জীবন-প্রাণ-জ্ঞানকে তুচ্ছ করে পৃথিবীতে নেমে এসেছিল কোভিড-১৯। অদৃশ্য ভাইরাস ছুঁয়ে দিয়েছিল প্রত্যেক মানুষের শরীর-মন। জন্ম দিয়েছিল আতঙ্কের, পাশাপাশি নতুন এক বোধের। সেই বোধে মিশে ছিল অসহায়ত্ব, বেঁচে থাকার সংগ্রাম আর অনিশ্চয়তার ছায়া। মানুষ ঘরে বন্দী হয়ে বুঝেছিল, সামান্য একটু নিশ্বাস কতটা মূল্যবান। সেই কঠিন সময়কেই সিনেমার ফ্রেমে ধরে রেখেছেন নির্মাতা পিপলু আর খান। তৈরি করেছেন সিনেমা ‘জয়া আর শারমিন’, যেখানে একটি ঘরের ভেতর আবদ্ধ থেকে ফুটে উঠেছে দুই নারীর নিঃসঙ্গতা, মনস্তত্ত্ব ও সম্পর্কের ভঙ্গুরতা।
দুই নারীর আবদ্ধ গল্প
সিনেমার কাহিনি গড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন সামাজিক স্তরের দুই নারীকে ঘিরে। একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া, আরেকজন তাঁর গৃহকর্মী শারমিন। বিধিনিষেধের মধ্যে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে একই ঘরে। বাইরে মৃত্যু ও ভয়ের রাজত্ব, ভেতরে নিস্তব্ধতা। সেই নির্জন সময়ের ভেতর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তাদের সম্পর্ক। কখনো তা ঘনিষ্ঠতার, আবার কখনো তা ভাঙনের। শেষ পর্যন্ত নিঃসঙ্গতা আর পরিবর্তনের ভারেই সম্পর্কটা আলগা হয়ে যায়।
সিনেমাটি ২৪ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে (২৫ সেপ্টেম্বর) মুক্তি পাচ্ছে দেশের জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে। অভিনয় করেছেন দুই গুণী অভিনেত্রী—জয়া আহসান ও মহসিনা আক্তার। অতিথি চরিত্রে আছেন তানজিম সাইয়ারা তটিনী। গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন পিপলু আর খান ও নুসরাত ইসলাম মাটি। এর আগে চলতি বছরের মে মাসে সিনেমাটি মুক্তি পায় প্রেক্ষাগৃহে।
যা বললেন নির্মাতা
ওটিটিতে সিনেমাটি মুক্তি পাওয়া নিয়ে উচ্ছ্বসিত পিপলু আর খান। তিনি বলেন, ‘সিনেমাটি ওটিটিতে মুক্তি পাওয়াটা আমাদের জন্য খুব আনন্দের। আমরা যে সময়ের কথা বলতে চেয়েছি বা যেটা দেখাতে চেয়েছি, সেটা সহজেই এবার দর্শকদের কাছে পৌঁছে যাবে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা সিনেমাটি দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, এবার তারাও সুযোগ পাবেন। আমার মনে হয় চরকিতে মুক্তি পাওয়া একটি সঠিক সিদ্ধান্ত।’ পিপলু মনে করেন, সিনেমাটির মূলে আছে নারী মনস্তত্ত্ব, ‘আমার মনে হয় নারী দর্শকেরা হয়তো একটু বেশি রিলেট করতে পারবেন সিনেমাটি। তবে মূলত এটি মানুষের ভেতরের একাকিত্ব, সম্পর্কের ভাঙন আর বোধকে নিয়েই তৈরি।’
অভিনয় ছিল না, ছিল জীবন
এই সিনেমার অভিজ্ঞতা জয়া আহসানের কাছে সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি বলেন, ‘এই সিনেমাটা বা এই সিনেমায় কাজের অভিজ্ঞতা অন্য কাজের সঙ্গে মেলাই না বা মেলানো যায় না। আমার অন্যান্য কাজে ফিল্ম ইউনিটটা একটু বড় হয়। কিন্তু এই শুটিংয়ে তেমন কিছুই ছিল না। যে কয়জন না হলেই না, তাঁদের নিয়েই কাজটি করা হয়েছে।’ শুটিংয়ের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে জয়া আরও বলেন, ‘ক্যামেরা যে চলছে, সেটা মাঝে মাঝে বোঝাই যেত না। সিনেমায় যে ড্রেসগুলো পরতাম, সেগুলো নিজেরাই ধুতাম, রোদে শুকিয়ে আয়রন করতাম। এতবার আয়রন করতাম যে মনে হতো কাপড়গুলো পুড়েই যাবে। সবই করতাম জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য। শুটিং শেষে আমি বাসায় যেতাম না। কারণ, বাসায় মা ছিলেন। দায়িত্বশীলতা থেকেই সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
জয়ার চোখে সিনেমাটির অভিনয় ছিল বাস্তবতার কাছাকাছি, ‘প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির সময় যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলেছেন, এটা রিয়েল একটা সিনেমা। খুব অনেস্টি নিয়ে বানানো হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, এখানে অভিনয়টা ঠিক অভিনয়ের মতো না, জীবন আমরা যেটা যাপন করেছি, সেটাই ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।’
‘শেষ অভিনয় ভেবেছিলাম’
কোভিড–১৯–এর সময় শুটিং হওয়ায় অভিনেত্রী মনে করেছিলেন, হয়তো এটিই হতে পারে তাঁর শেষ অভিনয়, ‘শুটিংয়ের সময় আমরা ভাবছিলাম, এটা কি আমাদের শেষ অভিনয়? হতেই পারে এটা আমাদের শেষ কাজ। তখন চারপাশ এত নিশ্চুপ ছিল যে বনানীর মতো জায়গায়ও কোনো শব্দ শুনতে পেতাম না। সবকিছুই ছিল অবাস্তবের মতো।’
সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় অনেকটা দেরিতে। এ বিষয়ে জয়ার উপলব্ধি, ‘আমার মনে হয়েছে ওটাই ঠিক সময়। ওই ক্রাইসিসটা কেমন ছিল, ওটা আমরা কীভাবে ওভারকাম করেছি, সেটা দর্শক দেখার সুযোগ পেয়েছেন। এখন চরকিতে মুক্তির কারণে আরও অনেকে দেখতে পারবেন এবং সেই সময়টাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন।’
অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত
শারমিন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মঞ্চ ও পর্দার অভিনেত্রী মহসিনা আক্তার। তাঁর অভিজ্ঞতাও ছিল অন্য রকম। তিনি বলেন, ‘অভিনয়ের ক্ষেত্রে পিপলু ভাই যে স্বাধীনতাটা দিয়েছেন, সেটা খুব কম পরিচালকই পারেন। প্রথমে আমাকে যতটুকু বলা হতো ততটুকুই করতাম, পরে ইচ্ছা হতো ইম্প্রোভাইজ করার। কয়েকবার ইম্প্রোভাইজ করার পর পরিচালক যখন বললেন সব ঠিক আছে, তখন সাহস পেলাম। সহশিল্পী আর পরিচালক আত্মবিশ্বাসী না হলে এটা হয় না।’
কোভিডের অভিজ্ঞতা তাঁকে ভেতরে–ভেতরে নাড়া দিয়েছে, ‘ওই সময় খুব ভালোভাবে অনুধাবন করেছি প্রকৃতির কাছে আমরা খুব তুচ্ছ। একটা বড় বোধ হয়েছে, জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই, আবার জীবনের চেয়ে অসহায়ও কিছু নেই। আমাদের অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। পারিবারিক বন্ধন, মানুষকে সময় দেওয়া, সম্পর্কগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া, এসব আবার নতুন করে মনে হয়েছে।’
সময়ের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে ‘জয়া আর শারমিন’
কোভিড-১৯ সময়ের স্মৃতি যতই ম্লান হয়ে যাক, মানুষের মনে তার ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। সেই সময়টাকে শিল্পে ধারণ করা সহজ নয়। কিন্তু ‘জয়া আর শারমিন’ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। বাস্তবতা, আবেগ আর নিঃসঙ্গতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ এই সিনেমা। দর্শকের কাছে এটি কেবল বিনোদন নয়, বরং সময়ের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।