শ্রাবণ শাহ। শিল্পীর সৌজন্যে
শ্রাবণ শাহ। শিল্পীর সৌজন্যে

বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় ফার্নিচারের দোকানে কাজ করতেন, কে এই নায়ক

মানুষ স্বপ্ন দেখে এক, হয় আরেক। আবার কখনো কখনো স্বপ্ন বাস্তবে ধরাও দেয়, ঢাকাই ছবির নায়ক শ্রাবণ শাহের ছোটবেলার স্বপ্ন বড় হয়ে যেভাবে ধরা দিয়েছিল।
একদিন সিনেমার রঙিন দুনিয়ায় নায়ক হিসেবে নিজেকে দেখবেন, এমন স্বপ্ন নিয়ে মায়ের টাকা চুরি করে কুমিল্লার এক গ্রাম থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসেন শ্রাবণ। এসে ফার্নিচারের দোকানে কাজ শুরু করেন। সেই কাজ করতে করতেই একসময় স্বপ্নের নায়িকা মুনমুন, ময়ূরীর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়। একদিন স্বপ্ন হাতের মুঠোয় ধরা দেয় তাঁর। একসময় চিত্রনায়িকা সাহারা, সাথী, ঝুমকা, পরীমনিদের নায়ক হিসেবে পর্দায় ভেসে উঠলেন সেই ‘পলাতক’ ছেলেটি।

প্রথম যেদিন নায়ক হিসেবে কাজের সুযোগ পান, নিজের কাছে বিশ্বাস হয়নি শ্রাবণের। তিনি বলেন, ‘যেদিন প্রথম নায়ক হিসেবে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বারবার আমার স্কুলজীবনের বন্ধুদের কথা মনে পড়ছিল, যারা আমার স্বপ্নের কথা শুনে হাসত। প্রিয় নায়ক-নায়িকাদের ছবি দেখতে সিনেমা হলে ঘুরতাম, সেসব কথা। প্রথম দিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। নায়ক হওয়ার স্বপ্নটা, স্বপ্নই মনে হচ্ছিল।’

কিন্তু সেই নায়ক হওয়ার পথটা কি সহজ ছিল শ্রাবণের জন্য? না, অতটা সহজ ছিল না। স্কুলে ছাত্র ভালো ছিলেন না শ্রাবণ। পড়ালেখা বাদ দিয়ে বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা। তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। সে সময় সিনেমায় মুনমুন, ময়ূরীদের জয়জয়কার। ওই সময়ই সিনেমা দেখার পোকা মাথায় ঢোকে তাঁর। বাড়ির লোকজন, স্কুল ফাঁকি দিয়ে হলে হলে সিনেমা দেখা চলতে থাকে। সিনেমা দেখে মুনমুন, ময়ূরীদের নাচও আয়ত্ত করতে থাকেন তিনি। বন্ধুদের সামনে নায়িকাদের মতো করে নেচে কত যে হাসির পাত্র হয়েছেন, তার কোনো হিসাব নেই। এভাবে সিনেমা দেখার নেশা থেকেই নায়ক হওয়ার সাধ জাগে তাঁর।

গানের শুটিংয়ে শ্রাবণ ও পরীমনি। শিল্পীর সৌজন্যে

শ্রাবণের মুখের কথা, ‘আমি নাচ করতাম, বন্ধুরা হাসত, আমি রাগ করতাম না। মজার ছলেই তা নিতাম। কিন্তু আমার মাথায় একটাই চিন্তা তখন—সিনেমা, সিনেমা, সিনেমা।’
২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষা শেষ। কোনো এক ভোরে মায়ের টাকা চুরি করে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন শ্রাবণ। চাচার বাসায় থাকেন। প্রতিদিন সকালে উঠেই এফডিসির ফটকে হাজির হতেন। সারা দিন ফটকের সামনে ঘোরাঘুরি। বলেন, ‘ঘোরাফেরা করতাম আর এফডিসির কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টার করতাম। মাথায় চিন্তা, যেকোনোভাবেই হোক, এফডিসির মধ্যে ঢুকতে হবে। নায়ক–নায়িকাদের কাছাকাছি পৌঁছাতেই হবে আমাকে।’

একদিন ঠিকই এফডিসিতে ঢোকার পথ খুলে গেল তাঁর। এফডিসির গেটে মিজান নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। মিজানের একটি ফার্নিচারের দোকান ছিল। তিনি বিভিন্ন সিনেমার শুটিংয়ের ফার্নিচার সরবরাহ করতেন। তাই এফডিসিতে তাঁর অবাধ যাওয়া–আসা। পরিচয় থেকে শ্রাবণকে তাঁর ফার্নিচারের দোকানে কাজের প্রস্তাব দেন মিজান। শ্রাবণ রাজি হয়ে যান। কারণ, তাঁর লক্ষ্য এফডিসিতে ঢোকা।
শ্রাবণ বলেন, ‘ফার্নিচারের দোকানে কাজ শুরু করলাম। ভ্যানে করে ফার্নিচার নিয়ে এফডিসির বিভিন্ন ফ্লোরে ফ্লোরে শুটিংয়ে যাওয়ার সুযোগ হলো। শুটিংয়ে ফার্নিচার দিতে গিয়ে একদিন এক নায়কের সঙ্গে পরিচয় হয় (নাম বলব না)। একসময় তাঁর সহকারী হিসেবে আমাকে রাখলেন। তখন ওই নায়ক মুনমুন, ময়ূরীর সঙ্গে দেশের নানা জায়গায় প্রচুর স্টেজ শো করতেন।’

শ্রাবণ শাহ। শিল্পীর সৌজন্যে

শ্রাবণ বলেন, ‘নায়কের সহকারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মুনমুন, ময়ূরীর সঙ্গে দেখা হয়, পরিচয় হয়। তখন আমি অনেকটাই স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। যে নায়িকাকে দেখার জন্য স্কুল পালিয়ে সিনেমা হলে ঢুকতাম, তাঁরা বাস্তবে আমার সামনে, দেখা হচ্ছে, কথা হয়, হচ্ছে। আবার একসঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শোতে যাচ্ছি, সে এক অন্য রকমের উন্মাদনা কাজ করত নিজের মধ্যে।’

তত দিনে অনেকটাই স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন শ্রাবণ। ২০১৩ সালের কথা। পরিচালক রাজু চৌধুরী ‘তোকে ভালোবাসতেই হবে’ ছবিতে কাজের প্রস্তাব দিলেন। নায়িকা সাহারা। ছবিতে দুই নায়ক, আরেক নায়ক জায়েদ খান। স্বপ্ন যেন বাস্তবে রূপ নিল।

ডিপজল ও শ্রাবণ। শিল্পীর সৌজন্যে

শ্রাবণের ভাষ্য, ‘প্রথম ছবির শুটিং তখনো শেষ হয়নি। এফডিসির সামনের রেলগেটে প্রযোজক আলিম সাহেবের সঙ্গে দেখা। ওখানেই দাঁড়িয়েই তাঁর “দাবাং” ছবিতে চূড়ান্ত করলেন। পারিশ্রমিকের একাংশও অগ্রিম দিলেন। নায়িকা ঝুমকা। এটি ছিল ঝুমকার শেষ ছবি।’

এরপর একের পর এক কাজ আসতে থাকে এই অভিনেতার হাতে। নায়িকা সাথীর বিপরীতে রাজু চৌধুরীর ‘ইঞ্চি ইঞ্চি প্রেম’ সিনেমা করেন। এরপর একে একে করেন পল্লী মালেকের ‘পরশ প্রেমের ছোঁয়া’, এফ জাহাঙ্গীরের ‘অশান্ত মেয়ে’, রিকি মাসুদের ‘স্টোরি অব সামারা’। পরীমনির বিপরীতে শাহ আলম মণ্ডলের ‘আপন ঘর’ ছবিতে বাপ্পীও ছিলেন। কাজী হায়াতের অনুদানের ছবি ‘জয় বাংলা’সহ অনেকগুলো ছবিতে অভিনয় করেন শ্রাবণ শাহ।

শ্রাবণ শাহ জানান, শবনম পারভিনের ‘হুরমতি’ ও মনতাজুর রহমান আকবরের ‘বাংলার হারকিউলিস’ ছবি দুটি মুক্তির অপেক্ষায় আছে।
তাঁর নায়ক হওয়ার জীবনসংগ্রামের অতীত স্মরণ করে এই অভিনেতা বলেন, ‘এখন মনে পড়ে, যখন বিভিন্ন ফার্নিচার নিয়ে শুটিং স্পটে যেতাম। সেটে ফার্নিচার নামিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নায়ক-নায়িকাদের দেখতাম। দাঁড়িয়ে থাকার কারণে নায়ক আমিন খান, আলেক জান্ডার বোসহ কত দিন কতজনের কাছে বকা খেয়েছি, তার হিসাব নেই।’

পরীর সঙ্গে শ্রাবণ। শিল্পীর সৌজন্যে

দুটি ছবি মুক্তির অপেক্ষায় থাকলেও নতুন কোনো ছবি হাতে নেই এই নায়কের। তবে সারা বছরই স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত। অন্য যেসব নায়ক স্টেজ শো করেন, তাঁদের থেকে এগিয়ে আছেন তিনি। বর্তমান সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্টেজ শোর জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি এখন শ্রাবণ শাহ ও নাসরিন।
এই অভিনেতা বলেন, ‘সিনেমায় তো আগের মতো কাজ নেই। রোজার মাস ছাড়া সারা বছরই স্টেজ শো করি। বিশেষ করে শীতের সময় বেশি শো থাকে। দর্শক তো আমাকে ও নাসরিনকে স্টেজ শোতে “কিং-কুইন” ডাকেন।’