মহেশ ভাট ও তাঁর মেয়ে পূজা ভাট
মহেশ ভাট ও তাঁর মেয়ে পূজা ভাট

পূজা ভাটকে চুমু খাওয়া নিয়ে ‘মহেশ ভাট বিতর্ক’, আসল ঘটনা কী ছিল?

সমকালীন বাণিজ্যিক সিনেমার প্রসঙ্গ এলে একজন নির্মাতার নাম চলে আসে। তাঁর নাম মানেই ভিন্ন ধরনের আলোচনার জন্ম। তিনি পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার—সব ভূমিকাতেই সমান সফল। আবার সমান বিতর্কিতও। তিনি মহেশ ভাট। আজ, ২০ সেপ্টেম্বর, তাঁর জন্মদিন। বয়সের ক্যালেন্ডার বলছে ৭৭, কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রে থাকার ক্ষমতা যেন এখনো তীক্ষ্ণ ও সক্রিয়। কে চেনেন না তাঁকে, ভারত এমনকি আমাদের দেশেও চলচ্চিত্রানুরাগীরা এক নামেই তাঁকে চেনেন। তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের পাশে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে শিল্প আর বিতর্ক। যেমনটি আলোচনায় উঠে আসে একটি পুরোনো ছবি, যেখানে দেখা যায় কন্যা পূজা ভাটকে ঠোঁটে চুম্বন করছেন মহেশ ভাট। সেই ছবি ঘিরে তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলা বিতর্ক আজও যেন থেমে নেই। জন্মদিনে তাই আবার সামনে চলে এসেছে সেই ঘটনাই।

১৯৯০-এর সেই প্রচ্ছদ
ঘটনাটা ঘটেছিল (পড়ুন ছবিটা তোলা হয়) নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। ভারতের একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয় মহেশ ভাট ও তাঁর মেয়ে পূজা ভাটের ছবি। তাতে দেখা যায়, কিশোরী পূজা বাবার কোলে বসে আছেন, আর মহেশ ভাট মেয়েকে ঠোঁটে চুম্বন করছেন। বাবা মেয়ের ছবি। কিন্তু ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় প্রবল সমালোচনা। অনেকে বিষয়টিকে কেবল পিতা-কন্যার স্নেহময় মুহূর্ত হিসেবে দেখেননি, বরং সেটিকে অগ্রহণযোগ্য, অস্বাভাবিক সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেন।

ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ছবি তৎকালীন সময়ে চরম বিতর্ক উসকে দেয়। সংবাদপত্র, চিঠিপত্র, টেলিভিশন অনুষ্ঠান—সব জায়গাতেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। এমনকি আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে কথা হয়, চর্চা হয়। কিন্তু পূজা ভাট বছরের পর বছর ধরে একই অবস্থানেই থেকেছেন। তিনি বারবার বলেছেন, এটি ছিল একটি ‘নির্দোষ মুহূর্ত’, যা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ছবি তৎকালীন সময়ে চরম বিতর্ক উসকে দেয়। সংবাদপত্র, চিঠিপত্র, টেলিভিশন অনুষ্ঠান—সব জায়গাতেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। এমনকি আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে কথা হয়, চর্চা হয়।
মহেশ ভাট

পূজা ভাটের স্পষ্ট ব্যাখ্যা
কিছুদিন আগে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে পূজা বলেছেন, এ নিয়ে মোটেও বিচলিত নন তিনি। এটা নিয়ে অনুশোচনার প্রশ্নই আসে না। তাঁর ভাষায়, ‘এটি আমার কাছে একেবারেই সাধারণ এক মুহূর্ত ছিল। কিন্তু মানুষ যেভাবে চাইবে, সেভাবেই এটিকে উপস্থাপন করবে। শাহরুখ খান একবার আমাকে বলেছিলেন, যখন তোমার মেয়ে হবে, তখন সেও তোমাকে বলবে, “মা, আমার গালেও একটা চুমু দাও।” আমি আজও বাবার কাছে দশ বছরের একটি ছোট মেয়ে।’
ক্ষোভের সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘যদি কেউ বাবা-মেয়ের সম্পর্ককে অন্যভাবে দেখতে চায়, তবে তারা যেকোনোভাবে তা ব্যাখ্যা করবে। আমি তা থামাতে পারব না। অথচ আমাদের সমাজে সবাই পারিবারিক মূল্যবোধের কথা বলে, কিন্তু স্নেহের মুহূর্তকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে কুণ্ঠিত হয় না।’ এ ছবি নিয়ে বাবা–মেয়ে দুজনই জানিয়েছেন, শুধু ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের জন্য বিষয়টা অন্যভাবে দেখার বা ভুল বোঝার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি একটি নিরেট পিতা-কন্যার স্নেহ-ভালোবাসা মাখা ছবি।

জটিল পারিবারিক জীবন
এ কথা বললে বাড়াবাড়ি হবে না, মহেশ ভাটের ব্যক্তিজীবনও তাঁর চলচ্চিত্রের মতো নাটকীয়। তাঁর প্রথম স্ত্রী ছিলেন লরেন ব্রাইট, যিনি পরে নাম পরিবর্তন করে কিরণ ভাট হন। তাঁদের সংসারে জন্ম নেন পূজা ভাট ও রাহুল ভাট। তবে কর্মজীবনের নানা টানাপোড়েন ও ব্যক্তিগত মতভেদে এই সম্পর্ক ভেঙে যায়।
পরে মহেশ ভাট নতুন করে সম্পর্ক শুরু করেন অভিনেত্রী সোনি রাজদানের সঙ্গে। একসময় বিয়েও করেন তাঁরা। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগেই মহেশ ভাট দ্বিতীয় বিয়ে করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন বলিউড পাড়ায়। তাঁদের সংসারে জন্ম নেয় দুই কন্যা শাহিন ভাট ও আলিয়া ভাট। আজ বলিউডে আলিয়া ভাট সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকাদের একজন। কিন্তু এই পরিবারের ভেতরেও নানা প্রশ্ন, সমালোচনা ও গুজব ছিল অবিচ্ছেদ্য।
বড় কন্যা পূজা ভাট একবার প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘আমার বাবা যখন সোনিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি আমাকে সব খোলাখুলি বলেছিলেন। অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন, কীভাবে একটি ছোট মেয়েকে এসব বলা যায়। কিন্তু আমি আমার ভাইবোনদের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখি না। সোনি আমার কাছে সব সময় পরিবার। আমরা সবাই মিলে একটা পরিবার।’

প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগেই মহেশ ভাট দ্বিতীয় বিয়ে করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন বলিউড পাড়ায়

জন্ম ও বেড়ে ওঠা
ফিরে যাই শুরুতে। মহেশ ভাটের জীবনযাত্রা শুরু কিন্তু পাকিস্তানে। ১৯৪৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর লাহোরে জন্ম মহেশ ভাটের । তাঁর বাবা নানাভাই ভাট ছিলেন ব্রাহ্মণ আর মা শিরিন মোহাম্মদ আলী ছিলেন গুজরাটের মুসলিম পরিবারের সন্তান। অবশ্য মহেশ ভাটের পরিচয় নিয়েও কম কথা হয়নি। এমনকি বলিউড তারকা কঙ্গনা রনৌতও এ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করেছেন।

২০২২ সালে কঙ্গনা তাঁর ইনস্টাগ্রামে একটি স্টোরি শেয়ার করেন। সেই স্টোরিতে পুরোনো এক ভিডিও ক্লিপের ছবি শেয়ার করে কঙ্গনা জানান, মহেশ ভাটের আসল নাম মোটেই মহেশ নয়।

২০২২ সালে কঙ্গনা তাঁর ইনস্টাগ্রামে একটি স্টোরি শেয়ার করেন। সেই স্টোরিতে পুরোনো এক ভিডিও ক্লিপের ছবি শেয়ার করে কঙ্গনা জানান, মহেশ ভাটের আসল নাম মোটেই মহেশ নয়। তাঁর নাম আসলাম। ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন মহেশ ভাট। তাঁর আসল নাম ছিল আসলাম। সোনি রাজদানকে বিয়ে করার জন্য নাকি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন মহেশ। কিন্তু কেন তিনি নিজের সুন্দর নামটা গোপন রেখেছেন?’ কঙ্গনা আরও লেখেন, ‘আসলাম নামটা সুন্দর, সেই নামটি লুকানোর কী আছে? ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আসল নাম ব্যবহার করাই উচিত।’ এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো, মহেশ ভাটের প্রযোজনায় ‘গ্যাংস্টার’ ছবি দিয়েই বলিউডে পা রাখেন কঙ্গনা। এরপর ‘ওহ লামহে’ ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন তিনি।

যা হোক, একসময় মুম্বাই এসে থিতু হন মহেশ ভাট। মুম্বাইয়ের মাতুঙ্গার ডন বস্কো হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। স্কুলে থাকাকালীনই গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বিভিন্ন কাজ করে উপার্জন শুরু করেন, বিজ্ঞাপন নির্মাণে যুক্ত হন। পরে পরিচালক রাজ খোসলার সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন এবং সেখান থেকেই চলচ্চিত্রে তাঁর পথচলা শুরু।

মহেশ ভাটের প্রযোজনায় ‘গ্যাংস্টার’ ছবি দিয়েই বলিউডে পা রাখেন কঙ্গনা

পরিচালনায় আগমন
মাত্র ২৬ বছর বয়সে মহেশ ভাট প্রথম চলচ্চিত্র ‘মঞ্জিলে অউর ভি হ্যাঁয়’ পরিচালনা করেন। ছবিটি তেমন বাণিজ্যিক সাফল্য না পেলেও তাঁর পরিচিতি তৈরি হয়। আসল সাফল্য আসে ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘লহু কে দো রং’ ছবির মাধ্যমে। ছবিটি তাঁকে এনে দেয় ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, আর তিনি এক ধাক্কায় বলিউডে প্রতিষ্ঠিত পরিচালক হয়ে ওঠেন। ১৯৮২ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘আর্থ’। শাবানা আজমি অভিনীত এই ছবিটি শুধু সমালোচকদের প্রশংসাই কুড়ায়নি, বরং তাঁকে এনে দেয় ফিল্মফেয়ারের সেরা সংলাপের পুরস্কার। এরপর আসে ১৯৮৪ সালের ‘সারাংশ’। এ ছবিটি ভারতের বাইরে বিশেষভাবে আলোচিত হয় এবং প্রথমবারের মতো ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে অস্কারের সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে পাঠানো হয়।

বাণিজ্যিক ধারায় সাফল্য
গম্ভীর ও শিল্পধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি মহেশ ভাট বাণিজ্যিক ধারার ছবিতেও সাফল্য পান। ১৯৮৬ সালে মুক্তি পায় ‘নাম’, যা তাঁকে নতুন দর্শকগোষ্ঠী এনে দেয়। নব্বইয়ের দশকে তিনি নির্মাণ করেন ‘সার’, ‘গুমরাহ’ ও ‘ক্রিমিনাল’। সব কটি ছবিই ছিল বাণিজ্যিকভাবে সফল। ১৯৯৯ সালে তিনি নির্মাণ করেন আত্মজীবনীমূলক ছবি ‘জখম’। বাবার মুসলমান মায়ের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, দাঙ্গা ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে তৈরি এ চলচ্চিত্র জাতীয় পুরস্কার জয় করে।

মেয়ের সঙ্গে মহেশ

প্রযোজক মহেশ
পরিচালনার পাশাপাশি প্রযোজক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন মহেশ ভাট। ভাই মুকেশ ভাটকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিশেষ ফিল্মস। এখান থেকে একের পর এক হিট ছবি তৈরি হয়। ২০০৩ সালে মুক্তি পায় ‘জিসম’, যা জন আব্রাহামকে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত করে । ২০০৪ সালের ‘মার্ডার’ ইমরান হাশমির ক্যারিয়ারে নতুন মোড় এনে দেয়। আর ২০০৬ সালের ‘ওহ লামহে...’ আলোচিত হয় এর সংবেদনশীল কাহিনির জন্য। এই প্রযোজনা সংস্থা থেকে উঠে এসেছেন অনেক নতুন তারকা, যাঁরা আজ বলিউডের মূলধারার নায়ক-নায়িকা হয়ে উঠেছেন।

মহেশ ভাটের চলচ্চিত্র যেমন সাহসী, তেমনি তাঁর ব্যক্তিত্বও স্পষ্টভাষী। তিনি কখনোই মুখ লুকিয়ে কথা বলেননি। আর এ কারণেই তাঁর নামের সঙ্গে বিতর্ক জড়িয়ে গেছে বারবার।
মহেশ ভাট ও আলিয়া ভাট

স্পষ্টভাষী, সাহসী নির্মাতা
মহেশ ভাটের চলচ্চিত্র যেমন সাহসী, তেমনি তাঁর ব্যক্তিত্বও স্পষ্টভাষী। তিনি কখনোই মুখ লুকিয়ে কথা বলেননি। ধর্ম, রাজনীতি, সামাজিক বৈষম্য—সব বিষয়ে তিনি খোলামেলা অবস্থান নিয়েছেন। আর এ কারণেই তাঁর নামের সঙ্গে বিতর্ক জড়িয়ে গেছে বারবার। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, তাঁর সিনেমা ব্যক্তিজীবনের প্রতিফলন। অনেক সময় নিজের অভিজ্ঞতাকে চরিত্রের ভেতরে মিশিয়ে দিয়েছেন। ‘অর্থ’ তৈরি হয়েছিল তাঁর বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে । আবার ‘জখম’-এর ভেতর তিনি তুলে ধরেছেন শৈশবের ক্ষত আর পরিচয়ের সংকট।
আজ যখন তিনি ৭৭ বছরে পা রাখলেন, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে। এমনকি পুরোনো ছবিটিও সামনে এসেছে। সমালোচকদের মতে, বাবা-কন্যার স্নেহময় মুহূর্তকে অনেকে যেভাবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, সেটি হয়তো আর কোনো দিন থামবে না । তবে মহেশ ভাটের শিল্পকর্ম বারবার মনে করিয়ে দেয়, মানুষকে একরৈখিকভাবে বোঝা যায় না। বাণিজ্যিক ধারার বলিউডি সিনেমায় তাঁর নামটা টিকে থাকবে বহু বছর।