২০২৫ সালের সেরা কোরীয় সিরিজ কোনগুলো। কোলাজ
২০২৫ সালের সেরা কোরীয় সিরিজ কোনগুলো। কোলাজ

২০২৫ সালের সেরা কোরীয় সিরিজ কোনগুলো

২০২৫ সালেও কোরীয় টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বজুড়ে আধিপত্য আরও দৃঢ় করেছে। সারা বিশ্বের টিভি দর্শকদের আগ্রহের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে কোরিয়ান কনটেন্ট। কোরিয়ান ড্রামা রপ্তানির ইতিহাস নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নেটফ্লিক্সসহ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর বড় বিনিয়োগে এই গতি বহুগুণে বেড়েছে। ফলে কোরীয় ড্রামা আরও সহজলভ্য হলেও বৈশ্বিক দর্শকদের কথা বিবেচনায় নিয়ে নির্মিত এসব কনটেন্টে গল্পগুলোর ধরনেও প্রভাব ফেলছে। তবে এই বদলের মধ্যেও বেশ কয়েকটি সিরিজ শিল্পমান বজায় রাখার জন্য প্রশংসিত হয়েছে। ২০২৫ সালের সেরা দশ কোরীয় সিরিজের তালিকা প্রকাশ করেছে টাইম সাময়িকী।

‘ট্রিগার’(নেটফ্লিক্স)

‘ট্রিগার’–এর দৃশ্য। ছবি: নেটফ্লিক্স

পুলিশ কর্মকর্তা লি দো (কিম নাম-গিল) এককালে ছিলেন সেনাসদস্য। অতীতে অস্ত্র ব্যবহারের কারণে মনে তাঁর কষ্ট আছে। ফলে পুলিশের চাকরিতে থেকেও তিনি সচরাচর অস্ত্র ব্যবহার করেন না। কিন্তু চোরাচালানের অস্ত্রে সয়লাব দেশ। তাই বাধ্য হয়ে আবার অস্ত্র হাতে তুলে নেন লি দো। এই অস্ত্র পাচারের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালানকারী গোষ্ঠী ‘ইন্টারন্যাশনাল রাইফেল ইউনিয়ন’। সংগঠনটির হয়ে কাজ করেন মুন বেক (কিম ইয়ং-কোয়াং), শৈশবে যিনি অঙ্গ পাচারের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হয়েছিলেন। প্রতিশোধ নিতে ফিরেছে তিনি, তাঁর হাত দিয়েই কোরিয়ার রাস্তায় বইছে অস্ত্রের বন্যা। মুখোমুখি হন লি দো আর মুন বেক। এ-ই হলো ১০ পর্বের সিরিজ ‘ট্রিগারের’ গল্প।

কোরিয়ায় যখন আগ্নেয়াস্ত্র সহজলভ্য হয়ে ওঠে, তখন কী ঘটে—এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে নির্মিত ‘ট্রিগার’ দেখার অভিজ্ঞতা, বন্দুক সহিংসতা প্রায় নেই এমন দেশে বসবাসকারী দর্শকের কাছে এক রকম, আর ভিন্ন বাস্তবতায় থাকা দর্শকের কাছে আরেক রকম। লেখক ও পরিচালক কওন ও-সুং সিরিজটিতে বার্তা দিয়েছেন, কেন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ জরুরি।

‘স্পিরিট ফিঙ্গারস’(ভিকি)

‘স্পিরিট ফিঙ্গারস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

কল্পনাপ্রবণ, মায়াময় এক কিশোরীকে নিয়ে নির্মিত ড্রামা ‘স্পিরিট ফিঙ্গারস’ বছরের শেষ দিকে যেন ঝোড়ো হাওয়ার মতো হাজির হয়। গল্পের কেন্দ্রে সং উ-ইয়ন (পার্ক জি-হু)-একটি ‘নিখুঁত’ পরিবারে বেড়ে ওঠা লাজুক কিশোরী। একদিন সে হঠাৎ ঢুকে পড়ে ‘স্পিরিট ফিঙ্গারস’ নামের এক স্কেচ ক্লাবে, যেখানে দক্ষতার চেয়ে আবেগই মুখ্য। সেখানেই শুরু তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার যাত্রা এবং নাম গি-জিয়ংয়ের সঙ্গে এক মিষ্টি প্রেম।

ওয়েবটুন অবলম্বনে তৈরি হলেও এই ড্রামা মূল শিল্পীসত্তা ও ভিজ্যুয়াল স্টাইল অক্ষুণ্ন রেখেছে। বার্তাও পরিষ্কার, সাধারণ হয়েও নিজেকে বিশ্বাস করা দারুণ।

‘দ্য টেল অব লেডি ওক’ (কোকোওয়া)

‘দ্য টেল অব লেডি ওক’–এর দৃশ্য। নেটফ্লিক্স

‘দ্য গ্লোরি’ দিয়ে আলোচিত লিম জি-ইয়ন অভিনীত এই জোসন যুগের ড্রামায় এক নারী আইনজীবীর গল্প বলা হয়েছে, যিনি আসলে নিজেকে যা দাবি করেন, তা নন। দাসী গুদক থেকে অভিজাত ওক তে-ইয়ং হয়ে ওঠা, তারপর সত্য প্রকাশের হুমকি—সব মিলিয়ে ১৬ পর্বের এক টান টান কাহিনি।

রাজপরিবার নয়, বরং শ্রেণিবৈষম্য, লিঙ্গভিত্তিক নিপীড়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে কেন্দ্র করায় এই ঐতিহাসিক ড্রামা আলাদা গুরুত্ব পায়। এটি মূলত এক নারীর টিকে থাকার গল্প।

‘স্টাডি গ্রুপ’(ভিকি)

‘স্টাডি গ্রুপ’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

ইউন গা-মিনের (হাওয়াং মিন-হেয়ুন) গল্প। সে পড়াশোনায় নয়, শুধু মারামারিতে পারদর্শী। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে সে কঠোর পরিশ্রম করার চেষ্টা করে। এ জন্য সে ‘স্টাডি গ্রুপ’ তৈরি করে যুসং টেকনিক্যাল হাই স্কুলে; এরপর কী হয়, তা নিয়েই এগিয়েছে গল্প।

ড্রামাটি অ্যাকশন, হাস্যরস আর আবেগের দারুণ মিশেল রয়েছে। ওয়েবটুনের ওপর ভিত্তি করে এটি তৈরি হওয়ায় চিত্রনাট্য ও শৈলীতে সেই স্টাইল স্পষ্ট। মারামারিগুলো কখনো কখনো অতিরঞ্জিত এবং অতিরিক্ত মনে হতে পারে, তবে এটি সিরিজের মজা বাড়ায়।

‘রেসিডেন্ট প্লেবুক’ (নেটফ্লিক্স)

‘রেসিডেন্ট প্লেবুক’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

হাসপাতালকেন্দ্রিক ড্রামাগুলোর মধ্যে চলতি বছর সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া ছিল ‘রেসিডেন্ট প্লেবুক’। প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগে চার তরুণ চিকিৎসকের প্রথম বছরের গল্প। চরিত্রগুলোর মানবিক দিক, কোরিয়ার জন্মহার সংকটের প্রসঙ্গ মিলিয়ে দর্শকদের এক উষ্ণ অভিজ্ঞতা দেয়।

১২ পর্বের সিরিজটিতে অভিনয় করেছেন ওহ ইয়ি-ইয়ং (গো ইউন-জুং), কিম সা-বি (হান ইয়েজি), প্যো নাম-ক্যোং (শিন শি-আ) এবং উম জে-ইল (ক্যাং ইউ-সক)। সিরিজটি শেখায়, ভুল করা ও সাহায্য চাওয়াও জীবনের অংশ।

‘আওয়ার আনরিটেন সিউল’(নেটফ্লিক্স)

‘আওয়ার আনরিটেন সিউল’–এর দৃশ্র। আইএমডিবি

মানসিক অসুস্থতাকে ব্যর্থতা নয়, সাহস হিসেবে দেখার বার্তা দেয় এই সিরিজ। যমজ বোন মি-জি ও মি-রি-র জীবন বদলের গল্পে উঠে এসেছে হতাশা, শোক ও নতুন করে বাঁচার চেষ্টা। যদি আপনি এমন গল্প পছন্দ করেন, যা কিছুটা মেলোড্রামা আর রোমান্সের মিশ্রণে তৈরি, তাহলে সিরিজটি আপনার জন্যই। ১২ পর্বের সিরিজটি পরিচালনা করেছেন নাম গিয়ন।

‘টেম্পেস্ট’ (হুলু)

‘টেম্পেস্ট’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

রাজনৈতিক থ্রিলার হলেও সিরিজটির প্রাণ শক্তিশালী প্রেম। জুন জি-হিউন ও গাং ডং-ওনের রসায়ন, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বাস্তবসম্মতভাবে দেখানোর সাহস—সব মিলিয়ে টেম্পেস্ট আলাদা হয়ে উঠেছে। সিরিজটির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন দক্ষ কূটনীতিক মুন-জু (জুন জি-হিউন), যিনি একসময় জাতিসংঘে দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, এবং রহস্যময় জাতীয়তার আন্তর্জাতিক বিশেষ এজেন্ট সান-হো (গাং ডং-ওন)। এই দুজন একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযান শুরু করেন, যার লক্ষ্য হলো এমন একটি প্রাণঘাতী হামলার সত্য উদ্‌ঘাটন করা, যা কোরিয়ার উপদ্বীপের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

‘স্কুইড গেম ৩’ (নেটফ্লিক্স)

‘স্কুইড গেম ৩’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

শেষ মৌসুমেও আধুনিক পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা তুলে ধরেছে ‘স্কুইড গেম’। এটি পালানোর গল্প নয়; বরং বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করানোর সাহসী প্রয়াস। হোয়াং ডং-হিউক পরিচালিত এই মৌসুমে অভিনয় করেছেন লি জং-জে, লি বিয়ং-হান, উই হা-জুন, ইম শি-ওয়ান, কাং হা-নুল। এই মৌসুমে সিওং গি-হুন এবং খেলোয়াড়েরা আরও মারাত্মক খেলায় বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করবে, যার পরিণতি ভয়াবহ।

সিরিজটির শেষ মৌসুম চমৎকার ভিজ্যুয়াল আর দুর্দান্ত অভিনয় সত্ত্বেও চরিত্র বিকাশে সীমাবদ্ধ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে কিছু গল্প একবারই বলার জন্যই ভালো; একের পর এক মৌসুম এলে সহিংসতা দেখিয়েও গল্পের গভীরতা ধরে রাখা যায় না। তবু সব বিবেচনাতেই চলতি বছরের অন্যতম সেরা কে-ড্রামা এটি।

‘ওয়ে ব্যাক লাভ’ (ভিকি)

‘ওয়ে ব্যাক লাভ’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

এটি ২৪ বছর বয়সী জং হি-ওয়ানের (কিম মিন-হা) গল্প। জীবনের প্রতি কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছা না থাকায় তিনি নিজেকে সমাজ থেকে গুটিয়ে নিয়ে ‘একঘরে’ জীবন কাটাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই তার সামনে হাজির হয় শৈশবের বন্ধু ও প্রথম প্রেম কিম রাম-উ (জং মেউং)। কিন্তু সে আর সাধারণ মানুষ নয়-সে এসেছে মৃত্যু-দূত হিসেবে। রাম-উই হি-ওয়ানকে জানায়, তার জীবনের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি।

এই অপ্রত্যাশিত ঘোষণাই হি-ওয়ানের স্থবির জীবনে নতুন করে নাড়া দেয় এবং গল্পকে নিয়ে যায় আবেগ, স্মৃতি ও জীবনের অর্থ অনুসন্ধানের পথে। প্রথম প্রেম হারানোর শোক, মৃত্যু ও আবার বাঁচার আকাঙ্ক্ষামাত্র ছয় পর্বে আবেগের গভীরতা ছুঁয়েছে এই সিরিজ। কিম মিন-হার অভিনয় একে অনন্য করে তুলেছে।

‘হোয়েন লাইফ গিভস ইউ ট্যানজারিনস’ (নেটফ্লিক্স)

‘হোয়েন লাইফ গিভস ইউ ট্যানজারিনস’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

কোরিয়ার ষাটের দশকের দুই তরুণ-তরুণীর জীবনের গল্পকে পর্দায় তুলে এনেছেন নির্মাতা কিম উন-সিয়ক। গল্পের পরতে পরতে স্মৃতিকাতরতা। ‘হোয়েন লাইফ গিভস ইউ ট্যানজারিনস’ দেখে দর্শক কখনো কেঁদেছেন, কখনো হেসেছেন।

ষাটের দশকের দুই চরিত্র আ সন (আইইউ) ও গোয়ান সিককে (পার্ক বো-গাম) নিয়ে আবর্তিত হয়েছে সিরিজের গল্প। গল্পে কোনো রহস্য নেই, সাদামাটা জীবনের গল্প নিপুণভাবে বুনেছেন নির্মাতা। নির্মাতা কিম উন-সিয়ক বলছেন, সিরিজটি দাদা-দাদি, মা–বাবাদের প্রজন্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মাণ করেছেন।