ হয়ে গেলে অশোক কুমারের উদ্যোগে মুম্বাইয়ে হিমাংশু রাই-দেবিকা রানী প্রতিষ্ঠিত ‘বম্বে টকিজ’-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পান বিমল রায়। ওই বম্বে টকিজ থেকে ছবি করেন ‘মা’। এটি মুক্তি পায় ১৯৫২ সালে। এ ছাড়া ১৯৫৩ সালে শরৎচন্দ্রের ‘পরিণীতা’ উপন্যাস অবলম্বনে ছবি বানান বিমল রায়। এরপরই নিজের প্রযোজনা সংস্থা থেকে করেন ‘দো বিঘা জমিন’। ১৯৫৪ সালে কান উৎসবে পুরস্কৃত হয় সিনেমাটি। এরপর নানা ধরনের আরও সিনেমা করেছেন; পরিকল্পনা ছিল বিচিত্র বিষয় নিয়ে সিনেমা ও তথ্যচিত্র করার। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ৭ জানুয়ারি মাত্র ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর।

তথ্যসূত্র: ভ্যারাইটি, ইন্ডিয়া টুডে ও রোববার ডট ইন