
চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়হান রাফি ও চলচ্চিত্র সাংবাদিক আলিমুজ্জামান পেয়েছেন ‘ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫’। রোববার দুপুরে রাজধানীর চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনাড়ম্বর কিন্তু আবেগঘন অনুষ্ঠানে তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান, অভিনেতা ও নির্মাতা আফজাল হোসেন, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ইমপ্রেস গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার, রন্ধনবিদ ও ফজলুল হকের কন্যা কেকা ফেরদৌসী, অভিনেত্রী ও নির্মাতা আফসানা মিমি, অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম, আনন্দ আলো সম্পাদক রেজানুর রহমান, সাংবাদিক আবদুর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রদর্শিত হয় শহিদুল আলম পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র সম্মুখযাত্রী ফজলুল হক।
‘ফজলুল হক—বাংলাদেশের সিনে সাংবাদিকতার জনক’
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্রচর্চার অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত প্রয়াত ফজলুল হক। তিনি দেশের প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা সিনেমার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। পঞ্চাশের দশকে যখন দেশীয় সিনেমাশিল্প নবযাত্রা শুরু করছে, তখন ফজলুল হক চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা শুরু করে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁকে তাই ‘সিনে সাংবাদিকতার জনক’ বলা হয়। তিনি দেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর নির্মাণে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। পাশাপাশি নিজেও নির্মাণ করেছেন সান অব পাকিস্তান (প্রেসিডেন্ট) ও উত্তরণ, যা দেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে পথিকৃৎ কাজ হিসেবে বিবেচিত। অনুষ্ঠানে এমনটাই মন্তব্য করেন বক্তারা।
তাঁদের মতে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির বিকাশে ফজলুল হকের অবদান অপরিসীম, অথচ তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্বাধীনতা পদক বা একুশে পদকে ভূষিত হননি, এ এক বড় বঞ্চনা। আনন্দ আলো সম্পাদক রেজানুর রহমান অনুষ্ঠানে বলেন, ‘যাঁরা কোনো কিছুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, তাঁদের অনেক সময়ই মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু ফজলুল হক ছিলেন আমাদের গুরু। তিনি চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। আমরা ফজলুল হক স্মৃতি কমিটির পক্ষ থেকে দাবি জানাই, তাঁকে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।’
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বলেন, ‘ফজলুল হককে জানা মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শিকড় জানা। তাঁর কর্মপ্রবাহ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।’ অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘ফজলুল হক আমাদের সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতীক। তাঁকে জানার মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎকে চিনতে পারি।’ চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান বলেন, বাংলাদেশের অনেক পুরস্কার নিয়েই বিতর্ক আছে, কিন্তু ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার নিয়ে কখনো কোনো বিতর্ক হয়নি, এটাই এর মর্যাদার প্রমাণ।
অভিনেত্রী ও নির্মাতা আফসানা মিমি বলেন, ‘ফজলুল হকের স্মৃতি অমলিন রাখতে আমরা আরও কিছু কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজনের পরিকল্পনা করেছি, যাতে নতুন প্রজন্ম তাঁর জীবন ও কাজ সম্পর্কে জানতে পারে।’
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বলেন, ‘ফজলুল হকের কর্মজীবন নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র সম্মুখযাত্রী ফজলুল হক আমরা শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদর্শনের উদ্যোগ নেব। পাশাপাশি সারা দেশের জেলা শিল্পকলা একাডেমির নতুন প্রকল্পগুলোতেও এই প্রামাণ্যচিত্র দেখানোর চেষ্টা করব।’
পুরস্কারের ইতিহাস
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উদ্যোগে ২০০৪ সালে প্রবর্তিত ‘ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার’ প্রতিবছর চলচ্চিত্র নির্মাণ ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্মাননা জানিয়ে আসছে ‘ফজলুল হক স্মৃতি কমিটি’।
চলচ্চিত্র সাংবাদিক আলিমুজ্জামান ও নির্মাতা রায়হান রাফি এবার এই সম্মান অর্জন করেছেন। নিজের মাকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে পুরস্কার গ্রহণ করে রায়হান রাফি সেই মুহূর্তটিকে আরও আবেগময় করে তোলেন। ফজলুল হকের কর্মময় জীবন, দৃষ্টিভঙ্গি ও অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।