‘আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস ওড়াই। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমরা এই কয়জন বেঁচে আছি জীবনে একটা ফিল্ম বানাব বলে…’ আমন্ত্রণপত্রের শুরুতে ঠিক এমনভাবেই লেখা ছিল। আমন্ত্রণটি ছিল ফ্রেন্ডলি নেইবারহুড ফিল্মমেকার্সের পক্ষ থেকে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় প্রদর্শিত হয় ১০ জন নির্মাতার ১০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা। এই শহরের কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ ৯টা–৫টার চাকরির চক্করে কিংবা নিজেদের আলসেমির জন্য সিনেমাটা ঠিক বানিয়ে উঠতে পারছিলেন না। অনেক দিনের এই চাপা পড়া ইচ্ছাটাকে হঠাৎ করেই হাওয়া দেওয়া শুরু করলেন তাঁরা। সাহস করে অফিস পালিয়ে তাঁরা নেমে গেলেন অল্প পরিসরে, স্বল্প খরচে গল্প বানানোর চ্যালেঞ্জে। এদিন ছিল সেই ১০ সিনেমার প্রদর্শনী। সিনেমাগুলো হলো—
১০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ও পরিচালক
‘হুদাই মিস’, জাহিদুল হক অপু
সুযোগ আসে অপ্রত্যাশিতভাবে, ক্ষণিকের মরীচিকার মতো। যখন আসে, তখন তা বোঝার ক্ষমতা না থাকলে মুহূর্তেই তা হাতছাড়া হয়ে যায়। ‘হুদাই মিস’ এমনই এক গল্প বলে, যেখানে দুজন আগন্তুকের সাক্ষাৎ ও জীবনের অমূল্য সুযোগগুলো রাগ, তাড়াহুড়া কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কাছে হার মানে।
‘হামাংকুলাস’, ইবনে নুর রাকিব
সকাল থেকে ব্রেকিং নিউজ চলছে, কেন যেন আয়নাতে আর মানুষের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে না। চোখে কাজল আঁকতে পারছে না একটা মেয়ে। কিন্তু এটাই একমাত্র রহস্য নয়! মেয়েটা কখনোই খেয়াল করে না, তার পেছন পেছন সারা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার মতোই দেখতে আরেকটা মেয়ে। এই মেয়েটা কে? সে কী চায়?
‘সোলমেট’, আদেল ইমাম অনুপ
গল্পটি একদিকে লয়ালিটির প্রতীক, অন্যদিকে ক্ষমতার পর বদলে যাওয়া সম্পর্কের নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরে। এটি বোঝায়, যাকে একসময় সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মনে হতো, সাফল্য পাওয়ার পর তাকেই ফেলে দেওয়া হয়। এটি রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যঙ্গ হিসেবে পড়া যেতে পারে, যেখানে ক্ষমতা পাওয়ার পর পুরোনো সঙ্গীদের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে।
‘চা চাই’, শেখ কোরাশানী
সকাল-বিকাল-রাত বউয়ের শুধু একটাই কথা—‘চা চাই’! কাপের পর কাপ চা তৈরি করে স্বামী! হাত ব্যথা! ক্লান্তি! চুমুকের পর চুমুকে শেষ হয় চা! তবু কেন যেন বউয়ের তৃষ্ণা মেটে না। বাড়তে থাকে আধোয়া কাপের স্তূপ। সঙ্গে বাড়তে থাকে রাগ আর সম্পর্কের দূরত্ব।
‘তেলাপোকা’, আল-আমিন হাসান নির্ঝর
আমাদের সমাজের কপটতা বা ভণ্ডামির এক খণ্ডচিত্র রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরার প্রয়াস এই ‘তেলাপোকা’। গল্পটি এক তরুণী ও একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের আপাততুচ্ছ কথোপকথনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, কিন্তু সেই কথাবার্তার মাঝেই লুকিয়ে আছে সূক্ষ্ম স্যাটায়ার। খুব সামান্য কারণেই অন্যের সমালোচনা করার একটি প্রবণতা আমাদের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায়, যে কারণে আমরা সমালোচনা করি, সেই একই দোষে আমরা নিজেরাও দুষ্ট।
‘লোক’, মাহমুদা সুলতানা রীমা
একটি গ্রামে এক এক করে সব পুরুষ উধাও হয়ে যাচ্ছে। আর ওই গ্রামেই বাস করে এক ডাইনি, যে কিনা জাদুবিদ্যা চর্চা করে। গ্রামবাসীর ধারণা হলো, সেই পুরুষগুলোকে এই ডাইনি উধাও করে। সত্যিই কি এই ডাইনি পুরুষদের উধাও করে দেয়? আর করলেই–বা কেন করে? কীভাবে করে? জানতে হলে দেখতে হবে ‘লোক’।
‘ইন অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড’, কনক খন্দকার
অপু, এক তরুণ, বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ফোনে মগ্ন। হেডফোনে চলছে জোরে গান, সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে করতে একটি লাইভ ভিডিও তার নজরে আসে, কয়েকজন ছেলে একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করছে। ক্ষুব্ধ অপু ভিডিওটি নিজের প্রোফাইলে শেয়ার করে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে বের করে। মুহূর্তেই অনলাইনে শুরু হয় আলোচনার ঝড়। কিন্তু ভিডিওটি কয়েকবার দেখার পর অপু আবিষ্কার করে, ঘটনাটি খুব চেনা লাগছে। ক্রমে সে বুঝতে পারে, ঘটনাস্থলটা তার আশপাশেই। বাস্তবতা আর ভার্চ্যুয়াল জগৎ এক হয়ে যায়। এই শর্ট ফিল্মটি প্রশ্ন তোলে, প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য কি কেবল স্ক্রিনই যথেষ্ট?
‘ফর সেল’, ফজলে রাব্বি
শহরের কোলাহলে এক তরুণ খুঁজে ফিরছে নিজেকে—স্বপ্ন, সুর আর নিশ্বাসের ভেতর একসঙ্গে ডুবে থাকা আহনাফ আবিদ। ভালো গান করে আবিদ, প্যাশন আঁকড়ে ধরে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যায়। প্রেম, পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশার সঙ্গে তার লড়াই প্রকট হয়ে ওঠে। তার জীবনের একমাত্র আশার প্রদীপ—একটি কনসার্টের সুযোগ—হঠাৎ নিভে যায়। ধীরে ধীরে সে নিজের অস্তিত্ব, স্বপ্ন ও পরিচয়কে প্রশ্ন করতে থাকে।
‘অন দ্য কন্ট্রারি’, ইমতিয়াজ হোসেন
নিজের সিনেমা প্রদর্শনের সন্ধ্যায় বাস্তবতা-পরাবাস্তবতায় পাড়ি দিলে নির্মাতা মুখোমুখি হয় তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্বে। যেখানে ভালোবাসা হয়ে যায় ম্লান, আবেগ মূল্যহীন, আর অহংকার হয় নগ্ন।
‘ইশপাইট’, আবীর ফেরদৌস মুখর
একটি ব্যস্ত নগরীর শ্রমজীবী দম্পতি, বেলাল ও সালমা, প্রতিদিনের মতো কাজ শেষে বাড়ির পথে রওনা হয়। দীর্ঘ পথচলায় তারা একে অপরের সঙ্গে গল্প করে, হাসে, কখনোবা ছোট ছোট সংকটের মুখোমুখি হয়। এক রাতের এই সাধারণ যাত্রায় ধরা পড়ে তাদের সম্পর্কের গভীরতা, স্বপ্ন, সংগ্রাম ও একসঙ্গে পথচলার গল্প। ছোট ছোট সিদ্ধান্ত, কথোপকথন আর মুহূর্তগুলো মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক আবেগঘন গল্প, যেখানে ভালোবাসা প্রকাশ পায় একদম সাদামাটা অথচ গভীরভাবে।
আয়োজকদের ভাবনা
‘মনে মনে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন, আর কপালে করপোরেট জব! এমন কয়েকটা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হলে যা হয় আর কী! চায়ের ব্রেকে, লাঞ্চ টাইমে বা কাজের ফাঁকে নিজেদের মধ্যে শুধু একটা টপিকেই কথা—জীবনে অন্তত একটা সিনেমা বানাব।’ কথাগুলো বলছিলেন ফ্রেন্ডলি নেইবারহুড ফিল্মমেকার টিমের মুখপাত্র শেখ কোরাশানী।
শেখ কোরাশানী আরও বলেন, ‘একসময় নিজেরাই বুঝতে পারলাম, শুরু না করলে কখনোই বানানো হবে না। অন্তত হাত তো পাকাতে হবে! তা ছাড়া কয়েকজনের তো আগেই বানানোর অভিজ্ঞতাও আছে। আমাদের মধ্যে একজন সুন্দর উদাহরণ টানল, কোনো এক দিন বিরিয়ানি খাব বলে সারা মাস না খেয়ে থাকলে হবে? ভাত–ডাল তো খেতে হবে! কোনো এক দিন সিনেমা বানাব ঠিকই, আপাতত শর্টফিল্ম বানাই। ব্যস! শুরু হলো আমাদের প্রজেক্ট।’
কসমেটিকা ঢাকার পৃষ্ঠপোষকতায় ৩০ মে এই আয়োজন করা হয়। আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী।