বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে আমরা
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে আমরা

সেদিন যেভাবে আমরা সবাই ‘ক্লান্তিযাপন’ করলাম

জাপানি একটি কবিতায় পড়েছিলাম, ‘বল দেখি কোথা যাই/ কোথা গেলে শান্তি পাই?’ বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই পঙ্‌ক্তি দুটি মনে পড়ে। কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক একটি লেখায় লিখেছেন, ‘এই পৃথিবীতে একটা স্থান ছিল সবচেয়ে করুণ সুন্দর, তা হলো বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আগের ভবনটি। গাছগাছালিতে ঢাকা। ছায়াময়। মায়াময়। গাছের তলা দিয়ে ইটবিছানো বাঁকা পথ বেয়ে এগোলে লাল ইটের একটা দোতলা ভবন। তার আঙিনায় কত পুষ্পবিহঙ্গবৃক্ষ পুরাণ রচিত হয়েছে। দোতলায় লাইব্রেরি। নিচতলায় হলঘর। ডান দিকে ভিডিও লাইব্রেরি ইত্যাদি।’ কেন্দ্রের সামনে গেলে আমারও একই অনুভূতি হয়। হৃদয় শীতল হয়ে আসে, শান্তি বোধ হয়। জানি না, ভবনের সামনের নানা ফুলের গাছ, অকৃত্রিম নান্দনিকতা না বর্তমানে ফুটে থাকা অশোক ফুলের সৌন্দর্যের কারণে এমনটা ঘটে; না বই ভালোবাসি বলে; না আছে অন্য কোনো কারণ, যা ঠাওর করে উঠতে পারি না!
প্রথম যেদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গিয়েছিলাম, একটিমাত্র বাসনা ছিল মনে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে সামনাসামনি দেখব। সুযোগ হলে দুটো কথা শুনব। সেদিন সুযোগ না মিললেও আলোর ইশকুলের বই পড়া (পাঠচক্র) কর্মসূচিতে নির্বাচিত হওয়ায় সামনাসামনি স্যারের কথা শোনার এবং স্যারের সামনে বলার সুযোগ পেয়েছি। কীভাবে? সে গল্প অন্যদিনের জন্য থাক। বরং বলার টুকু আজ বলি।

বাংলা নতুন বছরকে (১৪৩২) বরণ করে নেওয়ার জন্য বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘বর্ষবরণ’ অনুষ্ঠান হবে। আলোর ইশকুলসহ কেন্দ্রের নানা কর্মসূচির শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে থাকবে সাংস্কৃতিক পর্ব। সুমন ভাই মানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যুগ্ম পরিচালক (প্রোগ্রাম) মেসবাহ সুমন বললেন, ‘পাঠচক্র থেকেও অংশগ্রহণ করতে হবে। আপনাদের জন্য দশ মিনিট সময় বরাদ্দ হয়েছে।’ কী করব আমরা, কী করা যায় প্রশ্ন উঠল? অনেকেই নিরুত্তর, দু–একজন বললেন দলীয় সংগীত করা যেতে পারে। আমি কোনো চিন্তাভাবনা না করেই বললাম, বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কয়েকটি চরিত্র নিয়ে একটা নাটক করা যেতে পারে। ‘স্ক্রিপ্ট কি রেডি আছে, স্ক্রিপ্ট কে করবে?’ জিজ্ঞেস করলেন সুমন ভাই। কখনো স্ক্রিপ্ট লিখিনি আমি। লেখালেখির অভিজ্ঞতা দিয়ে কি পারব? আত্মবিশ্বাসে হৃদয় ভরে উঠল। স্ক্রিপ্ট লেখার দায়িত্ব নিলাম। শুরুতে আগ্রহী কয়েকজন সভ্য মিলে অনলাইনে বৈঠক হলো। আইডিয়া খোলাসা করে বললাম। ‘লিখে ফেললে ভালো হয়। বুঝতে সুবিধা হবে।’ বললেন অনেকে। ল্যাপটপের সামনে বসে এক বসায় লিখে ফেললাম ‘ক্লান্তিযাপন’।

‘ক্লান্তিযাপন’ এর দৃশ্য

সুমন ভাই দেখে বললেন, ‘ভালো কনসেপ্ট। করা যেতে পারে।’ পরপর কে কোন চরিত্র করতে আগ্রহী জানতে চাওয়া হলো। ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য চরিত্রে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

বাকি চরিত্রগুলোতে একজন করে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’র অমিত চরিত্রে মোতাসিম বিল্লাহ, লাবণ্য চরিত্রে বনোমিতা ঘোষ, কেতকী রায় চরিত্রে সুস্মিতা সরকার; বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কপালকুণ্ডলা’র  কপালকুণ্ডলা চরিত্রে অনামিকা মণ্ডল ও ফারিয়া আফরিন, নবকুমার চরিত্রে হোসেন আলী এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সপ্তপদী’ উপন্যাসের রিনা ব্রাউন চরিত্রে মোবাশ্বারা শশি ও কৃষ্ণস্বামী চরিত্রে শামসুর রহমান অভিনয় করবেন বলে ঠিক হলো। কিন্তু বিপত্তি তৈরি হলো পাঠক ও আগন্তুক চরিত্র দুটিতে আগ্রহী কাউকে না পাওয়ায়। মঞ্চে চরিত্র দুটিতে কে প্রাণ দেবেন—প্রশ্ন উঠলে সবাই আমার দিকে আঙুল তাক করলেন। অগত্যা দুটি চরিত্রে কস্টিউম পরিবর্তন করে অভিনয় করতে হবে বলে মনস্থির করতে হলো। তা ছাড়া গল্প বিবরণীতে আসিফ রহমান ও সুস্মিতা সরকার এবং মঞ্চসজ্জায় জাকের আয়াত কাজ করবেন বলে লিপিবদ্ধ হলো।

যাহোক টিম ‘ক্লান্তিযাপন’ প্রস্তুত। শুরু হলো মহড়া। তানিয়া আফরোজ আপুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন সুমন ভাই। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। পাঠচক্র থেকে সাংস্কৃতিক পর্বে অংশগ্রহণের জন্য তানিয়া আপুর সঙ্গে সার্বিক যোগাযোগ রক্ষার ভার আমার ওপর পড়ল। যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করা নিয়ে ভাবনা নেই। কিন্তু নাটক তো কখনো করিনি। মঞ্চনাটক যদিও দেখেছি বেশ কিছু। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নির্দেশনা দিয়ে নাটকটা কি তুলতে পারব? ইত্যাদি চিন্তা নিয়ে এগোল টিম ‘ক্লান্তিযাপন’।  
মহড়ায় সবার আত্মবিশ্বাস বাড়ল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন তানিয়া আপু ফোন করে জানালেন, ‘স্ক্রিপ্ট অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।’ যদি অনুমোদন না হয়, তাহলে কী হবে? সবাই অনেক আশা করে আছে। না, পথ থমকে যায়নি। তানিয়া আপুর মুখে শুনেছি, স্যারও চাচ্ছিলেন একটা নাটক বা একাঙ্কিকা থাক অনুষ্ঠানে।

‘স্ক্রিপ্ট অনুমোদন হয়েছে।’ তানিয়া আপুর মুখে শুনে সবাই ভীষণ খুশি, আনন্দিত। ‘হবে ভালো হবে, চিন্তা নেই।’ বলে সেদিন আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন কেন্দ্রের অনেকে।

আরেকটি মুহূর্ত

কিন্তু পরীক্ষা সে তো সহজে শেষ হয় না, নববর্ষের আগের দিনও সামনে এলো। তানিয়া আপু ফোনে জানালেন, সন্ধ্যায় পুরো প্রোগ্রাম একবার মহড়া হবে। সেখান থেকে বাছাই করে পরের দিনের অনুষ্ঠান করা হবে। আমরা প্রথমে পারফর্ম করলাম। সন্ধ্যার পরপর ফলাফল এল। হ্যাঁ, নাটক যাচ্ছে। সবাই যেমন খুশি, তেমন চিন্তিতও। চিন্তা দূর করার উপায় মহড়া। সবাই মিলে ঠিক করা হলো মঞ্চে ওঠার আগে আবারও মহড়া হবে। যে কথা সেই কাজ, নববর্ষের দিন অনুষ্ঠানের আগে রিহার্সাল করে মঞ্চে উঠল টিম ‘ক্লান্তিযাপন’। অমিত, লাবণ্য, কেতকী রায়ের কস্টিউম উপন্যাসের বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে। রিনা ব্রাউন একদম রিনা ব্রাউনের মতো করেই যেন উঠেছিলেন মঞ্চে। সম্পূর্ণ ‘ক্লান্তিযাপন’ মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন দর্শক। মিলনায়তনজুড়ে ছিল পিনপতন নীরবতা। নাটক শেষ করে বাইরে গেলে অনন্ত উজ্জ্বল ভাই থেকে শুরু করে পরিচিত–অপরিচিত অনেকেই প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘ভালো হয়েছে, বেশ ভালো হয়েছে। কনসেপ্টটা দারুণ!’ আর সেদিনের পর থেকে কেন্দ্রে গেলে অনেকে বনোমিতা, সুস্মিতা, শশি, এলিসাদের নাম ধরে না ডেকে চরিত্রের নাম লাবণ্য, কেতকী রায়…বলে ডাকছেন।
আমাদের প্রায় সবার জীবনের প্রথম মঞ্চ অভিনয়ের স্মৃতি নিয়ে থাকবে ‘ক্লান্তিযাপন’। সায়ীদ স্যারের স্পর্শে সোনার পাথরবাটির মতো মহামূল্যবান এই পয়লা বৈশাখ জীবনকে উজ্জীবিত করবে সব সময়। উল্লেখ্য, নববর্ষের  দিনব্যাপী বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই আয়োজনে কেন্দ্রের সভাপতি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারসহ দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। নাটক ছাড়াও  গান, আবৃত্তি, নৃত্য, দলীয় সংগীত, বাঁশির মূর্ছনায় আলোকিত হয়েছিল বর্ষবরণের আয়োজন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন পাঠচক্রের সদস্য রুকসানা মিলি ও সাকিব চৌধুরী।