শহীদ মিনারে দ্রোহযাত্রা, ফার্মগেটে দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজের সমাবেশ কিংবা ফেসবুক—জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সব জায়গাতেই সক্রিয় ছিলেন নির্মাতা আশফাক নিপুন। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে গতকাল তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মকফুল হোসেন
কোন তাড়না থেকে আন্দোলনে নেমেছিলেন?
আশফাক নিপুন: বহু বছর ধরেই আমার আন্দোলন চলছে, ১৫ বছর ধরেই চলছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করেছি। সাংবাদিক কাজল গুম, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল, কিশোর–মুশতাকের ওপর অত্যাচার থেকে খাদিজাকে গ্রেপ্তার—সব ক্ষেত্রেই আমি রাস্তায় সরব ছিলাম।
বিবেক থেকে আন্দোলনে নামার তাড়নাটা আসে, এটা আর কোনো কিছু না। এটার জন্য বড় কিছু হতে হয়, বড় কিছু করতে হয়, তা–ও না। গত ১৫ বছরে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা আমার কাছে দরকার মনে হয়েছে। তখন আমার মনে হচ্ছিল, যা হচ্ছিল, সেটা ঠিক হচ্ছে না। সেই কারণেই তখন কাজের মাধ্যমে, অ্যাকটিভিজমের মাধ্যমে প্রতিবাদ করা কিংবা রাস্তায় দাঁড়ানোর তাড়নাটা সব সময়ই ছিল। এমন না যে জুলাইয়ে হঠাৎ করে তাগিদ অনুভব করলাম। তাড়নাটা আগে থেকেই ছিল।
সরকারের চোখরাঙানিকে উপেক্ষার সাহস কোথায় পেয়েছিলেন?
আশফাক নিপুন: আন্দোলনের সময় এলিটা (করিম)–কে ফোন দিয়ে, প্রযোজকদের ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, আমাকে কীভাবে থামানো যায়? আমাকে (তুলে) নেওয়ার জন্য পরিকল্পনাও করছিল। আমার জন্য জুলাইটা অন্য ধরনের সেলিব্রেশন। কারণ, গত ১৫ বছর বিভিন্ন ইস্যুতে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। তখন আমি ছিলাম একা। মহানগর বানানোর পর গোয়েন্দারা এসে আমাকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বাসায় পুলিশ আসা, লুকিয়ে থাকা—এগুলো আমাকে এত দিন একা ফেস করতে হয়েছে। জুলাইয়ে আমার মনে হয়েছে, এখন আমি আর একা না। কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। এটা একটা কালেক্টিভ (সম্মিলিত) সাহস ছিল।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। বছরটা কেমন দেখলেন?
আশফাক নিপুন: বিশ্বের অনেক বড় বড় শিল্পী আছেন, যাঁরা একজীবনে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে এত বড় গণ–অভ্যুত্থানের অংশ হতে পারেননি। সেখানে বাংলাদেশের মতো একটা জায়গায় একজন ক্ষুদ্র শিল্পী হিসেবে এত বড় মুভমেন্টের (আন্দোলন) সঙ্গে থাকতে পারলাম, এটা আমার জন্য বিরাট পাওয়া।
আন্দোলনের কনসিকুয়েন্স (পরিণতি) ভালো–খারাপ যা–ই হোক, ওই সময় জুলাই অভ্যুত্থানটা সঠিক ছিল। নিজের সক্ষমতা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, এই অভিজ্ঞতা আমার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রত্যাশা আকাশচুম্বী, স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এই সরকার। স্বাধীনতা–পরবর্তী সরকার বাদ দিলে এতটা জনসমর্থন নিয়ে কোনো সরকার আসেনি।
গত এক বছরে বেশ কিছু জায়গায় সরকার কাজ করেছে। আওয়ামী লীগ আমলের বড় বড় বাজেটের প্রকল্পগুলোর খরচ কমিয়েছে সরকার। এত লোন (ঋণ) ছিল, সেগুলো পরিশোধ করছে। এটা এই সরকারের অনেক বড় সাফল্য। আমরা এত দিন প্রায় মেনেই নিয়েছি, বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতি হবেই। ঘুরেফিরে আমাদের পকেট থেকেই টাকা যাবে, আমাদের কিছু করার থাকবে না। এই সরকার সেই চর্চা থেকে বের হয়েছে। এত দিনে জানা গেল, মেগা বাজেটের ব্যয় কমানো সম্ভব।
সামনে নির্বাচিত সরকারকে প্রশ্ন করতে পারব, এত বড় বাজেট কেন হচ্ছে? তখন আমাদের অর্থনীতিবিদেরা এটা নিয়ে কথা তুলতে পারবেন। আগে চর্চাটা ছিল না। এবার হজ ব্যবস্থাপনাও দারুণ হয়েছে। বেঁচে যাওয়া টাকা হজযাত্রীদের ফেরতও দেওয়া হলো। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে, সেটাও বিশাল ব্যাপার। আমরা এত দিন ধরে জেনে এসেছি, ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। রোজা এলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াবে, এটা মেনেই নিয়েছিলাম। সেখান থেকে বের হওয়া যায়, সেটা সরকার দেখিয়েছে।
১৫ বছরের অপশাসনের ফলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ক্ষমতায় এসে সরকার এক বছরের মধ্যে দেশটাকে স্বর্গ বানিয়ে ফেলবে—আমি এটা বিশ্বাস করার মতো বোকাও না। রাতারাতি দেশটা ঠিক হয়ে যায় না, সেটা আমি মানি। তার মধ্যেও কিছু বিষয় আমাকে হতাশ করেছে। প্রথমত, সরকার গঠনের দু–তিন মাস পরও আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদেরা দেশ থেকে পালাতে পেরেছেন—এটা খুবই হতাশার। জুলাই আন্দোলনের স্পিরিটের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক। অনেক বড় বড় নেতা দেশের ভেতরে ছিলেন, এঁদেরকে কেন ধরা গেল না? এটা বড় ব্যর্থতা।
দ্বিতীয়ত, মবের আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। একটা সুন্দর রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। শেখ হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছিল; বিচার বিভাগ, পুলিশ থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা বাহিনীতেও দুর্নীতি ঢুকেছিল। মব দিয়ে নয়, প্রতিষ্ঠান দিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা। মব ও তৌহিদি জনতার নামে কিছু লোক মানুষকে হেনস্তা করছে। আপাতদৃষ্টে অনেকে এটাকে ঠিক বলে মনে করছেন। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর ফলাফল খুবই ভয়ংকর।
মাজারে হামলা থেকে শুরু করে যা যা হয়েছে, এটাকে ডিল করতে না পারাটা একটা বড় ব্যর্থতা। সরকার অনেক জায়গায় চেষ্টা করেছে, অনেক জায়গায় ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু অ্যাকশন নেওয়া হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এর প্রভাব পড়েনি। ছিনতাই, রাহাজানির ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকেছে, রাত করে বাড়ি ফেরা যাবে না। এই সব জায়গায় আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। এর মধ্যে অনেক ধরনের মামলা–বাণিজ্য দেখতে পাচ্ছি। এক মামলায় ২০০ থেকে ৩০০ আসামি করা হচ্ছে, যাঁদের সঙ্গে মামলার কোনো সম্পর্কই নেই। এই চর্চাটা গত সরকারের আমলে দেখেছিলাম। যে কাউকে মামলার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এই সরকারে এই চর্চাটা কেন করবে?
আগামীর বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখতে চান?
আশফাক নিপুন: বাংলাদেশকে সহনশীল ও মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। আমরা রক্তক্ষয়ী গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এসেছি। এখনো অনেকের মধ্যে রাগ–ক্ষোভ, ক্রোধ রয়ে গেছে; এটা পুরোপুরি বের হয়নি। তবু বলব, আমরা একটা মানবিক রাষ্ট্র চাই; সব ধর্ম ও মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানবিক রাষ্ট্র চাই। যেখানে যে কেউ নিজের মতামত প্রকাশ করতে ভয় পাবে না।
আমরা এখন যা ইচ্ছা তা–ই ফেসবুকে লিখতে পারি, এটা অবশ্যই আমাদের বড় অর্জন। আগে লিখতে পারতাম না। এখন ইউনূস সরকারকে ‘ইউসুফ সরকার’ও বলতে পারি, তাতে আমাদের কেউ ধরে নিয়ে যায় না। এটা অবশ্যই আমাদের একটা অর্জন। কিন্তু আমি এর চেয়েও বেশি কিছু চাই। হয়তো সরকারের কাছ থেকে কোনো প্রতিরোধ আসছে না, সেটা ঠিক আছে। তবে সরকার ছাড়া অন্য কোনো জায়গা থেকে প্রতিরোধ হলেও যেন আমার মতটা দিতে পারি, সেটা যেন নিশ্চিত করা যায়—ওই মানবিক রাষ্ট্রটা আমরা চাই।
এই রাষ্ট্র এক্সট্রিমিজমের (চরমপন্থা) দিকে চলে যাক, সেটা একেবারেই চাই না। সারা জীবনই ওটার বিরুদ্ধে আমার লড়াই ছিল, সামনেও জারি থাকবে। সুশাসনের বাংলাদেশ চাই। অপরাধীদের যেন বিচার নিশ্চিত হয়—এমন বাংলাদেশ চাই।
শিল্পীদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াটাকে কীভাবে দেখেন?
আশফাক নিপুন: শিল্পীদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াটা শিল্পীদের ওপরই ছেড়ে দিতে চাই। আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। শিল্পীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা আছে। তবে যেহেতু তিনি শিল্পী, সেহেতু তিনি যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই যুক্ত হতে চান না কেন, তাঁর দায়িত্ব রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের চেয়ে আরেকটু বেশি থাকবে। কারণ, শিল্পীদের মানুষ আদর্শ হিসেবে দেখে। কোনো শিল্পী কখনো কোনো কথা বললে মানুষ সেটা বিশ্বাস করে। শিল্পীকে মানুষের জন্য রাজনীতি করতে হবে। মানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে দলের আদর্শের বিরুদ্ধেও যদি যেতে হয়, সেটা যেন তিনি পারেন—এটা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, শিল্পীদের মানুষ অন্য উচ্চতায় রাখে। শিল্পী যখন এই ধরনের কদর্য রাজনীতির মধ্যে ঢুকে যান, তখন তাঁর সম্ভাবনাকেই সীমিত করে ফেলেন। তখন শিল্পী হিসেবে, মানুষ হিসেবে তাঁর বস্তুনিষ্ঠতা শূন্যে নেমে আসে। সেটা আমাদের অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রে দেখেছি। যাঁরা সবাই আমাদের ভাই–বন্ধু, অগ্রজ; তাঁরা যখন রাজনৈতিক দলের রাজনীতিটাকে প্রাধান্য দিতে গেলেন, ওনারাও দেবতার আসন থেকে মাটিতে নেমে গেলেন। শিল্পী হোক, খেলোয়াড় হোক—অবশ্যই সবার রাজনীতি করার স্বাধীনতা আছে, সেটা যেন মানুষের জন্য হয়।
শিল্পীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকা দরকার?
আশফাক নিপুন: শিল্পীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকাটা খুবই দরকার। আমরা কেউই রাজনীতির বাইরে না। শুধু শিল্পী না, সাধারণ মানুষও রাজনীতির বাইরে না। বাংলাদেশের মতো রাজনীতিতে এতটা আগ্রহ খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না, আমরা টংদোকানে বসে রাজনীতির আলাপ করি; বাসে বসে আলাপ করি। শিল্পীকে অবশ্যই রাজনৈতিক সচেতন হওয়া দরকার। শিল্পীর আর্ট মানুষের জন্য, আর্ট মানুষের জন্য তখনই হবে, যখন তিনি রাজনৈতিকভাবে সচেতন হবেন। তখন তাঁর আর্টে সেই সচেতনতাও ফুটে উঠবে। মানুষকে আরও বেশি কানেক্ট করবে।
এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমলে ‘মহানগর’ বানানোর পর আপনি গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল...
আশফাক নিপুন: মহানগর বানানোর পর শুধু গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলাম, তা না। তাদের মেহমানও হতে হয়েছে। আমার বাসায় পুলিশ রেইড দিয়েছে। শুধু আমার না, আমার অভিনেতাদের বাসায় বারবার পুলিশ গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অনেক ধরনের হেনস্তার মধ্যে যেতে হয়েছে। আমি পরিকল্পনা করেছি, আমি একটা সিনেমা অথবা সিরিজ বানাব। কোনো একজন শিল্পীকে যদি তাঁর শিল্পকর্মের জন্য হেনস্তার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাহলে কী হতে পারে—সেটা নিয়ে শিগগিরই সিনেমা অথবা সিরিজ বানাব।
ওসি হারুনের সঙ্গে ডিবি হারুনের মিল খুঁজেছিলেন অনেক দর্শক। বিষয়টি আসলে কী?
আশফাক নিপুন: আমি এর আগেও টেলিভিশনে অনেকগুলো কাজ করেছি। তবে দর্শক আমার কোনো একটা চরিত্রকে মনে রেখেছেন, সেটা আমার কোনো কাজের সঙ্গে হয়নি। এটা আমার জন্য একেবারেই নতুন। আমি বাকের ভাই চরিত্রটা দেখে বড় হয়েছি। চরিত্রের চরিত্র হয়ে ওঠাটা লেখক, নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীর ওপর নির্ভর করে না—এটা হয়ে যায়। ওসি হারুন চরিত্রটা একজন পুলিশ অফিসারকে দেখে লেখা হয়েছিল। সেটার সঙ্গে দর্শক ডিবি হারুনের মিল খুঁজে পান, এটা দেখে মজা লাগে। ডিবি হারুন ও ওসি হারুন মিলে একটা নিদর্শন হয়ে গেছে। বাস্তব ও কল্পনা মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। বিষয়টি পুরোপুরি আমার হাতে, মোশাররফ করিমের হাতে কিংবা পলাতক ডিবি হারুনের কাছেও ছিল না।