বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও চমকপ্রদ খেলাগুলোর একটি—ফর্মুলা ওয়ান। এই ফর্মুলা ওয়ানের দুনিয়াকে এবার পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক জোসেফ কোসিনস্কি। যাঁরা ফর্মুলা ওয়ান রেসের খুব একটা ভক্ত নন, তাঁরাও সিনেমাটি দেখে মুগ্ধ হবেন। দৈর্ঘ্য আড়াই ঘণ্টার বেশি, অথচ পর্দা থেকে চোখ ফেরাতে পারবেন না। ইঞ্জিনের গর্জন, টায়ারের ঘর্ষণ, ফর্মুলা ওয়ানের রেসিং ট্র্যাক, দুর্দান্ত ক্যামেরার কাজ আর অতি অবশ্যই আবহসংগীত সিনেমার শুরু থেকেই দর্শকদের আটকে ফেলে। একদিকে রেসের উত্তেজনা, অন্যদিকে আবেগের উত্থান-পতন মিলিয়ে দারুণ এক উপভোগ্য জার্নি ‘এফ ওয়ান’।
একনজরেসিনেমা: ‘এফ ওয়ান’ধরন: স্পোর্টস, ড্রামাপরিচালক: জোসেফ কোসিনস্কিসময়: ২ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটঅভিনয়: ব্র্যাড পিট, ড্যামসন ইদ্রিস, হাভিয়ের বারদেম, কেরি কনডন।
২০২২ সালে ‘টপ গান: ম্যাভেরিক’ সিনেমায় দর্শকদের যুদ্ধবিমানের অভিজ্ঞতা দিয়েছিলেন পরিচালক। আকাশ থেকে এবার মাটিতে নেমে এসেছেন তিনি। ফর্মুলা ওয়ানের খোলা ককপিটে বসিয়ে এবার দিলেন গতির সঙ্গে রোমাঞ্চকর উত্তেজনা। গল্পের ধাঁচ অনেকটা নেটফ্লিক্সের তথ্যচিত্র ‘ফর্মুলা ওয়ান: ড্রাইভ টু সারভাইভ’ থেকে অনুপ্রাণিত। গল্প লিখেছেন এহরেন ক্রুগার। চিত্রনাট্য এহরেন ও জোসেফ—দুজন মিলে লেখা। আর প্রযোজকদের একজন ছিলেন ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন লুইস হ্যামিল্টন। প্রযোজক নিজেই যখন ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন, তখন এ সিনেমায় খেলাটা কতটা সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
৩০ বছর আগে দুর্ঘটনায় ফর্মুলা ওয়ানের রেস থেকে ছিটকে পড়েন সনি হেইস (ব্র্যাড পিট)। একসময়ের প্রতিভাবান রেসার এখন ভবঘুরে আর পাঁড় জুয়াড়ি। নিউইয়র্কে মাঝেমধ্যে তাঁকে ট্যাক্সি চালাতেও দেখা যায়। কিন্তু স্টিয়ারিং হুইল হাতে পেলে এখনো হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। ঘুম থেকে উঠেই চলে যান ডেটোনা সার্কিটে, সেখানে অংশ নেন ২৪ ঘণ্টার রেসে। গাড়ির সিটে বসার পর শূন্য থেকে যখন নিমেষেই গাড়ির স্পিড ১৮০–তে উঠে যায়, তখন দর্শকেরাও যেন সেই সেকেন্ড থেকে ঢুকে পড়েন রেসিংসের টান টান উত্তেজনার দুনিয়ায়।
সনির সঙ্গে একদিন পুরোনো বন্ধু রুবেন (হাভিয়ের বারদেম) দেখা করেন। তাঁর ফর্মুলা ওয়ান টিম এপেক্সে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। সনি প্রথমে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত যোগ দেন র্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে থাকা সেই টিমে।
ফর্মুলা ওয়ানের সাধারণ চালকদের তুলনায় বয়স্ক সনি এসেই টিমের তরুণ, প্রতিভাবান চালক জশুয়া পিয়ার্সের (ড্যামসন ইদ্রিস) মুখোমুখি হন। প্রথম থেকেই দুজনের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। বেশি বয়সের কারণে একের পর এক তির্যক মন্তব্যের মুখোমুখি হন সনি। সনি কি নিজের সেই সোনালি সময়ে ফিরে যেতে পারেন? নাকি সময়ের কাছে হার মেনে যান?
বড় পর্দায় না দেখলে ‘এফ ওয়ান’-এর আসল মজাটা ঠিক পাওয়া যাবে না। কখনো যিনি ড্রাইভিং সিটে বসেননি, সিনেমার এক পর্যায়ে তাঁরও মনে হবে, নিজেই চালাচ্ছেন রেসিং কার। ক্যামেরার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে শুরু করে গাড়ির স্টিয়ারিং কিংবা চাকার ঘোরা—প্রতিটি দৃশ্যে দর্শক যেন রেসিং স্যুট পরে সিটে বসে আছেন। ট্র্যাকের ওপর গাড়ির স্পিড, বাঁক নেওয়া, রেসের ভেতরে সংঘর্ষের মুহূর্তগুলো ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। প্রতিটি মুহূর্তে ‘রিয়েল টাইম’ অনুভূতি দেয় এ সিনেমা। চিত্রগ্রাহক ক্লদিও মিরান্দা এখানে ভালো কাজ করেছেন।
আসল এফ ওয়ান রেসিং ট্র্যাকে শুটিং, এফ ওয়ান ড্রাইভার ও ফর্মুলা ওয়ান পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের পূর্ণ সহায়তা নিয়ে নির্মিত হয়েছে এ ছবি। ছবিতে বাস্তবতাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা আগে কোনো চলচ্চিত্রে এভাবে দেখা যায়নি। এতেই বোঝা যায়, ৩০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে বানানো এ সিনেমায় নির্মাতারা কতটুকু শ্রম দিয়েছেন।
অস্কারজয়ী সুরকার হান্স জিমারের মিউজিক এ সিনেমাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। সনির একার মুহূর্ত হোক কিংবা রেসিং ট্র্যাকে যুদ্ধ—গান আর আবহসংগীতের জাদুতে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে যান দর্শক।
সিনেমা দেখতে দেখতে পিক্সারের ২০০৬ সালের হিট অ্যানিমেশন ছবি ‘কারস’-এর কথা মনে পড়বে। যেখানে তরুণ গরম মেজাজের রেসারকে ঝালিয়ে নিচ্ছেন বয়স্ক চালক। অথবা আপনার মনে পড়তে পারে রন হাওয়ার্ডের ‘রাশ’ সিনেমার কথা। কাকতালীয়ভাবে সে সিনেমার সংগীত পরিচালকও ছিলেন হান্স জিমার। দুই রেসারের দ্বন্দ্ব নিয়ে ‘রাশ’। তবে সেখানে গতি কম, ড্রামা বেশি। কোসিনস্কি ভালো করেই জানেন, সময় বদলে গেছে। এখন এত ড্রামা দেখতে দর্শক, বিশেষ করে তরুণেরা আগ্রহী হবেন না। তাই তিনি গল্পের চেয়ে বরং গতির ঝড় তুলে কাবু করতে চেয়েছেন। তিনি যে সফল হয়েছেন, বলাই বাহুল্য।
ক্লান্ত, কিন্তু অভিজ্ঞ, প্রতিযোগিতাপ্রিয় চালকের চরিত্রে ব্র্যাট পিট দারুণ। তাঁর চোখের চাহনি, সংলাপ বলার ভঙ্গি, এমনকি নীরব থাকার মুহূর্তগুলোতে তিনি অভিজ্ঞতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। মাথায় সেফটি হেলমেট, মুখে সেই চেনা চেনা কাউবয় হাসি, ষাট পেরোনো ব্র্যাড পিট যখন রেসিং কারের স্টিয়ারিং ধরেন, তখন মনে হয়, এ হারলে হারতেই পারে কিন্তু হাল ছাড়বে না।
তরুণ চালক জশুয়া পিয়ার্সের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ড্যামসন ইদ্রিস। তরুণ বয়সের আবেগ, জেদ, সহানুভূতি—সবকিছুই ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তাঁদের দুজনের সম্পর্কের রসায়ন এ সিনেমার প্রধান চালিকা শক্তি। অ্যারো ডায়নামিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কেরি কনডনের উপস্থিতিও সাবলীল। সনির বন্ধুর চরিত্রে হাভিয়ের বারদেমও দারুণ। পুরো মাত্রার বাণিজ্যিক হলিউড সিনেমায় এই স্প্যানিশ তারকাকে দেখতে ভালোই লাগে।
সিনেমার প্রথমে আপনার হয়তো এফ-ওয়ান রেসের কায়দাকানুনের সঙ্গে পরিচিত হতে একটু সময় লাগবে। হট গিয়ার, পিট স্টপ, ল্যাপস—এ ধরনের শব্দের অর্থ জানা থাকলে সিনেমাটি বুঝতে সুবিধা হবে। তবে না জানলেও ক্ষতি নেই। কারণ, ধারাভাষ্যকার বলেই দেন কী হতে যাচ্ছে।
সিনেমার শেষ কিছুটা আগেই অনুমান করা গেলেও টিমের মধ্যে স্নায়বিক দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের ওঠানামা আর সময়কে হার মানানোর গল্প হিসেবে ‘এফ ওয়ান’ বেশ উপভোগ্য। আবুধাবিতে শেষ ল্যাপ পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত দর্শকদের আবেগে মোড়ানো গতিময় আনন্দযাত্রা উপহার দেয়। হিট স্পোর্টস সিনেমা মানেই আন্ডারডগের হিরো হওয়ার গল্প। এ সিনেমাও এর ব্যতিক্রম নয়। দীর্ঘদিন পর রেসে ফিরে যেভাবে পেশাদার রেসারদের অনায়াসে টপকে যান সনি, আদতে সেটা অতিনাটকীয়। তবে দেখার সময় এত কিছু মনে থাকে না। গতির ঝড় আপনাকে এমনভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যে অন্য কিছু ভাবার সময়ই পাবেন না!