‘শোলে’ সিনেমায় অমিতাভ বচ্চন ও ধর্মেন্দ্র। আইএমডিবি
‘শোলে’ সিনেমায় অমিতাভ বচ্চন ও ধর্মেন্দ্র। আইএমডিবি

জয়কে একা রেখে চলে গেলেন তাঁর বীরু

‘ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে’—যে গান কোটি মানুষের হৃদয়ে বন্ধুত্বের প্রতীক হয়ে আছে, সেই গানের দুই প্রাণ—জয় আর বীরু—আজ থেকে আর একসঙ্গে নেই। অমিতাভ বচ্চনের জয়কে একা রেখে চিরবিদায় নিলেন তাঁর জীবনের বীরু, বলিউডের আইকন ধর্মেন্দ্র। গতকাল মুম্বাইয়ের পবন হংস শ্মশানে অমিতাভের চোখে ছিল দুশ্চিন্তার ছায়া, মুখে ছিল দীর্ঘদিনের বন্ধুকে হারানোর বেদনা।
১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শোলে’ নায়ক–নায়িকা নয়—দুই বন্ধুর গল্প দিয়েই ভারতীয় চলচ্চিত্রে সৃষ্টি করেছিল এক বৈপ্লবিক সম্পর্কচিত্র। জয় ও বীরুর সেই বন্ধুত্ব আজও ভারতজুড়ে প্রতীক হয়ে আছে। জীবনে–পর্দায় ধর্মেন্দ্র–অমিতাভের বন্ধুত্বও ছিল অটুট; তাই যেন বিদায়ের মুহূর্তে ‘বীরুকে’ হারিয়ে সত্যিকারের ‘জয়’ই হয়ে পড়লেন অমিতাভ।

ব্যক্তিজীবনের অন্তিম অধ্যায়
গতকাল সোমবার সকালে মুম্বাইয়ের জুহুতে নিজ বাসায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন ধর্মেন্দ্র। বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। আগামী ৮ ডিসেম্বর তাঁর ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে পরিবার বড় আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হেমা মালিনী সম্প্রতি বলেছিলেন, ‘তাঁর জন্য একটি আনন্দময় সন্ধ্যার আয়োজন করব।’ কিন্তু সেই সন্ধ্যা আর দেখা হলো না। পরিবার এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে বলিউড–মিডিয়ায় ভর করেছে শোক আর স্মৃতিচারণার ঢল।

‘শোলে’ ছবিতে ধর্মেন্দ্র। আইএমডিবি

দীর্ঘ অসুস্থতা, গুজব
ধর্মেন্দ্র বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। কয়েক সপ্তাহ আগে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় তাঁকে। সে সময় তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে মেয়ে এষা দেওল ও স্ত্রী হেমা মালিনী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান—এ খবর ‘ভুয়া’।  হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর জুহুর বাসাতেই চিকিৎসা চলছিল। ভক্তরা প্রতিদিন তাঁর বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছেন দীর্ঘায়ুর জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা হলো না।

শেষযাত্রা
মুম্বাইয়ের পবন হংসে গতকাল অনুষ্ঠিত হয় ধর্মেন্দ্রর শেষকৃত্য। সকাল থেকেই সেখানে জড়ো হতে থাকেন বলিউডের প্রায় সব প্রজন্মের তারকারা। উপস্থিত ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, শাহরুখ খান, সালমান খান, অক্ষয় কুমার, আমির খান, রণবীর সিং, দীপিকা পাড়ুকোন, সায়রা বানু, শাবানা আজমি, গোবিন্দা, সেলিম খানসহ অসংখ্য তারকা ও আত্মীয়স্বজন। নীরব শোক, অশ্রুসিক্ত চোখ আর নস্টালজিক দৃষ্টিতে তাঁরা জানিয়ে যান শেষ শ্রদ্ধা। তারকাদের এই উপস্থিতি যেন প্রমাণ করে—ধর্মেন্দ্র শুধু বলিউডের বড় নায়কই ছিলেন না, ছিলেন সবার ‘ধর্ম পাজি’, অফস্ক্রিনের হাসিখুশি, অমায়িক এক মানুষ। বিদায়ের এই মুহূর্তে শিল্পীরা যেন নীরবে বলছিলেন—তিনি ছিলেন আলোক, ছিলেন এক যুগের মুখ; তাঁর চলে যাওয়া তাই শুধু এক অভিনেতার মৃত্যু নয়, বলিউডের ইতিহাসের এক অধ্যায়ের অবসান।

ধর্মেন্দ্র

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক
ধর্মেন্দ্রর মৃত্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে শোক, স্মৃতি, সম্মান আর আবেগের ঢেউ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লেখেন—‘ভারতীয় সিনেমার এক যুগের অবসান হলো। তিনি শুধুই অভিনেতা নন—এক আবেগ।’ কারিনা কাপুর খান লিখেছেন—‘শৈশব মানেই “ধর্মেন্দ্র স্যার”। এমন মানুষ বিরল।’ অনিল কাপুর বলেন—‘আমরা এক নায়ক নয়, এক প্রতিষ্ঠানকে হারালাম।’

করণ জোহর লিখেছেন—‘আজ ইন্ডাস্ট্রির আকাশে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো… এমন এক স্থান, যা কেউ কোনো দিন পূরণ করতে পারবে না। আপনি সব সময় থাকবেন, একমাত্র ধর্মজি। আমরা আপনাকে ভালোবাসি, স্যার… আপনাকে ভীষণ মিস করব। স্বর্গ আজ ধন্য। আপনার সঙ্গে কাজ করাটা ছিল আশীর্বাদ।’ দক্ষিণ ভারতের তারকারাও শোক জানিয়েছেন—চিরঞ্জীবী, জুনিয়র এনটিআর, রবি তেজা, আল্লু অর্জুনসহ অনেকে।

‘অনুপমা’য় ধর্মেন্দ্র। আইএমডিবি

ছয় দশকের নক্ষত্রমান যাত্রা
ছয় দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ধর্মেন্দ্র ছিলেন সত্যিকারের নক্ষত্র। ১৯৩৫ সালে পাঞ্জাবে জন্ম নেওয়া এই অভিনেতা ১৯৬০ সালে চলচ্চিত্রে পা রাখেন এবং খুব দ্রুতই বলিউডে নিজের আলাদা জায়গা তৈরি করেন। এরপরের পাঁচ–ছয় দশকজুড়ে তিনি অভিনয় করেছেন ৩০০–রও বেশি ছবিতে—যার মধ্যে অসংখ্য ব্লকবাস্টার আজও জনপ্রিয়। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে ‘আনপড়’ ও ‘ড্রিমগার্ল’, অ্যাকশন হিরো হিসেবে ‘ফুল অউর পাথর’, কমেডির সূক্ষ্ম অভিনয়ে ‘চুপকে চুপকে’, চরিত্রাভিনেতার পরিমিত আবেগে ‘জাদুগর’—প্রতিটি ঘরানাতেই তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। এমনকি খলচরিত্রেও নজর কেড়েছিলেন নিজস্ব ছন্দে। তাঁর বহুমাত্রিক উপস্থিতির কারণেই বলিউড তাঁকে ডাকত—‘হ্যান্ডসাম হিরো অব ইন্ডিয়া’, ‘হিউম্যান টর্চ’ এবং ‘স্মাইলিং স্ট্যালিয়ন’। বিশেষ করে ‘ফুল অউর পাথর’ তাঁকে রাতারাতি সুপারস্টারে পরিণত করে; এরপর প্রায় দুই দশক ধরে তিনি একাই টেনে নিয়ে যান ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমার মূলধারা।

ধর্মেন্দ্রর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় অধ্যায় অবশ্যই ‘শোলে’। বীরুর চরিত্রে তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয় ছবিটিকে যুগান্তকারী করে তোলে। ছবির নির্মাতা, সহ–অভিনেতারা বারবার বলেছেন—বীরুর চরিত্রকে ধর্মেন্দ্র ছাড়া কল্পনা করা যেত না। সেটে তিনি ছিলেন সবচেয়ে হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল; জয়া ভাদুড়ি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘শোলে’র সেট মানেই ধর্মজির হাসি।’ ভারতীয় সমালোচকেরাও বলেন, জয়–বীরুর বন্ধুত্ব কেবল সিনেমার পর্দায় নয়, ভারতীয় সমাজের সাংস্কৃতিক মানচিত্রেও স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে—বন্ধুত্বের ধারণাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে। ধর্মেন্দ্রর অভিনয়ে সেই বন্ধুত্ব যেমন আস্থার প্রতীক ছিল, তেমনি ছিল সংগ্রাম, ভালোবাসা আর অটুট মানবিকতার প্রতিফলন। তাঁর প্রয়াণে তাই এই অসাধারণ অধ্যায়ও যেন পূর্ণচ্ছেদে পৌঁছাল।

হেমা মালিনী–ধর্মেন্দ্র: বলিউডের আইকনিক জুটি
ধর্মেন্দ্রর ব্যক্তিজীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় নিঃসন্দেহে হেমা মালিনীকে ঘিরে। বলিউডে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন এক কিংবদন্তি জুটি, যার প্রেম এবং বিয়ের গল্প ছিল ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত কাহিনিগুলোর একটি। ১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিক থেকে পর্দায় তাঁদের রসায়ন দর্শকদের মোহিত করে রাখত।

‘শোলে’র দৃশ্যে হেমা মালিনী ও ধর্মেন্দ্র। ছবি: আইএমডিবি

একসঙ্গে তাঁরা অভিনয় করেছেন ৩০–এরও বেশি ছবিতে—‘সীতা অউর গীতা’, ‘জুগনু’, ‘ড্রিমগার্ল’, ‘শরীফ বদমাশ’, ‘দোস্ত’—সব কটাই আজও সমানভাবে স্মরণীয়। পর্দার সেই রোমান্টিক জুটির সম্পর্ক যখন বাস্তবের পৃথিবীতে রূপ নিল, তখন তা হয়েছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সামাজিক চাপ, সমালোচনা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁদের সম্পর্ক অটুট ছিল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধর্মেন্দ্রর সঙ্গী হিসেবে ছিলেন হেমা মালিনীই। তিনি প্রায়ই সাক্ষাৎকারে বলতেন—‘ধর্মজি ছিল হাসিমাখা এক সূর্য। যে ঘরে ঢুকত, আলো আর উষ্ণতা নিয়ে ঢুকত।’ ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু তাই তাঁর জীবনে যেন এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করেছে।

ধর্মেন্দ্রর ব্যক্তিজীবন আরও বিস্তৃত, আরও বহুমাত্রিক। তাঁর প্রথম স্ত্রী প্রকাশ কৌরের সংসারেই জন্ম দুই ছেলে—সানি দেওল ও ববি দেওল, যাঁরা দুজনেই বলিউডে প্রতিষ্ঠিত নায়ক। সানি দেওল সম্প্রতি জাতীয় পুরস্কারজয়ী নায়ক হিসেবে নিজেকে নতুন উচ্চতায় স্থাপন করেছেন।
ধর্মেন্দ্রর দুই পরিবার, দুই প্রজন্ম, দুই জীবন—সব কিছুকে তিনি এক স্নেহে, এক উদারতায় ধরে রেখেছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যুতে কেবল বলিউড নয়, তাঁর নিজের পরিবারও যেন হারাল জীবনের সবচেয়ে বড় ভরসা ও সুখের উৎসকে।

ধর্মেন্দ্র। ইনস্টাগ্রাম থেকে

কেন ধর্মেন্দ্র এত বড় ছিলেন?
ধর্মেন্দ্র শুধু পর্দার তারকা ছিলেন না—বলিউডে তাঁকে সবাই চিনত একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে। তাঁর জনপ্রিয়তার মূলে ছিল এই স্বভাবই। শুটিং সেটে কারিগর থেকে সহকারী—সবাইয়ের সঙ্গে একই টেবিলে বসে খাওয়া ছিল তাঁর রীতি। নতুন কোনো অভিনেতা এসেছেন কি না, কোথায় সমস্যায় আছেন, কীভাবে এগোতে হবে—এসব খোঁজখবর নিতেন নিজেই। কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও কোনো জুনিয়র অভিনেতা বা টেকনিশিয়ান তাঁকে ডাকলে অনায়াসে পাশে দাঁড়াতেন। কখনো তারকাসুলভ অহংকার ছিল না, বরং সহজতা আর সরলতা ছিল তাঁর পরিচয়। তাই বলিউডে তাঁর নামের পাশে স্নেহভরে লেখা হতো—‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’।

অ্যাকশন দৃশ্যে তাঁর শক্তি, পর্দায় তাঁর হাসি, সংলাপ বলার ভঙ্গি কিংবা আবেগময় মুহূর্তে তাঁর গভীর অভিব্যক্তি—সব মিলিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন অভিনয়ের এক নিজস্ব ধারা। অনেকেই বলেন, ধর্মেন্দ্র একটি ‘স্কুল’; তাঁর অভিনয়–ধারণা ও পর্দা–ব্যক্তিত্ব থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শিখেছে কীভাবে নায়ক হতে হয়, আবার কীভাবে মানুষ থাকতে হয়। তাঁর চলে যাওয়া তাই শুধু এক কিংবদন্তি অভিনেতাকে বিদায় জানানো নয়, বরং হারিয়ে ফেলা সেই মানবিকতার মূর্ত প্রতীককে, যিনি বলিউডে সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন নিজের আচার–ব্যবহার, চরিত্র ও সৌম্যতার জন্য।

শেষ কাজ ও অসমাপ্ত প্রতীক্ষা
সর্বশেষ তাঁকে দেখা গেছে শহীদ কাপুর ও কৃতি শ্যাননের সঙ্গে ‘তেরি বাতোঁ মে অ্যায়সা উলঝা জিয়া’-তে।
এ বছর বড়দিনে মুক্তি পেতে চলা শ্রীরাম রাঘবনের ছবি ‘ইক্কিস’-এও দেখা যাবে তাঁকে। এটি এখন তাঁর মৃত্যুর পর মুক্তি পাওয়া শেষ ছবি হয়ে দাঁড়াবে।

এক যুগের অবসান
ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু হিন্দি চলচ্চিত্রের একটা যুগের অবসান বলছেন সমালোচকেরা। ছয় দশকের পর্দাজুড়ে যিনি শক্তি, আবেগ, হাসি আর মানবিকতার অনন্য মিশ্রণে দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন, তাঁর অনুপস্থিতি বলিউডে তৈরি করেছে গভীর শূন্যতা বলছেন তারা। অভিনেতা চলে গেছেন, কিন্তু তিনি রেখে যাওয়া কাজ, চরিত্র আর আবেগ ভারতীয় সিনেমাকে আরও বহুদিন আলোকিত করে রাখবে।