‘দেলুপি’র দৃশ্য
‘দেলুপি’র দৃশ্য

দুর্যোগ আর রাজনৈতিক আবহে মানবিক গল্প

মুক্তির আগেই ফেসবুকজুড়ে আলোচনা। নানা গ্রুপ, চলচ্চিত্রপ্রেমীদের পোস্ট, বন্ধু–অপরিচিতের টাইমলাইন—ঘুরে ফিরছিল এই নাম। নির্মাতা, অভিনেতা আফজাল হোসেন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যাঁরা ভালো সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন, যাঁরা দেশে ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হলে খুশি হন, তাঁদের জন্য আনন্দের সংবাদ। চমকে দেবার মতো অতি চমৎকার একটা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে।’

‘দেলুপি’র দৃশ্য

১৪ নভেম্বর সিনেমাটি দেখে সুরকার–গীতিকার প্রিন্স মাহমুদ লেখেন, ‘একটা সিনেমা দেখলাম—মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের ‘দেলুপি’। এমন মুগ্ধতা খুব কম সিনেমা দেখেই হয়। কী গল্প, দৃশ্যকল্পের বর্ণনা, চরিত্রের পরিবর্তন আর মিউজিকের পরিমিতিবোধ! পরিচালনা, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা আর অভিনয়—সবই গভীর ছাপ রাখল।’ এসব দেখেশুনে ছবিটা দেখার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। এসব দেখে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। শুরু করলাম ‘দেলুপি’র যাত্রা—যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের টিকে থাকার লড়াই মিলেছে এক স্রোতে।

যাঁরা ভালো সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন, যাঁরা দেশে ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হলে খুশি হন, তাঁদের জন্য আনন্দের সংবাদ। চমকে দেবার মতো অতি চমৎকার একটা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে।
আফজাল হোসেন,নির্মাতা, অভিনেতা

গল্প নিয়ে গল্প
শুরুটা অন্য রকম। দেখা যায়, দেশের সরকারপ্রধান সাধারণ মানুষের গণবিপ্লবের মুখে ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। রাজনৈতিক এই অস্থিরতার মধ্যেই ভয়াবহ বন্যা প্লাবিত করে একটি গ্রামের জীবন। মানুষের ঘরবাড়ি, রুজিরোজগার, পথঘাট—এক রাতেই সব ভেসে যায়। যাত্রাশিল্পী পরিবারের ছেলে পার্থ (চিরনজিৎ বিশ্বাস) ধীরে ধীরে পরিবারের ভেঙে পড়া প্রত্যক্ষ করে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন হতাশা, তখনই পার্শ্ববর্তী গ্রামের নূপুরের (অদিতি রায়) সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়ে ওঠে আশ্রয়ের মতো। এই প্রেমই গল্পে এনে দেয় সূক্ষ্ম উষ্ণতা। যা কঠিন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।


দখলদারির রাজনীতি
দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকা স্থানীয় নেতা জাকির (জাকির হোসেন) গ্রামে ফিরে আসে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের অজুহাতে। শুরু হয় চাঁদাবাজি, দখলদারি আর ক্ষমতার প্রদর্শন। ঠিক তখনই শহরে পড়াশোনা করা তরুণ মিহির (রুদ্র রায়) গ্রামে ফিরে আসে। অতীতের রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও গ্রামের প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে জাকিরের বিপরীতে দাঁড় করায়।
বন্যা, নদীভাঙন, রাজনৈতিক বিভাজন, পার্থ–নূপুরকে নিয়ে কানাঘুষা—সবই একই চিত্রের অংশ হয়ে ওঠে। মানুষের সাহস, মতাদর্শিক টানাপোড়েন আর টিকে থাকার জেদের ওপর ভর করে গল্প এগিয়ে যায়।

একটা সিনেমা দেখলাম—মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামের ‘দেলুপি’। এমন মুগ্ধতা খুব কম সিনেমা দেখেই হয়। কী গল্প, দৃশ্যকল্পের বর্ণনা, চরিত্রের পরিবর্তন আর মিউজিকের পরিমিতিবোধ! পরিচালনা, সিনেমাটোগ্রাফি, সম্পাদনা আর অভিনয়—সবই গভীর ছাপ রাখল।
প্রিন্স মাহমুদ
‘দেলুপি’ সিনেমার দৃশ্য

তাওকীরের সংযত পৃথিবী
তাওকীরের নির্মাণশৈলীর মূল শক্তি—পরিমিতি, স্থিরতা ও কঠিন বাস্তবতার নীরব বয়ান। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিস্তৃত বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন বিন্দুমাত্র অতিনাটকীয়তা ছাড়া। সংযত ক্যামেরা, বাস্তবিক সংলাপ আর নীরবতার ভেতর লুকিয়ে থাকা টানটান উত্তেজনা—সব মিলিয়ে গল্পে তৈরি হয়েছে ঘন বাস্তবতা।
৫ আগস্ট–পরবর্তী দেশের ঘটনাপ্রবাহ এখানে যেন ছোট এক প্রতিচ্ছবি—ক্ষমতার বদল, বন্যা, দখলদারি, শ্রেণিসংঘাত থেকে প্রেম ও সন্দেহ—সবই একই ফ্রেমে সমান্তরালে প্রবাহিত।

বন্যা, নদীভাঙন, রাজনৈতিক বিভাজন, পার্থ–নূপুরকে নিয়ে কানাঘুষা—সবই একই চিত্রের অংশ হয়ে ওঠে। মানুষের সাহস, মতাদর্শিক টানাপোড়েন আর টিকে থাকার জেদের ওপর ভর করে গল্প এগিয়ে যায়।

সংলাপ—ব্যঙ্গ, কৌতুক ও নির্মম সত্য
‘দেলুপি’র প্রাণ তার সংলাপ—ব্যঙ্গ, কৌতুক আর নির্মম সত্য একসঙ্গে বোনা। সবচেয়ে আলোচিত সংলাপটি—
‘এক সরকার এসে বলে যাত্রা হবে। আরেক সরকার এসে বলে যাত্রা হবে না। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? আমি যাত্রাশিল্পী, আমি আমার অভিনয় করব।’
এই একটিমাত্র বাক্যেই ধরা পড়ে সময়ের তীক্ষ্ণ বাস্তবতা, শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন ও ক্ষমতার খামখেয়ালির বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ। সংলাপ শুধু হাসায় না—মুহূর্তে থমকে দেয়, আয়নার মতো সামনে তুলে ধরে সমাজ–রাজনীতির চাপা উত্তাপ। কথার হালকা রসবোধের নিচে লুকিয়ে থাকে গভীর ক্ষত, আর সেখানেই সংলাপ হয়ে ওঠে সিনেমার অন্যতম শক্তি।

কথা কম, শব্দ বেশি—এমন এক জগৎ তৈরি করেছে ‘দেলুপি’, যেখানে দর্শককে টেনে নেয় আলো–অন্ধকার–নীরবতার গভীরে।

সংগীত ও শব্দ—আবেগকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়
‘দেলুপি’র আবহ গঠনে সংগীত ও শব্দ কাজ করেছে নীরব কিন্তু প্রভাবশালী শক্তির মতো। রাজেশ সাহা ও সজীব রঞ্জন বিশ্বাসের সাউন্ড ডিজাইন, রাশিদ শরিফ শোয়েবের মিক্সিং এবং তপেশ চক্রবর্তীর আবহসংগীত—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক স্বতন্ত্র ও গভীর শব্দ–জগৎ।
প্রতিটি দৃশ্যে শব্দ যেন ভাসমান উত্তেজনা—কখনো নরম, কখনো কণ্টকিত।
তাওকীরের পরিচিত বৈশিষ্ট্য—ইচ্ছাকৃত ছন্দভাঙা সুরের ধাক্কা—এখানেও নিখুঁতভাবে ব্যবহার হয়েছে। এই ছোট্ট ‘বাধা’ দৃশ্যকে করে তোলে আরও তীক্ষ্ণ, চরিত্রের অনুভূতি ও গ্রামীণ জীবনের আতঙ্ককে করে আরও স্পষ্ট।
কথা কম, শব্দ বেশি—এমন এক জগৎ তৈরি করেছে ‘দেলুপি’, যেখানে দর্শককে টেনে নেয় আলো–অন্ধকার–নীরবতার গভীরে।

চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব নিজেই সামলেছেন তাওকীর। সীমিত যন্ত্রপাতি, বাস্তব লোকেশন আর প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও তিনি নির্মাণ করেছেন বহু শক্তিশালী দৃশ্য। কিছু ফ্রেমে সামান্য অমসৃণতা বা অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘতা চোখে পড়লেও দৃশ্যায়নের সততা ও সাহস তা ঢেকে দেয়।
‘দেলুপি’ সিনেমার দৃশ্য

চিত্রগ্রহণ ও অভিনয়—বাস্তবের শক্তি
চিত্রগ্রাহকের দায়িত্ব নিজেই সামলেছেন তাওকীর। সীমিত যন্ত্রপাতি, বাস্তব লোকেশন আর প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও তিনি নির্মাণ করেছেন বহু শক্তিশালী দৃশ্য। কিছু ফ্রেমে সামান্য অমসৃণতা বা অপ্রয়োজনীয় দীর্ঘতা চোখে পড়লেও দৃশ্যায়নের সততা ও সাহস তা ঢেকে দেয়।

‘দেলুপি’ মিষ্টি প্রেমের গল্প, নিখাদ বন্ধুত্বের গল্প, বন্যায় ডুবতে ডুবতে বাঁচতে চাওয়া এই দেশের সরল মানুষের গল্প, ভীষণভাবে লেয়ারড রাজনৈতিক গল্প, কিন্তু এর বাইরে গিয়েও আশাবাদের গল্প। ‘দেলুপি’ আশা দেখায় স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের, আশা দেখায় রাজনৈতিক বৈরিতা থাকার পরেও এক হওয়ার। তাওকীর ও তার টিমকে টুপিখোলা অভিনন্দন, সংক্ষুব্ধ এই সময়ে ‘দেলুপি’ বানিয়ে দেখানোর জন্য।
আশফাক নিপুণ, নির্মাতা

বিশেষ করে কৃষ্ণের কংসবধের সমান্তরালে পার্থ–নূপুরের বিয়ের দৃশ্য—ছবির সবচেয়ে স্মরণীয় ও প্রতীকধর্মী মুহূর্ত।
অভিনয়েও তাঁর পছন্দ ভিন্ন। শাটিকাপ ও সিনপাট–এর মতো এখানে তিনি নিয়েছেন বাস্তব জীবনের মানুষ—যাদের মুখে জীবনের রেখা, যাদের গতিতে বাস্তবতার ছাপ। এই প্রান্তিক ও কম আলোচিত মানুষ গল্পে এনে দেয় প্রবল বিশ্বাসযোগ্যতা। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু, কেরালা ও মহারাষ্ট্রের সিনেমায় যে বাস্তবানুগ অভিনয়ের ধারা দেখা যায়—তাওকীর বাংলাদেশেও সেই পথ গড়ে তুলছেন।

বাংলাদেশে কোনো চলচ্চিত্র সাধারণত প্রথমে ঢাকার মাল্টিপ্লেক্স দিয়ে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ‘দেলুপি’ বেছে নিল সম্পূর্ণ বিপরীত পথ।

মুক্তির কৌশল ও মানুষই শেষ ভরসা
বাংলাদেশে কোনো চলচ্চিত্র সাধারণত প্রথমে ঢাকার মাল্টিপ্লেক্স দিয়ে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ‘দেলুপি’ বেছে নিল সম্পূর্ণ বিপরীত পথ। প্রথম সপ্তাহে ছবিটি মুক্তি পেল শুধু খুলনার প্রেক্ষাগৃহে। এক সপ্তাহ পর—১৪ নভেম্বর—সারা দেশে ছড়িয়ে গেল। এ সিদ্ধান্তেই স্পষ্ট—তাওকীর বাজারের নিয়ম নন, নিজের চলচ্চিত্রচিন্তাকেই অগ্রাধিকার দেন। আর সেই চিন্তার কেন্দ্র মানুষ। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা দুর্যোগকে নয়, মানবিক সম্পর্ককেই কেন্দ্রে রেখেছে ‘দেলুপি’। কারও কাছে শুরুর গতি ধীর মনে হলেও এই ধীরতাই গল্পকে নিয়ে যায় গভীর স্তরে—যেখানে থাকে হাত ধরার শক্তি, সম্পর্কের স্থায়িত্ব আর টিকে থাকার শান্ত জেদ।

একনজরে
সিনেমা: ‘দেলুপি’
ধরন: ড্রামা
পরিচালনা, প্রযোজনা ও চিত্রগ্রহণ: তাওকীর ইসলাম
চিত্রনাট্য: তাওকীর ইসলাম ও অমিত রুদ্র
অভিনয়: চিরনজিৎ বিশ্বাস, অদিতি রায়, রুদ্র রায়, মো. জাকির হোসেন
দৈর্ঘ্য: ১ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট

‘মহানগর’ নির্মাতা আশফাক নিপুণ সিনেমাটি দেখে রেটিং দিয়েছেন এভাবে—এই সিনেমার চিত্রনাট্য, সিনেমাটোগ্রাফি এবং এডিটিং-১০/১০। তিনি লিখেছেন, ‘“দেলুপি” মিষ্টি প্রেমের গল্প, নিখাদ বন্ধুত্বের গল্প, বন্যায় ডুবতে ডুবতে বাঁচতে চাওয়া এই দেশের সরল মানুষের গল্প, ভীষণভাবে লেয়ারড রাজনৈতিক গল্প, কিন্তু এর বাইরে গিয়েও আশাবাদের গল্প। ‘দেলুপি’ আশা দেখায় স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের, আশা দেখায় রাজনৈতিক বৈরিতা থাকার পরেও এক হওয়ার। তাওকীর ও তার টিমকে টুপিখোলা অভিনন্দন, সংক্ষুব্ধ এই সময়ে ‘দেলুপি’ বানিয়ে দেখানোর জন্য। ‘দেলুপি’ বড় পর্দার সিনেমা, না দেখলে মিস করবেন।’ আমরাও মিস করিনি। আপনিও দেখতে পারেন।