‘মুখ ও মুখোশ’–এর মুক্তির দিন আজ ৩ আগস্ট
‘মুখ ও মুখোশ’–এর মুক্তির দিন আজ ৩ আগস্ট

ঢাকায় সিনেমা বানানো ছিল ‘অসম্ভব’, তখনই তৈরি হয়েছিল সিনেমাটি

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোনো চলচ্চিত্র বানানো হতো না। অন্যদিকে ১৯১৬-১৭ সালের দিকে কলকাতাই হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাণকেন্দ্র। কলকাতা চলচ্চিত্র নির্মাণের কেন্দ্রস্থল হওয়ায় পূর্ববঙ্গের ফতেহ লোহানী, বনানী চৌধুরী, ইসমাইল মোহাম্মদ, কাজী খালেক, হিমাদ্রী চৌধুরী (ওবায়েদ উল হক) কলকাতায় চলচ্চিত্র নির্মাণে জড়িত ছিলেন। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জায়গা। তাই দেশ বিভাগের পরেও পূর্ব পাকিস্তানের সিনেমা হলগুলোতে কলকাতা ও লাহোরের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো। এখানে চলত ভারতীয় বাংলা, হিন্দি, পশ্চিম পাকিস্তান ও হলিউডের ছবি।
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে তখনো কোনো চলচ্চিত্রশিল্প গড়ে ওঠেনি। বাংলা ভাষায় তাই তখন পর্যন্ত কোনো চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়নি। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পরিচালকদের।

‘মুখ ও মুখোশ’ ছবিতে পিয়ারী বেগম
পূর্ব পাকিস্তানের অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে তখনো কোনো চলচ্চিত্রশিল্প গড়ে ওঠেনি। বাংলা ভাষায় তাই তখন পর্যন্ত কোনো চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়নি। কারণ, পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের পরিচালকদের।

১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে একটি সভা হয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিচালক ডক্টর আবদুস সাদেক সেই সভা আহ্বান করেন। ড. সাদেক ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ৯২টি প্রেক্ষাগৃহে বিদেশি ছবির বদলে স্থানীয় ছবি চলার কথা বলেন। ড. সাদের এ বক্তব্যের পর অবাঙালি ফজলে দোসানী বলেন, এখানকার আবহাওয়া খারাপ, আর্দ্রতা বেশি। এখানে ছবি তৈরি সম্ভব নয়। এ কথার তীব্র প্রতিবাদ জানান আবদুল জব্বার খান। তিনি বলেন, এখানে তো ভারতীয় ছবির শুটিং হয়েছে। তবে কেন পূর্ণাঙ্গ একটি ছবি করা যাবে না? এরপর তিনি দোসানীকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেই চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে স্টুডিও, ল্যাব কিছুই ছিল না। সেই সময়ের খ্যাতিমান শিল্পী-কুশীলবেরাও ছিলেন ভারতীয় বা পশ্চিম পাকিস্তানের। এমন প্রতিকূল পরিবেশে সেই সময়ে আবদুল জব্বার খান ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬) নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
‘মুখ ও মুখোশ’–এর মুক্তির দিন আজ ৩ আগস্ট। ছবি : সংগৃহীত

সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে স্টুডিও, ল্যাব কিছুই ছিল না। সেই সময়ের খ্যাতিমান শিল্পী-কুশীলবেরাও ছিলেন ভারতীয় বা পশ্চিম পাকিস্তানের। এমন প্রতিকূল পরিবেশে সেই সময়ে আবদুল জব্বার খান ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬) নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন।

তবে আবদুল জব্বার খান চলচ্চিত্র নির্মাণের কিছুই জানতেন না। তিনি ছিলেন একজন তরুণ নাট্যকর্মী। আবদুল জব্বার রচিত নাটক (পরবর্তী সময়ে উপন্যাস) ‘ডাকাত’ অবলম্বনে এ সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা হয়।  মঞ্চ ও বেতারশিল্পী এবং নতুন কলা–কুশীলবদের নিয়ে তিনি এই চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। এ সিনেমা বানানোর জন্য কলকাতা থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আনান পুরোনো মরচে ধরা এক ‘আইমো’ ক্যামেরা। শব্দ ধারণের জন্য ছিল একটি সাধারণ ফিলিপস টেপ রেকর্ডার।
১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এর শুটিং শুরু হয়। শুটিং হয় ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে। ১৯৫৫ সালের ৩০ অক্টোবর শেষ হয় সব দৃশ্য ধারণ। চলচ্চিত্রটিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদেরও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না। অনেকটা মনের সাহস আর নতুন কিছু করার প্রত্যয় নিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে অভিনয় করেন তাঁরা।

এতে জব্বার খান মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। আর তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জহরত আরা, বোন রাশিদার চরিত্রে অভিনয় করেন পেয়ারী বেগম, তাঁর ছেলেবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন তাঁরই ছেলে মাস্টার জুলু। এই ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন সমর দাস। গান করেন মাহবুবা হাসনাত ও আবদুল আলীম। নৃত্য পরিচালনা করেন গওহর জামিল।

আবদুল জব্বার খান চলচ্চিত্র নির্মাণের কিছুই জানতেন না। তিনি ছিলেন একজন তরুণ নাট্যকর্মী। আবদুল জব্বার রচিত নাটক (পরবর্তী সময়ে উপন্যাস) ‘ডাকাত’ অবলম্বনে এ সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা হয়।
আবদুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমার পোস্টার। সংগৃহীত

স্থানীয়ভাবে কোনো ফিল্ম প্রোডাকশন স্টুডিও না থাকায় ছবির নেগেটিভ ডেভেলপের জন্য লাহোরে পাঠানো হয়। লাহোরের শাহনূর স্টুডিওতে ফিল্ম ডেভেলপমেন্টের কাজ শেষ হয়। ১৯৫৬ সালে এ ছবি বানানো শেষ হয়। কিন্তু তিনি ছবিটি নিয়ে প্রথমে ঢাকায় ফেরার অনুমতি পাননি। ফলে এ সিনেমার প্রথম প্রদর্শনী হয় লাহোরে।

প্রিমিয়ার শো রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয়, উদ্বোধন করেন তৎকালীন গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এরপর সিনেমাটি একযোগে মুক্তি পায় ঢাকার রূপমহল, চট্টগ্রামের নিরালা, নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড এবং খুলনার উল্লাসিনী সিনেমা হলে।

১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট তৎকালীন হোটেল শাহবাগে ছবিটির মহরত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা চলচ্চিত্রটির মহরত উদ্বোধন করেন।
ঢাকায় ফিরে আসার পর ছবিটি প্রদর্শনীর বিষয়ে কোনো প্রেক্ষাগৃহের মালিকের কাছ থেকে প্রথমে কোনো সাড়া পাননি আবদুল জব্বার। তবে এ অবস্থা অচিরেই কেটে যায়। তখন ‘পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্ট’ ও ‘পাকিস্তান ফিল্ম সার্ভিস’ ছবিটি পরিবেশনার দায়িত্ব নেয়। প্রিমিয়ার শো রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয়, উদ্বোধন করেন তৎকালীন গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এরপর সিনেমাটি একযোগে মুক্তি পায় ঢাকার রূপমহল, চট্টগ্রামের নিরালা, নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড এবং খুলনার উল্লাসিনী সিনেমা হলে। শুরু থেকেই দেশের দর্শকমহলে থাকে সিনেমাটি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ ছিল। প্রথম দফায় মুক্তির পর চলচ্চিত্রটি তৎকালীন ৪৮ হাজার রুপি আয় করে।

‘মুখ ও মুখোশ’ হচ্ছে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের প্রথম সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র। আজ সেই ৩ আগস্ট। ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তির ৬৯ বছর পূর্ণ হলো।

তথ্যসূত্র: অনুপম হায়াতের ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিকথা’