‘রংবাজ’ ও ‘উৎসব’–এর দৃশ্য। কোলাজ
‘রংবাজ’ ও ‘উৎসব’–এর দৃশ্য। কোলাজ

৫২ বছর আগের ‘রংবাজ’-এর মতো চমকে দিল ‘উৎসব’

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোতে স্থান পেয়েছে যুদ্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আর জীবনের গল্প। ১৯৭২ সালে ‘ওরা ১১ জন’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’র মতো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমাগুলো মুক্তি পায়। একই বছরে মুক্তি পাওয়া ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘লালন ফকির’, ‘এরাও মানুষ’-এর মতো জীবনীনির্ভর ও প্রান্তিক মানুষের কাহিনিও নির্মাতারা ফুটিয়ে তুলেছেন চলচ্চিত্রে।
এমন সময়ে ১৯৭৩ সালের কোরবানির ঈদে মুক্তি পায় পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের এক ছবি—জহিরুল হকের ‘রংবাজ’। রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের ট্র্যাজেডির বাইরে গিয়ে একদম নতুন রূপে হাজির হলো ‘রংবাজ’। দেশের প্রথম অ্যাকশন সিনেমা। স্টাইলিশ লুক, দুর্দান্ত গান, সাহসী নাচ, অ্যাকশন আর রাজ্জাক-কবরীর পর্দার রসায়ন; মুক্তির পরই চমকে দেয় ‘রংবাজ’।

‘রংবাজ’ সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি

৫২ বছর পর ২০২৫ সালের কোরবানির ঈদেও দর্শকদের চমকে দেয় আরেকটি সিনেমা—তানিম নূরের ‘উৎসব’। আগের কয়েক বছরের ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর তালিকা যদি দেখেন, তাহলে এই সিনেমা কতটা চমকজাগানিয়া, বুঝতে পারবেন। গত কয়েক বছরে ‘সুড়ঙ্গ’, ‘তুফান’, ‘বরবাদ’, ‘ইনাসাফ’ বা ‘তান্ডব’-এর মতো সিনেমা এসেছে। যেগুলো মূলত ক্রাইম, থ্রিলার আর অ্যাকশন-নির্ভর সিনেমা। সেখান থেকে উৎসব একেবারে উল্টো পথে যাত্রা, রীতিমতো ফ্যামিলি ড্রামা; যে সিনেমার ট্যাগলাইনই হলো, ‘পরিবার ছাড়া দেখা নিষেধ’।

‘উৎসব’ সিনেমার পোস্টার। চরকির সৌজন্যে

৫২ বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘রংবাজ’ ছিল ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী এক সিনেমা; এই সিনেমার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি হয় ‘দোস্ত দুশমন’, ‘মিন্টু আমার নাম’সহ আরও অনেক অ্যাকশন সিনেমা। এবার উৎসব পারিবারিক ধারার সিনেমাকে কতটা ফেরাতে পারবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।

‘রংবাজ’-এর রং
বস্তির তরুণ রাজা (রাজ্জাক) পকেটমার ও মাস্তান। এই ‘রাজা মাস্তান’কেই পছন্দ করে একই বস্তির মেয়ে চিনি (কবরী)। একদিন এক মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীর (আনোয়ার হোসেন) পকেট মারে রাজা। মানুষটা সেদিনই বেতন পেয়ে বাড়ি ফিরছিল। এই ঘটনাই জন্ম দিতে থাকে একের পর এক মর্মস্পর্শী ঘটনা।

‘রংবাজ’ সিনেমার দৃশ্য। প্রযোজনা সংস্থার সৌজন্যে

‘রংবাজ’ সিনেমার উপস্থাপন ছিল সে সময়ের তুলনায় একেবারে ব্যতিক্রম। এ সিনেমাতে হিরো অ্যান্টিহিরো হয়ে দেখা দেয়। ছবিতে রাজ্জাকের চলাফেরা, সংলাপ, পোশাক, মারপিট—সবকিছুই রংবাজের মতো। এ সিনেমাতেই প্রথম নায়ককে সাদা-কালোয় না দেখিয়ে ধূসর এক চরিত্রে দেখানো হলো। ১৯৭৩ সালের ১১ মে ভারতে মুক্তি পেয়েছিল সত্তর দশকের অন্যতম হিট ছবি ‘জঞ্জির’। এই ছবির সুবাদেই রাতারাতি তারকা বনে যান অমিতাভ বচ্চন। হিন্দি ছবির দুনিয়ায় শুরু হয় ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ নায়কের সূচনা। যে নায়ক অকারণে হাসে না, তথাকথিত রোমান্সে বিশ্বাসী নয়, নীতিনৈতিকতার বিচারেও সে যথেষ্ট স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী নয়। ‘রংবাজ’-এর নায়কও ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’, তবে এটি কিন্তু মুক্তি পায় ‘জঞ্জির’-এরও চার মাস আগে, ১৯৭৩ সালের ১৬ জানুয়ারি!

‘রংবাজ’কে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের প্রথম অ্যাকশন সিনেমা। এই ছবির মারপিটের দৃশ্য পরিচালনা করেই প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন জসীম। গানের দিক থেকেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সিনেমাটি। সিনেমার ‘হই হই হই রঙিলা রঙিলা রে’ ও ‘সে যে কেন এল না, কিছু ভালো লাগে না’ গান দুটি এখনো শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। প্রথাভাঙা এ সিনেমা যে দর্শক লুফে নিয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য। মাত্র ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত সিনেমাটি ৩ কোটি টাকা ব্যবসা করেছিল বলে শোনা যায়।  

‘উৎসব’ সিনেমার পোস্টার

‘উৎসব’-এর জাদু
২০২৪ সালের ঈদুল আজহায় তুমুল জনপ্রিয়তা পায় তুফান। চলতি বছরের দুই ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘বরবাদ’, ‘জংলি’, ‘দাগি’, ‘চক্কর ৩০২’, ‘তান্ডব’, ‘ইনসাফ’, ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’, ‘নীলচক্র’—সব সিনেমাই কম বেশি অপরাধকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে। তবে সহিংসতা আর অপরাধের দুনিয়ার বাইরে দর্শকদের নিয়ে আসে উৎসব। ছবিটি যেন পাশের বাড়ির গল্প। সিনেমাটি তুলে ধরে একটুকরা নব্বইয়ের গল্প, সিনেমাটি দেখতে গিয়ে দর্শক অনুভব করেন নিজেকে, প্রিয়জনদের সঙ্গে সম্পর্ককে আর একটি পারিবারিক আবহের গল্পকে।

খাইষ্টা  জাহাঙ্গীরের জীবনের ভুল, আক্ষেপ আর আফসোসের মধ্য দিয়ে দর্শক হাসেন, কাঁদেন। যেখানে তিন ভূতের অসিলায় জাহাঙ্গীর ফিরে যায় নিজের অতীতে; ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়ে যায় সে। জাহিদ হাসান, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান, সৌম্য জ্যোতি, সাদিয়া আয়মান অভিনীত সিনেমাটি প্রমাণ করে, দক্ষিণি প্রভাব ছাড়া দেশি গল্পে নির্মিত সিনেমাও হলে দর্শক টানতে পারে।

১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘রংবাজ’ আর ২০২৫–এর ‘উৎসব’—দুটিকেই বলা যায় দুই সময়ের প্রথাভাঙা সিনেমা। ‘রংবাজ’ মুক্তির পর অনেক চলচ্চিত্র বিশ্লেষক যদিও এটিকে ‘সর্বনাশের ধারার সূচনা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। উৎসবকেও অনেকে ‘নাটক’ বলে সমালোচনা করেছেন। ৫২ বছর পর ‘রংবাজ’ নিয়ে এখনো কথা হয়; ‘সর্বনাশের ধারার সূচনা’র ভবিষ্যদ্বাণী যে ঠিক হয়নি, বলাই বাহুল্য। কে জানে ‘নাটক’ বদনাম পেরিয়ে উৎসবও হয়তো অনুপ্রাণিত করবে ভবিষ্যতের আরও বাংলা সিনেমাকে।