‘সুজন সখী’ সিনেমায় অভিনয় করেন ফারুক ও কবরী। কোলাজ
‘সুজন সখী’ সিনেমায় অভিনয় করেন ফারুক ও কবরী। কোলাজ

সুজন আর সখী কেউই আজ বেঁচে নেই

পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে দুই ভাই সুলেমান (খান আতাউর রহমান) ও লোকমান (ইনাম আহমেদ) আলাদা হয়ে যায়। সুলেমান যাওয়ার সময় তার সব সম্পত্তি তার ভাতিজা সুজনকে (ফারুক) দিয়ে যায়। সুজন লোকমানের ছেলে। সুলেমানের স্ত্রী (মিনু রহমান) কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে মারা যায়, আর সেই কন্যাসন্তানের নাম রাখা হয় সখী (কবরী)। সুলেমানের মেয়ে সখী তার দাদির আদরযত্নে বড় হতে থাকে। একদিন সুজনের সঙ্গে সখীর পরিচয় হয় এবং ঘটনাক্রমে তাদের প্রণয় ঘটে। কিন্তু তারা দুজনের কেউই কারও আসল পরিচয় জানে না। সখী একদিন তার দাদির সঙ্গে সুজনের পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি সুজনকে দেখে চিনতে পারেন। তখনই তারা তাদের আসল পরিচয় জানতে পারে। তারপর সুজন আর সখীর প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুই ভাইয়ের পুরোনো দ্বন্দ্ব! গল্প চেনা, বাংলা সিনেমার নিয়মিত খোঁজখবর রাখা দর্শকেরা বহুল চর্চিত ‘সুজন সখী’র গল্প শুনেই বুঝে যাওয়ার কথা। খান আতাউর রহমান পরিচালিত সিনেমাটির সুবর্ণজয়ন্তী আজ। ১৯৭৫ সালের আজকের দিনেই মুক্তি পায় সিনেমাটি।

কেন গুরুত্বপূর্ণ
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোতে স্থান পেয়েছে যুদ্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আর জীবনের গল্প। ১৯৭২ সালে ‘ওরা ১১ জন’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’র মতো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাগুলো মুক্তি পায়। একই বছরে মুক্তি পাওয়া ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘লালন ফকির’, ‘এরাও মানুষ’-এর মতো জীবনীনির্ভর ও প্রান্তিক মানুষের কাহিনিও নির্মাতারা ফুটিয়ে তুলেছেন চলচ্চিত্রে। ১৯৭৩ সালের কোরবানির ঈদে মুক্তি পায় পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের এক ছবি—জহিরুল হকের রংবাজ। স্টাইলিশ লুক, দুর্দান্ত গান, সাহসী নাচ, অ্যাকশন আর রাজ্জাক-কবরীর পর্দার রসায়ন; মুক্তির পরই চমকে দেয় সিনেমাটি। তবে ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত দুই সিনেমা। কিছুদিন আগেই দুই সিনেমার একটি ‘লাঠিয়াল’-এর ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে, এবার ‘সুজন সখী’র পালা। ‘লাঠিয়াল’-এর মতো এ সিনেমাতেও আছেন ফারুক; আদতে এ দুই সিনেমার সাফল্যের পর গণমানুষের নায়ক হয়ে ওঠেন ফারুক। গ্রামীণ চরিত্রগুলো যেন হাত ধরে নতুন মাত্রা পায়।

ফারুক ও কবরী অভিনীত দর্শকপ্রিয় সিনেমা ‘সুজন সখী’

ফারুক অভিনীত অধিকাংশ চরিত্রই ছিল এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি, তথা গ্রামীণ যুবকের চরিত্র। ফলে সদ্য স্বাধীন দেশে গড়ে ওঠা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা প্রধানত গ্রাম থেকে এসেছিল, তারা ফারুক অভিনীত চরিত্রের মধ্যে নিজেদের খুঁজে পায়। ‘তখন বাংলা ছবির ইতিহাসে আমার জানামতে, রূপবান-এর পরে যে ছবিটি ব্যবসাসফল হয়েছে, সেটা ‘সুজন সখী’। এ ছবি রিলিজ হওয়ার পর ‘সুজন’-এর ক্যারেক্টার নিয়ে একটা হইচই পড়ে গিয়েছিল,’ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ফারুক। সখী চরিত্রে কবরীও ছিলেন দারুণ; গ্রামীণ পটভূমির গল্প আর অভিনয় মিলিয়ে সত্তরের দশক তো বটেই, দেশের বাণিজ্যিক সিনেমার ইতিহাসেরই অন্যতম উল্লেখযোগ্য সিনেমা এটি।

খান আতার ছদ্মনাম
‘সুজন সখী’ সিনেমার পোস্টার দেখে আপনি চমকে যেতে পারেন। কারণ, সেখানে লেখা, প্রমোদকারের ছবি। এই প্রমোদকর আবার কে? আদতে তিনি খান আতাউর রহমান; এ সিনেমায় ‘প্রমোদকার’ ছদ্মনাম নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেন? চার বছর আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সে কথাই বলেছিলেন খান আতাউর রহমানের ছেলের সংগীতশিল্পী আগুন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা মূলত আর্টফিল্ম ঘরানার সিনেমা বানাতেন, এখন আমরা যেটাকে বিকল্প ধারা বলি। ব্যক্তিগত কারণে হঠাৎ সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা সুজন সখী নির্মাণে হাত দেন। সে সময় বাবা ও তাঁদের যে সার্কেল ছিল, তাঁরা আর্টফিল্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু “সুজন সখী” বাণিজ্যিক হওয়ার কারণে বাবা নিজের নাম বাদ দেন। ফুল কমার্শিয়াল সিনেমা তিনি ওন করতেন না। কেউ যেন বুঝতে না পারে, সে জন্য ছদ্মনাম “প্রমোদকার” ব্যবহার করেন। এখন সঠিক মনে নেই, এটা মনে হয় মুক্তিও পায় ছদ্মনামেই। পরে যখন দর্শক গ্রহণ করেন, সুপারহিট হয়, তখন অনেকেই বাবাকে বলেছিলেন, পরিচালকের নামটা দেওয়া উচিত। তখনই নাম যোগ করা হয়।’
আগুন আরও বলেন, ‘বাবার সিনেমার নাম ও গল্প দেখলেই বুঝতে পারবেন সেই অর্থে নাচ-গানে, মারপিটে ভরপুর বাণিজ্যিক সিনেমা বাবা নির্মাণ করেননি। বাবা নিজে যা পছন্দ করতেন, সেটাই করতেন।’

কেউই আর বেঁচে নেই
আজ ‘সুজন সখী’র সুবর্ণজয়ন্তী। কিন্তু সিনেমার নির্মাতা খান আতাউর রহমান, কাহিনিকার আমজাদ হোসেন, অভিনয়শিল্পী ফারুক, কবরী (সারাহ বেগম কবরী), ইনাম আহমেদ, রওশন জামিলদের কেউই আজ বেঁচে নেই।

‘সুজন সখী’র পোস্টার। আইএমডিবি

পুরস্কার
১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল ঘোষণা করা হয় দেশের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সেখানেও তিনটি পুরস্কার পায় ‘সুজন সখী’। সিনেমার গান ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা’র জন্য শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছিলেন আবদুল আলীম, শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হন সাবিনা ইয়াসমীন। পরিচালনা, চিত্রনাট্য লেখার সঙ্গে সিনেমার সংগীত পরিচালনার দায়িত্বও সামলেছিলেন খান আতা। তিনি পান শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার।

প্রিন্ট উদ্ধার
দীর্ঘদিন ‘সুজন সখী’ সিনেমার কোনো প্রিন্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালে ফিল্ম আর্কাইভের চলচ্চিত্র সংগ্রাহক মোহাম্মদ ফখরুল আলম এটির সন্ধান পান খান আতাউর রহমানের অফিসের কর্মচারী দেলোয়ারের কাছে। সে সময় বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৯৯০-৯১ সালের দিকে সাদা–কালো ছবি সিনেমা হলে কম চলায় খান আতাউর রহমানের ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার সৌমেন বাবু ছবিটি বিক্রি করে দেন মিয়া আলাউদ্দিনের কাছে। তাঁর কাছ থেকে ছবিটির একটিমাত্র কপি বেটাকম ক্যাসেটে কিনে রাখেন মধুমিতা মুভিজের মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ।

রিমেক
১৯৯৪ সালে সালমান শাহ ও শাবনূরকে নিয়ে একই নামে ‘সুজন সখী’র রিমেক করেন শাহ আলম কিরণ। সিনেমাটিতে আরও অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, সাদেক বাচ্চু ও আনোয়ারা বেগম। ‘সুজন সখী’ কলকাতাও রিমেক হয়। স্বপন সাহার সেই সিনেমায় অভিনয় করেন অভিষেক চ্যাটার্জি, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, টেলি সামাদ প্রমুখ।