বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে গল্প ও নির্মাণভাষায় নতুন সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠেছেন মেজবাউর রহমান সুমন। তিন বছর আগে মুক্তি পাওয়া তাঁর প্রথম সিনেমা ‘হাওয়া’ শুধু বক্স অফিসেই নয়, শিল্পমান ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকেও দেশের সিনেমাকে নতুন আলোচনায় এনেছিল। সেই ‘হাওয়া’–পরবর্তী দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এবার আসছে তাঁর দ্বিতীয় সিনেমা ‘রইদ’। মঙ্গলবার সিনেমাটির পোস্টার প্রকাশের পর ট্রেলার উন্মুক্ত হতেই দর্শক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র অঙ্গনের শিল্পী–কলাকুশলীদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয়েছে ।
২ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ট্রেলারে আবহ, দৃশ্যকল্প আর চরিত্রের উপস্থিতিতে যেন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় এক ভিন্ন জগৎ। ট্রেলার প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, ‘হাওয়া’র পর সুমন আরও পরিণত, আরও ‘গভীর’ গল্প নিয়ে ফিরছেন ‘রইদ’-এ ।
শৈশবের গল্প থেকেই ‘রইদ’
‘রইদ’ নিয়ে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সিনেমার ভাবনা ও নির্মাণপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত কথা বলেন পরিচালক সুমন। তিনি জানান, এই সিনেমার গল্পের সূত্র তাঁর শৈশবে। ছোটবেলায় তাঁর পরিচিত দুটি চরিত্রকে ঘিরেই ‘রইদ’-এর জন্ম। গল্পের অর্ধেক অংশীদার তাঁর মা—শৈশব থেকেই এই গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছেন তিনি। সেই স্মৃতি, অনুভূতি আর লোকজ আখ্যানের মিশেলেই তৈরি হয়েছে ‘রইদ’ ।
সুমন বলেন, ‘হাওয়া’ ছিল সমুদ্রযাত্রার সিনেমা—জল আর অনিশ্চয়তার গল্প। সেখানে স্থলভাগে দাঁড়িয়ে ‘রইদ’ নির্মাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ও চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা । ‘রইদ’-এর গল্প আবর্তিত হয়েছে সাদু, তার পাগল স্ত্রী এবং তাদের বাড়ির পাশের একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে। হাজার বছরের পুরোনো লোকজ আখ্যানকে বর্তমান সময়ের ভাষায় নতুন করে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
সিনেমার জন্য গড়া হয়েছে গ্রাম
‘রইদ’-এর নির্মাণে সবচেয়ে চমকপ্রদ দিকগুলোর একটি হলো সেট নির্মাণ। সিনেমার প্রয়োজনে ফাঁকা জায়গায় প্রায় ৫০ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। অন্তত ছয় মাস ধরে সেই গাছগুলোর যত্ন নেওয়া হয়েছে, যাতে লোকেশনটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, গল্পের কেন্দ্রীয় যে বাড়ি, সেটিও শুটিংয়ের জন্য নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাতার ভাষায়, ‘লোকেশনকে কেবল ব্যবহার নয়, গল্পের অংশ করে তুলতেই এত পরিশ্রম।’
‘হাওয়া’ থেকে ‘রইদ’: নাজিফা তুষির রূপান্তর
‘রইদ’-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র ‘সাদুর পাগল স্ত্রী’। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘হাওয়া’ খ্যাত অভিনেত্রী নাজিফা তুষি। ট্রেলারে তাঁর উপস্থিতি ইতিমধ্যেই দর্শকের কৌতূহল বাড়িয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চরিত্রটি নিয়ে নিজের প্রস্তুতির কথা তুলে ধরেছেন তুষি। তিনি বলেন, ‘হাওয়া’ আর ‘রইদ’—দুটি সিনেমার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। এই চরিত্রের জন্য টানা ছয় মাস চুলে শ্যাম্পু, সাবান বা কোনো মেকআপ ব্যবহার করেননি তিনি। শুধু পানি দিয়ে গোসল করেছেন। চরিত্রের বাস্তবতা আনতে রোদে দাঁড়িয়ে শরীরে শর্ষের তেল মেখেছেন, যাতে ত্বক পুড়ে দাগ ও মেছতা ফুটে ওঠে।
চরিত্রের প্রয়োজনে দাঁতের রং ও গঠনেও পরিবর্তন এনেছেন তুষি। স্থানীয় মানুষের মতো হতে পাথরের চুন খেয়েছেন, যার ফলে মুখ ও জিব পুড়ে যেত, কথা বলাও ভারী হয়ে আসত। তুষির ভাষায়, ‘হাওয়া’র চেয়েও ‘রইদ’ আমার জন্য সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং কাজ ।’
নামহীন এক চরিত্রের জীবন
সিনেমায় তুষির চরিত্রটির কোনো নাম নেই। এই নামহীনতা চরিত্রটিকে আরও প্রতীকী করে তুলেছে বলে মনে করেন অভিনেত্রী। শুটিংয়ের সময় প্রয়োজনে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি, সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত কাপড় কিনে পরেছেন। বাস্তব জীবনের কাছাকাছি থাকতে নিজের আরামকে পুরোপুরি পাশে সরিয়ে রেখেছিলেন।
সহশিল্পী হিসেবে ‘রইদ’-এ তুষির সঙ্গে অভিনয় করেছেন অভিনেতা মোস্তাফিজুর নূর ইমরান। তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করে তুষি বলেন, সহশিল্পী হিসেবে ইমরানের উপস্থিতি চরিত্র নির্মাণে বড় সহায়ক হয়েছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
‘রইদ’-এর পোস্টার প্রকাশের দিনই জানানো হয় বড় সুখবর। বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব রটারড্যাম–এর ৫৫তম আসরের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগ ‘টাইগার কম্পিটিশন’-এ অফিশিয়ালি নির্বাচিত হয়েছে ‘রইদ’। এই বিভাগে নির্বাচিত হওয়া মানেই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি।
সব মিলিয়ে, ‘হাওয়া’র পর ‘রইদ’ নিয়ে প্রত্যাশা স্বাভাবিকভাবেই অনেক উঁচুতে। লোকজ গল্প, নির্মাণের নিষ্ঠা, অভিনেতাদের আত্মনিবেদন আর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি—সবকিছু মিলিয়ে ‘রইদ’ যে বাংলাদেশের সমসাময়িক সিনেমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে চলেছে, সে ইঙ্গিত স্পষ্টই মিলছে।