সেই কবে দেব আনন্দের ‘হাম নওজোয়ান’-এ কিশোরী মুখে পর্দায় হাজির হয়েছিলেন টাবু। বছরটা ১৯৮৫। প্রায় চার দশকের পেরিয়ে গেছে, তবু সময় যেন থেমে আছে তাঁর সামনে।
অবশ্য তখনো তিনি ছিলেন ‘তাবাসসুম ফাতিমা হাশমি’—একজন ছাত্রী, যে জানত না একদিন বলিউডের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে তাঁকে চিনবে সবাই। আজ ৪ নভেম্বর, সেই টাবুর জন্মদিন।
এক অন্তর্মুখী মেয়ের যাত্রা
তেলেঙ্গানার হায়দরাবাদে জন্ম টাবুর। খুব অল্প বয়সেই বাবা–মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে। মা ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা, বাবা নতুন সংসার পেতেছিলেন অন্যত্র। ছোটবেলা কেটেছে মামাবাড়িতে, নানা-নানীর কোলে। বই ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। টাবু বলেন, ‘আমি খুব শান্ত স্বভাবের ছিলাম। সিনেমায় আসার পরও নিজের জগৎটা ছোট রাখতেই ভালোবাসি।’
শৈশবে ‘বাজার’ (১৯৮২) ছবিতে শিশু চরিত্রে অভিনয়, আর ‘হাম নওজোয়ান’ (১৯৮৫)-এ আত্মপ্রকাশ—দুটোই ছিল জীবনের বড় বাঁক। এরপর একে একে ‘মাচিস’, ‘হু তু তু’, ‘অস্তিত্ব’, ‘চাঁদনি বার’, ‘মকবুল’, ‘হায়দার’, ‘দৃশ্যম’, ‘গোলমাল এগেইন’—সব মিলিয়ে এক অনন্য যাত্রা।
পরিচালকদের প্রিয়, দর্শকের অনন্যা
গুলজার, জে পি দত্ত, মনিরত্নম, সুরজ বরজাতিয়া, ডেভিড ধাওয়ান, বিশাল ভরদ্বাজ—সব প্রজন্মের পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন টাবু। ২০১৯ সালে ‘প্রথম আলো’র মুম্বাই প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপে বলেছিলেন, ‘আমি যখন সিনেমায় আসি, তখন পরিচালকেরা আমার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। এখনকার অনেকে আমার বয়সী বা ছোট। তাই রসায়নটা ভিন্ন, কিন্তু প্রত্যেকের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখেছি।’ গুলজারের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন সংলাপে কবিতার ছোঁয়া, বিশাল ভরদ্বাজের কাছ থেকে চরিত্রের গভীরতা। তাঁর ভাষায়, ‘প্রত্যেক পরিচালকের কাজের ধরন আলাদা। কেউ স্নেহে ভরিয়ে দেন, কেউ দূরত্ব রাখেন। কিন্তু প্রত্যেকেই আমার যাত্রাকে সমৃদ্ধ করেছে।’
চরিত্রের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পাওয়া
দীর্ঘ অভিনয়জীবনে টাবু প্রতিটি চরিত্রে নিজেকে ভেঙেছেন নতুনভাবে। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো এক চরিত্রে দুবার অভিনয় করি না।’ প্রিয় চরিত্রের কথা উঠলে মুখে হাসি ফোটে—‘হু তু তু’-এর মালতি, ‘অস্তিত্ব’-এর আশা, ‘মকবুল’-এর নিজামি, ‘হায়দার’-এর গজনি, ‘মাচিস’-এর ভিন্ন স্বাদের চরিত্রগুলো তাঁর হৃদয়ের খুব কাছের।
‘হায়দার’-এর পর তিনি আবার দর্শককে চমকে দেন ‘গোলমাল এগেইন’-এ। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘গোলমাল করতে গিয়ে একঝাঁক দুর্দান্ত অভিনেতার কাছ থেকে কমেডির সূক্ষ্মতা শিখেছি।’
নিঃসঙ্গতা আর না–বলা গল্পগুলো
টাবুর ব্যক্তিজীবন বরাবরই রহস্যে ঢাকা। কখনো সম্পর্কের গুজব, কখনো নিঃসঙ্গতার গল্প। তিনি নিয়মিত ডায়েরি লেখেন, তবে সেটি প্রকাশের ইচ্ছা নেই এখনো। বলেন, ‘যেদিন সাহস পাব, সেদিন হয়তো প্রকাশ করব।’
পদবি ব্যবহার না করার কারণ নিয়েও তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট: ‘বাবার সঙ্গে আমার সংযোগ ছিল না। তাই তাঁর পদবি নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করিনি। আমি সব সময় তাবাসসুম ফাতিমা ছিলাম।’
‘খুফিয়া’–তে নতুন দীপ্তি
২০২৩ সালে বিশাল ভরদ্বাজের ওয়েব ফিল্ম ‘খুফিয়া’-তে নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনের সঙ্গে তাঁর রসায়ন আলোচনায় আসে। নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর প্রশংসায় ভাসে সিনেমাটি। প্রমাণ মেলে—টাবু এখনো সমান দীপ্ত, সমান প্রাসঙ্গিক।
চার দশকের অভিনয়, অসংখ্য চরিত্র, বহু পুরস্কার—সব মিলিয়ে টাবু এখন এক প্রতীক। শান্ত, স্থির, আত্মবিশ্বাসী এক নারী, যিনি নিজেই নিজের পথ তৈরি করেছেন। বয়স যেন তাঁর কাছে শুধু সংখ্যা। মেকআপ ছাড়াও আত্মবিশ্বাসী, অনাড়ম্বর, তবু পরিপূর্ণ।
‘অভিনয় আমার আশ্রয়, নির্জনতা আমার শক্তি’—এই দুটি বাক্যে যেন মিশে আছে টাবুর সারা জীবনের গল্প। তিনি আজও বলিউডের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী নারীমুখ—নিঃশব্দ অথচ দীপ্ত।