
দুই হাজার কোটি টাকার মালিক এই চলচ্চিত্র পরিচালকের শুরুটা ছিল সাদামাটাভাবে। চেষ্টা আর বড় স্বপ্নের পেছনের সেই গল্প হলিউড ছাড়িয়ে দেশের তরুণ নির্মাতাদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক। হলিউডের হাজারো মেধার ভিড়ে শূন্য থেকে স্বাধীন সৃষ্টির স্বাদ উপভোগ করতে নির্মাতা হিসেবে পথ চলা শুরু। মেধাকে কাজে লাগিয়ে শূন্য থেকে বিলিয়ন ডলার আয় করা সিনেমার নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান। তিনি কীভাবে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতাদের অনুপ্রেরণা হতে পারেন?
ক্রিস্টোফার নোলান নামটি শোনেননি, এমন সিনেমাপ্রেমী কমই রয়েছে। নাম না শুনলেও তাঁর সিনেমা দেখেননি, এমন সিনেমাপ্রেমী খুঁজে পাওয়া বিরল। তাঁর সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘মোমেন্টো’, ‘ব্যাটম্যান বিগিনস’, ‘দ্য প্রেস্টিজ’, ‘দ্য ড্রার্ক নাইট’, ‘ইনসেপশন’, ‘ইন্টারস্টেলার’, ‘ওপেনহাইমার’–এর মতো বিশ্বের আলোচিত সিনেমা।
তাঁর সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘মোমেন্টো’, ‘ব্যাটম্যান বিগিনস’, ‘দ্য প্রেস্টিজ’, ‘দ্য ড্রার্ক নাইট’, ‘ইনসেপশন’, ‘ইন্টারস্টেলার’, ‘ওপেনহাইমার।’
এই পরিচালকের পেছনে লগ্নিকারকের তালিকায় রয়েছে বিশ্বখ্যাত ওয়ার্নার ব্রস, প্যারামাউন্ট পিকচার্স, ডিজনিসহ বিখ্যাত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। কারণ, নোলানের সিনেমা মানেই বক্স অফিস রেকর্ডের খাতায় নাম লেখাবে, বিশ্বে আলোচনা সৃষ্টি করা। সেই নির্মাতার শুরুটা ছিল বড় একটি স্বপ্ন দিয়ে। সেটা ছিল একটি সিনেমা বানানো। নোলান নিজেই হলিউড রিপোর্টার্সে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাজি ধরার মতো আবেগ দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা যায় না। রেসের ঘোড়া হওয়া যায় না। ১০ কিংবা ১১ বছর বয়স থেকেই আমি কীভাবে সিনেমা বানাব, সেই পরিকল্পনা করতে থাকি। একসময় আমার এটাই মনে হয়েছিল সিনেমা বানাতেই হবে।’
বাজি ধরার মতো আবেগ দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা যায় না। রেসের ঘোড়া হওয়া যায় না। ১০ কিংবা ১১ বছর বয়স থেকেই আমি কীভাবে সিনেমা বানাব, সেই পরিকল্পনা করতে থাকি। একসময় আমার এটাই মনে হয়েছিল সিনেমা বানাতেই হবে।ক্রিস্টোফার নোলান
সময়ের সঙ্গে তাঁর সিনেমা নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে। তাঁর কাছে মনে হয়নি সিনেমা বানাতে হলে সিনেমা নিয়েই পড়তে হবে। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু কখনোই ভালো ছাত্র হয়ে উঠতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সময় থেকেই তিনি ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন। তখনই আমাদের দেশের তরুণদের মতোই সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা আরও জোরালো হয়।
ফিল্ম সোসাইটি থেকে কিছু কাজও করেন। নিউইয়র্ক টাইমসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নোলান বলেছিলেন, ‘একসময় আমি ভাবতে থাকি শত শত বছর ধরে লেখকেরা সাহিত্য রচনায় যে স্বাধীনতা উপভোগ করেছেন, সিনেমা নির্মাতাদেরও সেই একই রকম স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ রয়েছে। সিনেমা নির্মাতা হিসেবে গল্প বলার এই স্বাধীনতার স্বাদ আমাকে উপভোগ করতেই হবে।’
মাত্র ১৯ বছর বয়সেই ৪ মিনিটের ‘টারান্টেলা’ নামে হরর স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানান। পরে তিন মিনিটের ‘ডুডলবার্গ’ বানিয়ে বন্ধু মহলে তুমুল প্রশংসা পান, কিছু উৎসবেও জায়গা পায়। তিনটা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়ে তিনি হাত দেন সিনেমা নির্মাণে।
নোলান বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সময়ই জেনে গিয়েছিলেন, নিজেকে প্রমাণ করতে না পারলে কেউ দাম দেবেন না। ছুড়ে ফেলবেন। নিজের স্বল্প পরিমাণ ভিত তৈরি না হলে যত বড় স্বপ্নই হোক, কেউ পাত্তা দেবেন না। কারণ, হলিউডে প্রতিবছর হাজার হাজার তরুণ সিনেমা বানাতে আসেন। তাঁদের ৯৯ ভাগই কূল খুঁজে পান না, হারিয়ে যান। সেভাবে নিজেকে দেখতে চাননি নোলান। তিনি ভেবেচিন্তে ‘ফলোয়িং’ নির্মাণে হাত দেন। সেই তাঁর গল্প হওয়া শুরু।
সিনেমাটির শুটিং করতে হয়েছিল এক বছর ধরে। ভাবছেন, সিনেমা দিয়ে বিলিয়ন ডলার আয় করা এই পরিচালকের প্রথম সিনেমার বাজেট ছিল বড় অঙ্কের? ঘটনা তা না। বাজেট সর্বসাকল্যে মাত্র ছয় হাজার ডলার। কপাল কুঁচকে ওঠার মতো ঘটনা। হলিউড ইতিহাসে সবচেয়ে কম বাজেটের সিনেমার একটির নির্মাতা নোলান, ভাবা যায়?
‘যখন আমি “ফলোয়িং”–এর কাজ শুরু করি, তখন আমেরিকার অলট্রা লো বাজেট সিনেমার মডেল খুঁজছিলাম। যেটা আমাদের এখানে যুক্তরাজ্যে সেই অর্থে বিদ্যমান ছিল না। যুক্তরাজ্য লো বাজেট ফিল্ম মানে পাঁচ থেকে ছয় লাখ ইউরো।’ক্রিস্টোফার নোলান
সিনেমার শুরুর আগের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নোলান নিউইয়র্ক টাইমসে বলেছিলেন, ‘যখন আমি “ফলোয়িং”–এর কাজ শুরু করি, তখন আমেরিকার অলট্রা লো বাজেট সিনেমার মডেল খুঁজছিলাম। যেটা আমাদের এখানে যুক্তরাজ্যে সেই অর্থে বিদ্যমান ছিল না। যুক্তরাজ্য লো বাজেট ফিল্ম মানে পাঁচ থেকে ছয় লাখ ইউরো। দেখলাম, যুক্তরাষ্ট্রে কম বাজেটে কিছু ফিচার ফিল্মের কাজ হয়েছিল, সেটাও বেশ কয়েক হাজার ডলার।’ সেখানে মাত্র ছয় হাজার ডলার নিয়ে কীভাবে সিনেমা বানাবেন এই তরুণ নির্মাতা?
বুদ্ধি করে প্রথম সিনেমার গল্পের ওপর ভর করে এগিয়ে যান। গল্পটি ছিল একদল অপরাধীদের অনুসরণ করার গল্প। জীবনটা আটকে যাওয়ার গল্প। দর্শক হিসেবে আপনি আটকে যাবেন। সিনেমাটি পরে আবার শুরু থেকে দেখতে বাধ্য করবে। গল্পের আরও নানা দিক রয়েছেই।
সপ্তাহের শনিবারে ছুটির দিন বেছে নিতেন শুটিং করতে। ওই দিন কোনো ঝামেলা হলে আর শুটিং করা হতো না। কখনো ১৫ থেকে ২০ মিনিট শুটিংয়ের সময় পেতেন। তবে শুটিং শেষ করতে হবে, এমন তাড়াহুড়া ছিল না। স্বপ্ন ছিল সিনেমা বানাতে হবে।
যা–ই হোক, বাজেট–স্বল্পতার কারণে এই ছবির সঙ্গে যুক্ত কেউই পেশাদার অভিনয়শিল্পী ছিলেন না। সবাই চাকরি করতেন। বেশির ভাগেরই আগে কখনোই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। শুধু তাই নয়, সপ্তাহের শনিবারে ছুটির দিন বেছে নিতেন শুটিং করতে। ওই দিন কোনো ঝামেলা হলে আর শুটিং করা হতো না। কখনো ১৫ থেকে ২০ মিনিট শুটিংয়ের সময় পেতেন। তবে শুটিং শেষ করতে হবে, এমন তাড়াহুড়া ছিল না। স্বপ্ন ছিল সিনেমা বানাতে হবে।
অল্প টাকায় সিনেমা বানানোর কারণে নোলানের ভরসা ছিল, অতিসাধারণ এক ক্যামেরার ওপর। যে ক্যামেরার সঙ্গে আর তেমন কোনো সরঞ্জাম ছিল না। যে কারণে ‘ফলোয়িং’ সিনেমার বেশির ভাগ শুটিং হ্যান্ডি শর্ট (হ্যান্ডহেল্ড)। উটকো ঝামেলা এড়াতে প্রচুর জনসাধারণ এমন জায়গায় কোনো শুটিং রাখা হয়নি। লোকেশনের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা।
লোকেশন ভাড়া করে শুটিং করার মানেই ছিল বিলাসিতার মতো ব্যাপার। যে কারণে সিনেমার লোকেশন ছিল বন্ধুর বাসা। শিল্পীরাও বন্ধু ও কাছের মানুষ। চুপিচাপে সপ্তাহের এক দিন শুটিং, এ জন্য বাড়তি ঝামেলা নেই। খরচ কমাতে সিনেমার সব কলাকুশলীকে আগে বলে দেওয়া হয়েছিল নিজেকেই কস্টিউম আনতে হবে। ২৮ বছরের নোলানের কাছে সিনেমা নির্মাণে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি। কারণ, লক্ষ্য ছিল সিনেমা বানানো। তিনি বহুবার একই কথা সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
শুটিংয়ের পর দীর্ঘ সময় ধরে চলে পোস্টের কাজ। একে ওকে ধরে পোস্টের কাজ শুরু হয়। খরচ কমাতে ‘ট্রান্সপোটিং’ সিনেমার সাউন্ড ট্র্যাক এতে ব্যবহার করা হয়। সিনেমার দৈর্ঘ্য ছিল ১ ঘণ্টা ৯ মিনিট। সব কাজ শেষে সিনেমাটি সেই সময় রিলিজ করতেও হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু কোনো কিছুই এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আইএমডিবি থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্য ও কানাডার বাজার থেকে সিনেমাটি ৪৮ হাজার ডলার আয় করে। সিনেমাটি সেই সময়ে গুটিকয় সমালোচকের নজরে পড়ে। বেশির ভাগই গল্প ও নির্মাণশৈলীর প্রশংসা করেন। মাত্র ৪৮ হাজার ডলার আয় করা সেই সিনেমা ১৯৯৮ সালেই নজরে পড়ে হলিউডের বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের। সেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আর কেউ নয়, বিশ্ব বিখ্যাত ওয়ার্নার ব্রস।
সেই থেকে এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আর ক্রিস্টোফার নোলানকে হাত ছাড়া করেনি। পরের ছবি ‘মোমেন্টো’ বানানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটির বিপুল অর্থ বরাদ্দ থাকলেও সেখান থেকে তিন মিলিয়ন ডলার দিয়ে সিনেমা বানান নোলান। সব মিলিয়ে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের খরচ পড়ে ৯০ লাখ ডলার, সিনেমাটি আয় করে ৪ কোটি ডলার। পরবর্তী সময় ‘দ্য ড্রার্ক নাইট’ থেকে একের পর এক বানিয়েছে ‘ওপেনহাইমার’সহ ১০টি সিনেমা। নোলানের ক্যারিয়ারের একমাত্র সিনেমা ছয় হাজার ডলারের সেই ‘ফলোয়িং’ সিনেমাটিই শুধু প্রযোজনা করতে পারেনি ওয়ার্নার ব্রস। শুধুই তারাই নয়, কোটি কোটি ডলার নিয়ে প্রযোজকেরা বসে থাকেন নোলানের সিনেমায় লগ্নি করতে।
‘‘আপনি যদি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চান, তাহলে উপভোগের সঙ্গে একটি সিনেমা তৈরি করুন। এটা নিয়ে পরে এই হবে, সেই হবে, কি হবে না হবে—এগুলো ভাবা বন্ধ করুন। আপনি যেটা নিজে বিশ্বাস করেন, সেটা করুন। সিনেমাটি বানান। আপনাকে বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। বড় স্বপ্ন দেখতে ভয় পেলে চলবে না। ভালো কাজের চেষ্টা সব সময় চালিয়ে যেতে হবে।’’ক্রিস্টোফার নোলান
দুবার অস্কারজয়ী নোলান ফিল্ম স্কুলেও যাননি। কিন্তু শৈশব থেকে স্বাধীনভাবে ফিল্মে কাজ করতে পছন্দ করতেন। চাইতেন সিনেমার ভ্রমণ যেন দীর্ঘ সময়ের হয়। এখনো তিনি বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় পরিচালকদের একজন। তাঁর পছন্দের নির্মাতাদের একজন অরসন ওয়েলস। নোলান একবার বলেছিলেন, ‘আমি যদি কারও স্বপ্ন চুরি করতে পারতাম, তাহলে অরসন ওয়েলসের কাছে যেতে হতো।’
নোলান তরুণদের সব সময় বলেন, ‘আপনি যদি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চান, তাহলে উপভোগের সঙ্গে একটি সিনেমা তৈরি করুন। এটা নিয়ে পরে এই হবে, সেই হবে, কি হবে না হবে—এগুলো ভাবা বন্ধ করুন। আপনি যেটা নিজে বিশ্বাস করেন, সেটা করুন। সিনেমাটি বানান। আপনাকে বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। বড় স্বপ্ন দেখতে ভয় পেলে চলবে না। ভালো কাজের চেষ্টা সব সময় চালিয়ে যেতে হবে।’ আজ এই পরিচালকের জন্মদিন। ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে তাঁর জন্ম।